বাঙালির পুজোর ছুটিতে বেড়াতে যাওয়ার অভ্যেস বহুদিনের। এদের মধ্যে একদল ভরা পুজোয়, মানে ষষ্ঠী বা সপ্তমীর দিন বেরিয়ে পড়ে। আর একদল বেরয় পুজোর ঠিক পরে, দশমী কাটিয়ে। তবে যে দিনই বেরোক না কেন, তাদের বাড়িতে বেড়াতে যাওয়ার জল্পনা-কল্পনা চলে সারা বছর জুড়ে। সমুদ্র না পাহাড়, জঙ্গল না উপত্যকা, এই নিয়ে আলোচনা শুরু হয়ে যায় ইংরেজি বছরের শুরুতেই। আগে, হাতে গোনা একটি-দু’টি পত্রিকা বেরলেও এখন কিন্তু বাংলা ভ্রমণ পত্রিকার কোনও অভাব নেই। তাতে নানান জায়গার ছবি দিয়ে, কী ভাবে সেখানে যাওয়া যাবে, গিয়ে কোথায় ওঠা যাবে, কোথায় কী খাওয়া যাবে, এ সবের সবিস্তার বিবরণ দেওয়া থাকে। দেওয়া থাকে বেড়ানোর আদর্শ সিজন। এ ছাড়া এখন ইন্টারনেটের সুবাদে এই খোঁজখবরগুলো নেওয়া তো জলভাত হয়ে গিয়েছে।
এখন যেমন মধ্যবিত্ত গেরস্তরাও, পাঁচ-ছ’মাস আগে কেটে নেওয়ার সুবিধে নিয়ে প্লেনের টিকিট বুক করে ফ্যালে, বছর পনেরো আগেও সেটা কিন্তু আকাশকুসুম ছিল। তখন তাদের বেড়ানোর প্রধান ভরসা ছিল কু-ঝিক-ঝিক রেলগাড়ি। দূরপাল্লার বাসও ছিল, কিন্তু সপরিবার ভ্রমণে বাঙালিরা এখনও যেন তাদের ঠিক আপন করে নিতে পারেনি। তখন গেরস্তরা বেড়াতে যেত ট্রেনের স্লিপার ক্লাসে, এসি-টেসিতে নয়। তাতে লোহার সিঁড়ি বেয়ে বাঙ্ক-এ ওঠার সময় মনের মধ্যেটা যেন শিরশির করে উঠত। সেই সব পুরনো ট্রেনের কামরায় থাকত লালচে ডুমের আলো আর লোহার জালে ঘেরা গোলপানা কয়েকখানা কালচে পাখা। রাত্তিরে সবাই যখন ঘুমোত, তখন ট্রেনের প্যাসেজের মাঝখানে কিছু নীলাভ ল্যাম্প ঝিমঝিম করে জ্বলত। সাইড-লোয়ার বার্থ পেলে তার এক দিকের পার্টিশনে হেলান দিয়ে বসে, জানলা দিয়ে ছুটে আসা ঠান্ডা হাওয়ার ঝাপটা খেতে খেতে, ট্রেনের ঘুমন্ত প্যাসেজটার দিকে তাকালে মনে হত যেন অচেনা কোনও স্পেসশিপে বসে আছি।
বেড়াতে যাওয়ার দিন ঠিক হওয়ার পর সবচেয়ে জরুরি কাজ ছিল সেখানকার এমন একটি ট্রেনের টিকিট কাটা যাতে নাইট জার্নি থাকবে। আমাদের ছেলেবেলায় ট্রেনের টিকিট পাওয়া যেত জার্নি ডেটের এক মাস আগে। তারপর সেটা দু’মাস হল। তারপর তিন মাস। এখন তো চার মাস আগে থাকতেই ট্রেনের টিকিট কেটে রাখতে হয়। যে নির্দিষ্ট দিনে টিকিট কাটবার কথা, সে দিন রাত থাকতে ঘুম থেকে উঠে সবাই ডালহৌসির কয়লাঘাটা টিকিট কাউন্টারে ছুটত। বাস থেকে নেমে হনহনিয়ে সেখানে ঢুকে হয়তো দেখা যেত, আগে থাকতে জনা পনেরো লোক সেই লাইনে দাঁড়িয়ে হাই তুলতে তুলতে আড়মোড়া ভাঙছে। মনে প্রশ্ন জাগত, এরা কি কাল রাতে এখানে ঘুমিয়েছিল নাকি রে বাবা!
টিকিট কাটার আগে একখানা সাদা খোপকাটা পাতায় যাদের টিকিট কাটা হবে তাদের নাম, ঠিকানা, বয়স, ট্রেনের নম্বর, কেমন বার্থ চাওয়া হচ্ছে, বেড়াতে যাওয়ার তারিখ— এই সব গোটা-গোটা করে লিখতে হত। ওই রকম একটি কাগজে ম্যাক্সিমাম চার জনের টিকিট কাটা যেত। চারটের বেশি টিকিট কাটতে হলে আবার সঙ্গে করে আর এক জনকে নিয়ে যেতে হত। যারা এই ভাবে দৌড়ঝাঁপ করে টিকিট কাটতে যেতে পারত না, আবার কন্ডাক্টেড ট্যুর পার্টির সঙ্গে ঘুরতে যেতেও যাদের অ্যালার্জি, তাদের জন্য ছিল বেশ কিছু ট্রাভেল এজেন্ট, যারা কিছু টাকার বিনিময়ে ট্রেনের কনফার্ম টিকিট কেটে দিত। পরবর্তীকালে অনলাইন ট্রেনের টিকিট কাটার ব্যবস্থা হওয়ায় এদের আরও সুবিধে হয়েছে।
ট্রেনের টিকিট কাটা হয়ে যাওয়ার পর এ বার থাকার জায়গা ঠিক করার পালা। আগে যৌথ পরিবারের সতেরো-আঠেরো জন যখন একসঙ্গে বেড়াতে যেত, তখন গোটা বাড়ি ভাড়া নেওয়ার রেওয়াজ ছিল। ছোট পরিবারওয়ালা গেরস্ত সবসময় চেষ্টা করত যদি কোনও ভাল হলিডে হোমের সন্ধান পাওয়া যায়। কারণ হলিডে হোমে ইচ্ছেমতো বাজার করে এনে নিজেরা রান্না করে খাওয়ার সুবিধে থাকে, ফলে বেড়ানোর খরচ অনেকটাই কমে যায়। হলিডে হোমের পর তার চয়েস ছিল গেস্ট হাউস বা ধর্মশালা। এ জন্য বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজন কোথাও বেড়াতে গেছে শুনলেই, সে কোথায় উঠেছে, এটা ভাল করে জেনে নিয়ে নোট করে রাখত। সমুদ্র বা পাহাড়ের কাছে গেলে, ঘরের জানলা দিয়ে তাদের দেখা যায় কি না এটাই ছিল ঘর বাছার প্রধান ক্রাইটেরিয়া।
আরও পড়ুন: বেড়াতে যাচ্ছেন? জেনে নিন নানা জায়গার খুঁটিনাটি
আর একটা জরুরি পয়েন্ট ছিল বাথরুম। বাঙালি গিন্নিরা শ্বশুরবাড়ির কমন কলতলা ব্যবহার করতে বাধ্য থাকলেও, বেড়াতে গিয়ে অন্য বোর্ডারদের সঙ্গে বাথরুম শেয়ার করতে কিছুতেই রাজি হত না। তখনও কম্পিউটরে পটাপট হলিডে হোমের ঘরের ভিডিও দেখানোর যুগ আসেনি। তাই বুকিংবাবুর অ্যালবামে ঘরের সঙ্গে বাথরুমেরও একটি করে রঙিন ছবি গুছিয়ে রাখা থাকত এবং তিনি গেরস্তকে সেটা দেখাতে দেখাতে, ‘দেকেচেন! কোথাও একফোঁটা শ্যাওলা জমে নেই!’ গোছের আশ্চর্য কিছু ডায়লগ ছুড়ে দিতেন। আর গেরস্ত বাড়ি ফিরে নিজের গিন্নির কাছে ওই একই ডায়লগ নিখুঁত ভাবে উগরে দিত।
ঘর বুকিং সমাধা হলে এ বার শুরু হত টুকটুক করে ব্যাগব্যাগাচি গুছিয়ে নেওয়ার পালা। আগে হোল্ডল নামক একটি আশ্চর্য জিনিস নিয়ে বাঙালি বেড়াতে যেতে অভ্যস্ত ছিল। হোল্ডল ছিল একই সঙ্গে কিছু দরকারি জিনিসপত্র নেওয়ার এবং খটখটে ট্রেনের বাঙ্ক-এ বিছানার মতো পেতে রাত্রিবেলায় ঘুমোবার একটি বোঁচকা বিশেষ, যাকে প্রয়োজনে সবসুদ্ধু গুটিয়ে ফ্যালা যায়। এর রং হত আর্মি গ্রিন। তবে এদের ঘাড়ে করে ঘুরতে হয়। এখনকার রুকস্যাকের মতো এদের পিঠে নিয়ে ঘোরবার কোনও ব্যবস্থা থাকে না। এরপর এল প্রাচীন তোরঙ্গের স্লিক মডেল, বাইশ ইঞ্চি বা চব্বিশ ইঞ্চির ফাইবার সুটকেস। তারপর সেই সুটকেসের সঙ্গে চাকা লাগিয়ে, তার কান ধরে রথের মতো গড়গড় করে টেনে নিয়ে যাওয়ার উপায় হল। আর এখন তো সবই পিঠ ব্যাগ। রুকস্যাক, ন্যাপস্যাক— এই সব। তো সে-যুগে ব্যাগে করে যা-ই নিয়ে যাওয়া হোক না কেন, বেরনোর আগের মাস দুয়েক ধরে তার মধ্যে একটু একটু করে দড়ি, ক্লিপ, হ্যাঙার, বিস্কুটের প্যাকেট, টর্চের ব্যাটারি, মোমবাতি-দেশলাই— এমন সব জরুরি জিনিস পুরে রাখা চলত। ফাইনালি, বেরবার দু’দিন আগে সব কিছু ভালমতো গুছিয়ে, তালা মেরে, তাকে জামা পরিয়ে দেওয়া হত।
আরও পড়ুন: উত্তরবঙ্গের অনাঘ্রাত পর্যটনক্ষেত্র বুংকুলুং-তুরুক-সেলফু
বেড়াতে যাওয়ার দিন সকাল থেকে সারা বাড়িতে যেন হইহই পড়ে যেত। সন্ধে বা রাতের ট্রেন হলে সবাই ট্রেনে উঠেই রাতের খাবার খেত, কারণ তার একটা আলাদা মজা ছিল। বাঙালির ট্রেন-ভ্রমণের কয়েকটি বাঁধাধরা মেনু ছিল। হয় লাল আটার নরম পরোটা এবং আলুভাজা আর তা-নইলে সাদা ময়দার ন্যাদনেদে লুচি, কালোজিরে আর চেরা কাঁচালঙ্কা ছড়ানো ধবধবে আলুছেঁচকি। আর শেষপাতে অবশ্যই গিরিশ কিংবা নকুড়ের কড়াপাকের সাদা গুলি সন্দেশ। এখানে অবশ্যই যেটা বলার, ট্রেনের লুচির ময়দাটি সবসময় ফুটন্ত গরমজলেই মাখা হত, ফলে তা পরের দিন সকাল অবধি নরম তুসতুসে থাকত। মনোলোভা খাবার তো বাড়িতে আমরা কতই খাই, কিন্তু ট্রেনের দুলুনির মধ্যে বসে যে খাওয়া, তার বোধহয় কোনও তুলনা হয় না। সেই সব দিনে খাবার পরিবেশন করা হত কানায় খাঁজকাটা এক ধরনের শক্ত কাগজের থালায়। জল থাকত বড়সড় ওয়াটার বটলে, সবাই সেটা আলগোছে খেত। ছোটদের জন্য ছোট মাপের গ্লাস আনা হত। চা নিয়ে যাওয়া হত লম্বাটে রঙিন ফ্লাক্সে। খাওয়া শেষে ট্রেনের কলে ধুয়ে আসা হাত বাড়ি থেকে আনা একটি পরিষ্কার গামছায় মোছবার রেওয়াজ ছিল, কারণ টিস্যু পেপারের তখনও এত রমরমা হয়নি।
আগে ট্রেন জার্নিতে ছোটদের মধ্যে লুডো আর বড়দের তাস খেলার খুব চল ছিল। চল ছিল গানবাজনা করার। আমাদের যৌথ পরিবারের ভ্রমণে ট্রেনের কামরায় হারমোনিয়াম, বেহালা, তবলা সহযোগে গানবাজনা করার স্মৃতি আছে। মেয়েরা ট্রেনে টুকটাক বাংলা ম্যাগাজিন পড়তেন। ঘাড়-গুঁজে ইংরেজি নভেল পড়ার মতো যাত্রীরা বেশির ভাগই ছিলেন এসি কোচের সওয়ারি। ছোটরা কখনওই বাঙ্ক-এ একলা শুতো না। শুতো বাঙ্ক-এর ভেতরের দিকে, মা-জেঠিমার কোল ঘেঁষে। তাঁদের মুখে সমুদ্র বা পাহাড়ের গল্প শুনতে শুনতে আর দুলতে দুলতে তারা ফুলের মতো ঘুমিয়ে পড়ত। আর পর দিন ভোরে ঘুম থেকে উঠে দেখত, গতকাল রাতের গল্পটা কেমন ম্যাজিকের মতো সত্যি হয়ে গিয়েছে!
কার্টুন : দেবাশীষ দেব