নতুন প্রজন্মের কাছে ক্যালেন্ডার আর ততটাও আকর্ষণীয় নয় তেমনটাই মনে করছেন ক্যালেন্ডার শিল্পের সঙ্গে জড়িত কর্মীরা। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ
নববর্ষ মানেই বৈশাখের শুরু। হালখাতা। মিষ্টির প্যাকেট। আর নানা রকম নকশা করা ক্যালেন্ডার। বাঙালির কাছে পুরোটাই একটা নস্টালজিয়া। এই ব্যস্তবহুলযন্ত্রনির্ভর জীবনে ক্যালেন্ডারের জনপ্রিয়তা যেন ক্রমশই হারিয়ে যেতে বসেছে। নতুন প্রজন্মের কাছে ক্যালেন্ডার আর ততটাও আকর্ষণীয় নয়। অন্তত তেমনটাই মনে করছেন ক্যালেন্ডার শিল্পের সঙ্গে জড়িত কর্মীরা।
গত দু’বছর কোভিড বিধি জারি থাকায় হালখাতার উৎসব বন্ধ ছিল। এবার নিষেধাজ্ঞা অনেকটাই শিথিল হয়েছে। নববর্ষ উদ্যাপনের দোরগোড়ায় এসেও ক্যালেন্ডার তৈরির ছবিটা যেন আগের মতো নেই।
বাংলা তারিখ বা একাদশী, দ্বাদশী, অমাবস্যা, পূর্ণিমার মতো বিশেষ দিন ক্ষণ দেখার জন্য ক্যালেন্ডার ব্যবহৃত হয়। ছবি: সংগৃহীত
১৭ নং, জাস্টিস মন্মথ মুখার্জী রোড। রত্না আর্ট প্রিন্টার্স। দুই ভাইয়ের নিজস্ব একচালার ছাপাখানা। এ বছর ক্যালেন্ডার ছাপার বরাত পাননি এমন নয়। তবেহালখাতার আগে সেই পুরনো ব্যস্ততা এখন আর নেই বললেই চলে। ছাপাখানার মালিক উদয় বিশ্বাস জানালেন, ‘‘করোনা আসার আগেও তাও ক্যালেন্ডার ছাপার কাজ পেতাম। লকডাউনে হালখাতার উৎসব বন্ধ হয়ে যাওয়ায় আগের মতো আর ক্যালেন্ডার ছাপার বরাত পাই না। এ বারেও হাতে গোনা কিছু ক্যালেন্ডার ছাপিয়েছি। তাও ছোটখাটো দোকানের জন্য। কিন্তু বছর পাঁচেক আগেও ক্যালেন্ডার শিল্পের হাল ততটাও খারাপ ছিল না। সারা বছরে যা রোজগার করতাম তার বেশির ভাগটাই উঠে আসত ক্যালেন্ডার ছাপিয়ে। সেই সব দিন আর নেই। এখন নববর্ষের আগে ক্যালেন্ডারের চেয়ে কাগজের বিজ্ঞাপন, দোকানের বিল, প্লাস্টিক এসব বেশি ছাপাই।’’
আগে বাড়িতে হালখাতা সেরে কেউ ফিরলে বাড়ির ছোটদের মধ্যে ক্যালেন্ডার দেখা নিয়ে হুড়োহুড়ি পড়ে যেত। আজকাল আর অল্প বয়সিদের মধ্যে ক্যালেন্ডার নিয়ে সেই উন্মাদনা দেখা যায় না। রত্না প্রিন্টার্সের আরও একজন অংশীদার উৎপল দাস বললেন, ‘‘ আমার নাতনি তো ক্যালেন্ডার দেখতেই পারে না। কোনও বিশেষ দিনের তারিখ জিজ্ঞাসা করলে মোবাইল দেখে বলে দেয়। আজকালকার ছেলে মেয়েদের কাছে মোবাইল একটা আলাদা জগৎ। সব কিছুর সমাধান সেখানেই খুঁজে নেয়। আর তা ছাড়া ইদানীং তো হালখাতার জাঁকজমকও কমে এসেছে। করোনা আসায় সব ধরনের ব্যবসাও মন্দা। বড় করে হালখাতা পালন করার মতো পুঁজিই নেই অনেকের। আমাদের কাছেও এ বার তাই ক্যালেন্ডার ছাপানোর অনেক কম বরাত এসেছে।’’
একই সুর শোনা গেল শিয়ালদহের কাছে বৈঠকখানা বাজারে তিন পুরুষের মুদ্রণ ব্যবসায়ী অরূপ রায়ের গলাতেও। তিনি জানালেন, ‘‘বাংলা তারিখ বা একাদশী, দ্বাদশী, অমাবস্যা, পূর্ণিমার মতো বিশেষ দিন ক্ষণ দেখার জন্য ক্যালেন্ডার ব্যবহৃত হয়। তবে এখন আর বাংলা তারিখের খুব একটা প্রয়োজন পড়ে না। ক্যালেন্ডার থাকলেও তা বাড়ির দেওয়ালে খুব কমই ঝুলতে দেখা যায়। অনেকেই দেওয়ালে ক্যালেন্ডার টাঙানোর পরিবর্তে চোখের আড়ালে কোনও জায়গায় রেখে দেন। জনপ্রিয়তা হারানোয় অল্প অল্প করে তাই চাহিদাও কমেছে ক্যালেন্ডারের।’’
সত্যিই কি তাই?
‘নিউ ডিজিটাল ইমেজ’-এর কর্ণধার বছর চল্লিশের প্রদীপ সাহা কিন্তু খানিক অন্য কথা বলছেন। তিনি মূলত অফসেটে ক্যালেন্ডার তৈরি করেন। তাঁর কথায় ‘‘আমি এ বারেও ক্যালেন্ডার ছাপানোর খুব একটা কম বরাত পাইনি। তবে হ্যাঁ, কোভিডের আগে যেমন অর্ডার আসত সেই তুলনায় অনেক কম। করোনার জন্য হালখাতার উৎসবে খানিক ভাঁটা পড়েছে। তার সঙ্গে ক্যালেন্ডারর চাহিদা কমে যাওয়ার কিন্তু কোনও সম্পর্ক নেই। ২০১৯ সালের মতো এ বারেও বেশ কিছু বড় সংস্থার ক্যালেন্ডার আমি ছাপিয়েছি। মানুষের পছন্দ বদলেছে। চাহিদা নয়। আমি যেহেতু অফসেটে কাজ করি ফলে বিভিন্ন রং, নানারকম নকশায় ক্যালেন্ডার সাজিয়ে তোলার সুযোগ থাকে। কিন্তু ছাপাকলে যে ক্যালেন্ডার ছাপা হয় তা আকর্ষণীয় করে তোলার সুযোগ কমথাকে।’’
পর পর করোনার তিনটি স্ফীতি পেরিয়ে, ব্যবসায়িক মন্দার ঝড়ঝাপটা সামলে অফসেটে ক্যালেন্ডার ছাপানোর ব্যয় বহন করতে অনেক ব্যবসায়ীর ক্ষেত্রেও খানিক কষ্টসাধ্য হয়ে উঠতে পারে। এ প্রসঙ্গে প্রদীপ বললেন, ‘‘বিপুল খরচ একেবারেই নয়। প্রিন্টিং প্রেসে ছাপা ক্যালেন্ডার প্রতির দাম ৬-৭ টাকা করে শুরু। অফসেটে সেখানে হয়তো ক্যালেন্ডারের দাম ৯-১০ টাকার মধ্যে ঘোরাঘুরি করে। দাম নির্ভর করে কাগজের উপর, নকশার উপকরণের উপর। তবে দুটোর মধ্যে দামের হেরফের খুব বেশি নয়।’’
খরচের কথা বাদ দিলেও প্রশ্ন থেকে যায়, বাংলা ক্যালেন্ডারের চাহিদা নিয়ে। নতুন প্রজন্মের কাছে দুর্গা পুজোর ছুটির কত থেকে কত তারিখ, তা জানার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। কিন্তু কবে নীল ষষ্ঠীর উপোস, তা জানার তেমন দরকার রয়েছে কি? সবচেয়ে বড় কথা বিশ্বায়নের যুগে মধ্যবিত্ত বাঙালির অন্দরমহল অনেক বদলে গিয়েছে। তাঁরা দেওয়ালে ‘চারুলতা’, ‘মহানগর’-এর সত্যজিত রায়ের হাতে আঁকা পোস্টার রাখতে চান, বাংলা ক্যালেন্ডার তার পাশে শোভা পায় না। তাই কোন ক্যালেন্ডারের নকশা কত সুন্দর, সেই নিয়ে কৌতূহলও এখন তলানিতে। তবে খাতা-পেন্সিলের যে কোনও বড় মার্কা মারা সংস্থার বিপণিতে ঢুকলেই আজকাল চোখে পড়ে বাংলায় লেখা নানা উদ্ধৃতি দেওয়া রং বেরঙের ইংরেজি ক্যালেন্ডার। সেগুলি কিন্তু নতুন প্রজন্ম বেশ আনন্দের সঙ্গেই কেনেন এবং অফিসের ডেস্কে সাজিয়েও রাখেন। বাংলা ক্যালেন্ডারের তেমন ভোলবদল হলে, তার জনপ্রিয়তা ফিরবে কি না, তা নিয়ে ভেবে দেখার মতো বিষয় বইকি।