রোববার শুধু আন্তর্জাতিক নারী দিবস নয়! আন্তর্জাতিক ব্যাটসম্যানদিবসও ছিল!
নইলে দু’টিমে মালিঙ্গা-জনসন-স্টার্ক থেকেও কখনও একদিনে প্রায় সাতশো রান ওঠে! নইলে ৫১ বলে সেঞ্চুরির মতো বিশ্বকাপ ইতিহাসে দ্বিতীয় দ্রুততম কীর্তিকে একটা সময় হারিয়ে দেওয়ার উপক্রম করতে পারে বিপক্ষ!
ক্রমাগত গুলিয়ে যাচ্ছিল এটা মজাদার, টেনশনহীন, ব্যাটিং প্রদর্শনীর চ্যারিটি? নাকি সত্যি বিশ্বকাপ টেবলের প্রচণ্ড তাৎপর্যপূর্ণ ম্যাচ? যেটা অস্ট্রেলিয়া ৬৪ রানে জিতে কোয়ার্টার ফাইনালে ডে’ভিলিয়ার্সদের সামনে পড়া এক রকম বাঁচিয়ে দিল। হার্শেল গিবসের টুইট খেলার পর দেখলাম। লিখেছেন, ২০০৬-এর স্মৃতি ফিরে আসছিল। জোহানেসবার্গে সে দিন অস্ট্রেলিয়ার চারশোর ওপর রান তাড়া করে দক্ষিণ আফ্রিকা জিতেছিল। এ দিন শ্রীলঙ্কা ইনিংস জুড়ে রানের বন্যা অব্যাহত থাকায় সেঞ্চুরিয়নের সেই দিন বারবার তুলনায় এসেই যাচ্ছিল।
কিন্তু সে সব ছাপিয়ে দুপুর-রাত জুড়ে এমন ঘোর হচ্ছিল যে শুকনো স্কোরলাইন কার মাথায় থাকে! ইতিহাসই বা কী করে রেখাপাত করে?
সবচেয়ে বেশি ঘোর তো অস্ট্রেলীয় ড্রেসিংরুমের দিকে এক ঝলক তাকালে। যেখানে আইসিসির একটা বিজ্ঞপ্তি এঁটে দেওয়া রয়েছে, এটা সংরক্ষিত এলাকা বলে। ঠিক তার ওপরেই তো তাঁর ছবি-সহ ব্রোঞ্জে খোদাই করা।
ফিলিপ হিউজ। ১৯৮৮—২০১৪।
বিশ্বখ্যাত বোলারদের যে পিচে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকত্ব দিয়ে রানের তুবড়ি উড়ছিল, তার দু’গজ পাশের উইকেটেই কি না বাউন্সার সামলাতে না পেরে মারা গিয়েছেন হিউজ। যাঁর স্মৃতিতে রোববারও অস্ট্রেলীয় অধিনায়ক কালো আর্মব্যান্ড পরে নামলেন। মার্চ দ্বিতীয় সপ্তাহের এই সিডনি আর কত তফাত হতে পারে শেষ নভেম্বরের এসসিজি থেকে? শ্রীলঙ্কার ৩৭৬ রান অবিশ্বাস্য তাড়া করে থেমে যাওয়ার অনেক আগেই আরও একটা ম্যাচের চিরন্তন স্কোরকার্ড বারবার অদৃশ্যে ফুটে উঠছিল।
শেষ ডিসেম্বরের এবিপি সাক্ষাৎকারে যে স্কোরবোর্ডের কথা কাঠ-কাঠ ভাবে বলে দিয়েছিলেন নিল হার্ভি। অপঘাত নয়। ফিল হিউজ ক বাউন্সার বো খারাপ টেকনিক ২৬! সিডনি উইকেটে বলের ঘায়ে মৃত্যু যে হাতে টানা রিকশায় চাপা পড়ার মতো এ দিন তা বারবার প্রমাণিত!
অস্ট্রেলিয়ার কাগজেপত্রে লেখা হয়ে চলেছে, চলতি বিশ্বকাপের ব্রাজিল হল ভারত। আর তার সমর্থকরা ব্রাজিলীয় সমর্থকদের মতোই অফুরন্ত প্রাণশক্তি ও উদ্যম আমদানি করেছেন গোটা টুর্নামেন্টে। রবিবাসরীয় সিডনি দেখার পর যোগ করতে বাধ্য হচ্ছি, আর্জেন্তিনা হল শ্রীলঙ্কা। চল্লিশ হাজারের মাঠে ব্যাটিংয়ের অবিরাম আলোকসজ্জায় তারা সঙ্গীত পরিচালনার দায়িত্বে ছিল। গত তিরিশ বছর ধরে যিনি লঙ্কান টিমের অঘোষিত ম্যাসকট হিসেবে বিরাজ করছেন, সেই পার্সি অভয়শেখর শুনলাম এ দিনও গ্যালারিতে ছিলেন। কিন্তু তাঁর এখন উপস্থিতি কুমার সঙ্গকারার ১০৭ বলে ১০৪ করার মতো! অসামান্য হয়েও আধুনিক সময়ের দাবি বিচারে প্রাগৈতিহাসিক।
এখন গ্লেন ম্যাক্সওয়েলদের যুগ। ৫১ বলে টাইফুনের মতো আছড়ে পড়া সেঞ্চুরির যুগ। সমর্থক হলে— লাইভ ব্রাস ব্যান্ডের যুগ! শ্রীলঙ্কা সমর্থকেরা শুরু করেছিলেন শঙ্খধ্বনি দিয়ে। তার পর সেই যে স্টিল ব্যান্ড শুরু হল, চলল মাইকেল ক্লার্কদের দ্বিতীয় হয়ে ‘এ’ গ্রুপ থেকে ওঠা নিশ্চিত হওয়া অবধি!
‘এ’ গ্রুপের দুই বনাম ‘বি’ গ্রুপের তিন। খুব সম্ভবত মিসবার পাকিস্তান পড়বে ক্লার্কদের সামনে। আর তাই যদি হয় এমন হলুদ আলোকসজ্জায় চোখ ধাঁধিয়ে যাওয়া উচিত সবুজের। কোথাও যেন অদৃশ্য গারদে আটকে ছিল অস্ট্রেলিয়া। রোববারের লঙ্কা-নিধন কারাগার থেকে তাদের বিনা জামিনে বার করে দিল।
কয়েদবাসী সবচেয়ে বেশি তো ছিলেন স্বয়ং অধিনায়ক! একে তো ব্যাট পেয়েছেন গোটা বিশ্বকাপে এর আগে ৩৭ মিনিট। তার ওপর অবিরাম খটাখটি নির্বাচকদের সঙ্গে। এ দিন টসেও একটা অদ্ভুত কথা বললেন যে, দলে বদল কেন হয়েছে, কী হয়েছে নির্বাচকদের ব্যাপার। আমি বলতে পারব না। ম্যাচ শেষে সাংবাদিক সম্মেলনে একহাত নিয়ে গেলেন স্বদেশীয় সাংবাদিকদের। বললেন, ওদের কাগজ বিক্রি করতে হবে। চ্যানেলকে কঠিন লড়াইয়ে জিততে হবে অন্য চ্যানেলের সঙ্গে। তাই আমার সম্পর্কে প্রচারকে এখন তাচ্ছিল্য করতে শিখে গিয়েছি। ভাবাই যায় না এমন কঠিন ম্যাচ জিতে উঠেও সাংবাদিকদের সামনে অধিনায়কের মেজাজ এতটা চড়ে থাকতে পারে!
নাকি ভাবা যায়? অস্ট্রেলিয়া ইনিংসকে শুরু থেকে মোটেও অধিনায়ক ধরেননি। ইনিংসের শুরুর দিকের কন্ডাক্টর ছিলেন তাঁর ডেপুটি। টিমে এখন যিনি বকলমে তাঁর প্রতিপক্ষ হয়ে উঠেছেন, স্টিভ স্মিথ। স্টিভ প্রথম শ্রীলঙ্কান স্পিনারদের ক্রিজ ছেড়ে বেরিয়ে আক্রমণ শুরু করেন। শুকনো উইকেটের জুজু তখনই অন্তর্হিত হয়ে যায়। এর পর ধরেন ক্লার্ক। অবিরত সিঙ্গলস নিয়ে নিয়ে বোলারদের লাইন নষ্ট করে দেন। একটা প্রশ্ন অবশ্যই থাকবে যে, তাঁর ইনিংসের শুরুতে কেন ক্লোজ ইন ফিল্ড বাড়াননি অ্যাঞ্জেলো? কেন সঙ্গকারাই বা লোক আনলেন না? কিপারের উইকেটের পিছনে ফিল্ড সাজানো এখন দস্তুর হয়ে গিয়েছে। কিন্তু সঙ্গকারা তো উইকেটের সামনেও দেখি ফিল্ডার বদলান। তিনি কেন বুঝলেন না সেনাপতি নড়বড়ে এই অবস্থায় অস্ট্রেলিয়াও সবচেয়ে নড়বড়ে? সেনাপতি গারদ থেকে বেরিয়ে গেল তো গোটা অস্ট্রেলিয়া স্বাধীনতা পেয়ে গেল বাকি বিশ্বকাপের জন্যও?
ম্যান অব দ্য ম্যাচ গ্লেন ম্যাক্সওয়েল। কিন্তু আবেগ, বিপন্নতা আর অন্তর্নিহিত অর্থ বিচারে এই ম্যাচের একটিই মানুষ! কেউ যদি সিডনির অস্ট্রেলিয়া বনাম শ্রীলঙ্কা এক দিনে ৬৮৮ রান ওঠা ম্যাচ নিয়ে টুইট করতে যায় তার হ্যাশট্যাগ করা উচিত— এম ক্লার্ক।
বিনোদনে সেরা অবশ্য অজি অধিনায়ক নন। অপ্রতিদ্বন্দ্বী ভাবে গ্লেন ম্যাক্সওয়েল। তাঁর ব্যাটিং দেখে আর্চি ম্যাকলারেনের সেই অমর মন্তব্য মনে পড়ে যাচ্ছিল। বিপক্ষ ব্যাটসম্যান ঝোড়ো সেঞ্চুরি করার পর ম্যাকলারেনকে বলা হয়েছিল, রক্ষণাত্মক ফিল্ড সাজাননি কেন? ম্যাকলারেন বলেছিলেন, তা হলে তো দর্শকদের মধ্যে দু’জনকে রাখতে হত। আজ শ্রীলঙ্কাও তাই বলতে পারত। ম্যাক্সওয়েল তো শুধু পাওয়ার-হিটার নন, সব রকম শট খেলেন। পিটারসেনের মতো সুইচ হিট, রিভার্স সুইপ, উঁচু ড্রাইভ, স্লোয়ার পুল, কাট। তাঁকে বৃত্তের মধ্যে চার জন ফিল্ডার রেখে বল করাটা কলকাতার সেরা ফুচকা বিক্রেতার কাছে একটা ফুচকা খেয়ে ছেড়ে দেওয়ার চেয়েও অনেক কঠিন!
সঙ্গকারা প্রাণপণ লড়েছিলেন। যত দিন যাচ্ছে তত তেন্ডুলকরের পাশে উপমহাদেশীয় ক্রিকেটের মিনার হিসেবে তিনি হাজির হচ্ছেন। টেস্ট গড় তো সচিনের চেয়েও ভাল। কিন্তু ম্যাক্সওয়েলদের খেলা ষণ্ডামির ক্রিকেট। বেহালার সুর যত মধুরই হোক, ষণ্ডামি কী করে আটকাবে।
শ্রীলঙ্কা ম্যাচ জিতলে ভারতের একটা বড় ফাঁড়া বাঁচত। তাই বোধহয় হ্যামিলটনে বসে ইন্ডিয়ান টিম এত মনযোগ দিয়ে ম্যাচ দেখছিল। এখন যা দাঁড়াল কোয়ার্টার ফাইনাল জিতলেও সিডনির সেমিফাইনালে তারা মুখোমুখি হবে পাক-অস্ট্রেলিয়া ম্যাচের বিজয়ীর সঙ্গে। অঙ্কের হিসেবে অস্ট্রেলিয়া। যাদের কাছে গোটা গ্রীষ্মে একটা ম্যাচও বার করতে পারেনি।
দুগ্গা দুগ্গা।
মৃত্যুতে জন্ম
ঠিক একশো দিন আগে এই মাঠেই ঘটেছিল সেই ট্র্যাজিক ঘটনা। এসসিজিতে অস্ট্রেলীয় ড্রেসিংরুমের বাইরের দেওয়ালে রয়েছে তাঁর স্মৃতি ফলক। যেখানে লেখা ফিলিপ হিউজ। ১৯৮৮-২০১৪। সেই মাঠেই নতুন প্রজন্মের হেলমেট পরে রবিবার ব্যাট করতে দেখা গেল কুমার সঙ্গকারাকে। যে হেলমেট তৈরি হয়েছে হিউজের মৃত্যুর পর। এ রকম দুর্ঘটনার হাত থেকে ব্যাটসম্যানদের বাঁচাতে। পোশাকি নাম মাসুরি হেলমেট। হেলমেটের দু’পাশে আলাদা সুরক্ষা ব্যবস্থা রয়েছে। যাতে ব্যাটসম্যানের ঘাড়ের দু’পাশ অক্ষত থাকে। অস্ট্রেলীয় বোর্ড এই হেলমেটের কথা আগে জানালেও আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে যা নিয়ে আসলেন সঙ্গকারা।
সংক্ষিপ্ত স্কোর
অস্ট্রেলিয়া ৩৭৬-৯ (ম্যাক্সওয়েল ১০২, স্মিথ ৭২, ক্লার্ক ৬৮)।
শ্রীলঙ্কা ৪৬.২ ওভারে ৩১২ (সঙ্গকারা ১০৪, দিলশান ৬২। ফকনার ৩-৪৮)।