Travel news

মেঘ-কুয়াশার জঙ্গলে ছুটি কাটানোর দারুণ ঠিকানা লাটপাঞ্চার

মহানন্দা অরণ্যের অন্দরমহলে লুকিয়ে অপার বিস্ময়।

Advertisement

অঞ্জন সরকার

শেষ আপডেট: ১৮ জানুয়ারি ২০২০ ০৯:১২
Share:

মেঘ-কুয়াশার জঙ্গলে।

কালিঝোরা বাজার থেকে এন এইচ-৩১ ছেড়ে রাস্তা ঘুরতেই একটা প্রেয়িং মেন্টিস উড়ে এল। একটা বুনো ভাজা গন্ধ দমকা হাওয়ায়। এ গন্ধটা লহমায় মনটাকে ফিরিয়ে নিয়ে যায় পঁচিশ বছর বয়সে। সব কিছু এলোমেলো করে দেওয়ার বয়স। বাঁ দিকের খাদের ভিতর থেকে অতলান্ত সবুজ, মাথা তুলে... পাখির শিস... হালকা পাখায় ভর করে ভেসে যাওয়া প্রজাপতির সঙ্গে ভেসে যাওয়া মন... সব নিয়ে পৌঁছে গেলাম মহানন্দা অরণ্যের ভিতরের মহলে ৪০০০ ফুট উচ্চতার এক ছোট্ট জনপদে— লাটপাঞ্চার।

Advertisement

গাড়ি থেকে নামতেই পদমের আপ্যায়ন। পৌঁছে যাই তার হোমস্টে-তে। এখন কোনও ট্যুরিস্ট নেই। গোটা ঘরটায় কেন, গোটা বাড়িটায় আমিই রাজা। বারান্দায় এসে দাঁড়াই। দূরে শেষ রাতের পাহাড়ি কুয়াশার বুনোট কেটে হালকা রোদে পাহাড় আর জঙ্গলের শরীরী ঢেউ। তারিয়ে উপভোগ করি পদমের আনা এক পেয়ালা গরম চা। এখানে এসে এক পলকেই মনে হয়েছে, এমন অনেক কিছু এখানে আছে যাদের মাঝে থাকা যায় শুধুই আনন্দে।

দারুণ একটা দুপুরের খাওয়া শেষে চার কিলোমিটার পথ উজিয়ে নামতে শুরু করি নামথিং পোখরির উদ্দেশে। পৌঁছলাম যখন সেখানে, নিস্তব্ধতা যেন গিলে খাচ্ছে। মনে হচ্ছে, এখনই যেন ‘লেক প্লাসিড’ সিনেমার কুমিরটার মতো বিরাট একটা কুমির ঝপ করে উঠে আসবে।

Advertisement

তিন দিক জঙ্গলে ঘেরা লেকের জলে এই বিকেল-সন্ধেতেই মেঘ-কুয়াশার ভালবাসাবাসি। বেশ একটা গা ছমছমে ভাব। লেকের পাশে ঘুরতে ঘুরতে নানা ধরনের গেছো ব্যাং, ফড়িং আর গাছের গুঁড়ির নীচে লুকিয়ে থাকা স্যালাম্যান্ডার নজরে এল। ফিরতি পথে হোমস্টের কাছাকাছি যখন, গায়ে-মাথায় দু’-চার ফোঁটা জল। একটু পা চালিয়ে হোমস্টের বারান্দায়। সদ্য স্নান সারা যুবতী মেঘেরা চুল মেলে দিয়েছে লাটপাঞ্চারের শরীরে। তাদের চুল বেয়ে ঝরে পড়া জলে মিশল আকাশের অভিমান অনায়াস আগল ভেঙে। বারান্দার চেয়ারে, সে দিক পানে চেয়ে কত ক্ষণ যে বসে ছিলাম...।

হর্নবিল

রাতে এক বার ঘুম ভেঙেছিল। ঘড়ি বলছিল প্রায় ভোর চারটে। বৃষ্টি থেমেছিল। রাতজাগা পাখি এক, ডানা ঝাপটাল। তার ডানায় ছড়িয়ে যাওয়া শিশিরের শব্দ। কালিঝোরা তার বুকে শেষ রাতের হিমকে ভালবাসার ওম দিচ্ছে। নীচে সিঙ্কোনা প্লান্টেশনের অফিসে ঘণ্টা বাজছে। রাস্তায় দু’-একটা লোক।

নামথিং পোখরির লেক।

গতকাল বৃষ্টির পর আজ রোদ উঠেছে। বেশ একটা চনমনে ভাব। একটা আমেজ নিয়ে আজ চলার শুরু। মহানন্দা অরণ্যের ভিতর দিয়ে বনবিভাগের অফিস, বাংলো পার হয়ে অজস্র ছোট বাঁশ, পাইন, অর্কিড, সিঙ্কোনা আর এলাচ গাছের ভিড় সরিয়ে পায়ে চলা। নানা রকমের মিনিভেট, বুলবুল, কাঠঠোকরা, ম্যাগপাই, লংটেইলড ব্রডবিল, শ্রাইক... এদের ডাকে সরগরম গোটা পথ। ছটফটে প্রজাপতি... দু’-চারটে জোঁক... নানা রঙের ছত্রাক... এ অরণ্যে হারিয়ে যেতে হয়। আজ ‘হর্নবিল নেস্ট’-এর খোঁজে চলেছি, জঙ্গলের আরও ভিতরে। গাছপালার হাজার হাজার ডাল, পাতা, ঝুলে থাকা মস, কালচে সবুজ অন্ধকার, ধূসর পটভূমি— কী দারুণ এক কম্পোজিশন তৈরি করেছে, আর ফ্রেমিং...! হরেক কিসিমের মাকড়সা, তাদের সুন্দর করে বোনা জাল... এদের মাঝ দিয়ে যেখানে গিয়ে থামলাম, সেখান থেকে সামনে কিছু দূরে একটা বড় গাছ। তার কোটরে ধনেশ পাখি বাসা বানিয়েছে। ‘রুফোস নেকড হর্নবিল’-এর দেখা না পেলেও ‘পায়েড হর্নবিল’-এর দেখা মেলে। লাটপাঞ্চারে থাকতে থাকতে এ সব দেখার মাঝেও আপনি দেখে নিতে পারেন অহলদাড়া, লাটকুঠি, পাঁচপোখরি, সামসারি দাড়া আর লেপচা মনাস্ট্রি।

রাস্তার ধারে উড়ে বেড়ানো প্রজাপতি।

আরও পড়ুন: দাওয়াইপানি, গোটা গ্রামটাই যেন কাঞ্চনজঙ্ঘার ভিউপয়েন্ট

সারাদিন প্রচুর হাঁটাহাঁটির পর ক্লান্ত দেহ আর সতেজ মন নিয়ে হোমস্টের বারান্দার চেয়ারে গা এলিয়ে দিই। ডানা মোড়া নরম হলুদ পাখির মতো শেষ বিকেলের আলোটা। দূরে ধনেশটা এক বার ডেকে উঠল জঙ্গলের নাম ধরে। অন্ধকার গাঢ় হল, ধীরে। চাঁদভাসি রাত। আমি তাকিয়ে রইলাম সে আলোর দিকে... হারিয়ে যেতেই থাকলাম... নিজেকে ফিরে পাওয়ার অসম্পূর্ণতা বোধহয় এ জঙ্গলে রয়েই গেল...।

আরও পড়ুন: রাণা কুম্ভের কেল্লায়

কী ভাবে যাবেন: কলকাতা-এন জে পি ট্রেন অথবা বাসে। শিলিগুড়ি থেকে সরাসরি গাড়ি নিয়ে যেতে পারেন। দূরত্ব কমবেশি ৪৮ কিমি। কিংবা শিলিগুড়ির বিশাল সিনেমার কাছ থেকে শেয়ার জিপে লাটপাঞ্চার।

আরও পড়ুন: বেড়াতে গিয়ে নিজের সুরক্ষা আগে সুনিশ্চিত করুন

কখন যাবেন: অক্টোবর থেকে এপ্রিল সব থেকে ভাল সময়। মার্চ মাস নাগাদ হর্নবিলরা বাসা বাঁধে। স্যালাম্যান্ডার বেশি পাওয়া যায় জুন থেকে অক্টোবর।

কোথায় থাকবেন ও যোগাযোগ: ১) হামরো হোম অহলদাড়া (৯৭৩৩০৭১৭১৬), ২) গুরুং হোমস্টে বা লাটপাঞ্চার হোমস্টে (৯৮৩০১৫২১৬৯, ৯৮৩০৩৮১৩০৬, ৯৮৩১৩১১৬০৬, ৯৮৩০৬১৯৪২২, ৯৪৭৫৯৫৯৯৭৪), ই মেল: padamgurung591@gmail.com, ৩) হর্নবিল হোমস্টে (৯৪৭৫৯৫৯৯৭৪), ৪) গেয়লেথার বিক্রম রাই বিশেষ হোমস্টে (৯৫৯৩১৯৩৫১৮), ৫) ট্রাভেল মঙ্ক, কলকাতা (৮৯০২২৩২৫৫৯)

ছবি: লেখক

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement