ব্যাঘ্র-গর্জন। সোমবার। ছবি: রয়টার্স।
যে যা পারছে, নিমেষে তুলে নিচ্ছে। ঘটি, বাটি, গামলা— যা পাওয়া যায়! ওগুলো নিতে রাস্তায় নামতে হবে, বাজাতে হবে আজ রাত পর্যন্ত! ঢাক-ঢোল নেই? ধুর। ঘটি-বাটিই তো জয়ের বাদ্যযন্ত্র!
অলিগলি দিয়ে এক নয়, দুই নয়, বেরোচ্ছে এখন শ’য়ে-শ’য়ে। কুচকুচে কালো মাথার প্লাবনে ভাল করে দেখা যায় না কিছু। ওরা সব ব্রাহ্মণবেড়িয়ার, ওরা এখন সব রাস্তায়। কেউ বাইকে, কেউ হেঁটে। ওরা রাজপথে যাকে পাচ্ছে, মিষ্টি খাওয়াচ্ছে, জড়িয়ে ধরছে। আতসবাজির রঙে রাঙিয়ে দিচ্ছে বসন্তের আকাশ।
মাশরফি মতুর্জার মা হামিদা মর্তুজা গোটা জীবনে দিনটাকে ভুলতে পারবেন না। খবর পেলাম, টিমের ক্রিকেটার থেকে কোচ, সাপোর্ট স্টাফ, কর্মকর্তা— কাকে কাকে ধন্যবাদ দেওয়া যায় বুঝতে পারছেন না তিনি। ছেলের নেতৃত্বতে যে আজ দেশ প্রথম বার বিশ্বকাপ কোয়ার্টার ফাইনালে! আর ময়মনসিংহের মহম্মদ উবায়দুল্লাহ? গলা ধরে যাচ্ছে আবেগে, কথা শোনা যায় না চর্তুদিকের ঢোল-তবলার দুন্দুভিতে। ছাড়া-ছাড়া কানে ঢোকে কিছু শব্দবন্ধ, “অভিভূত, আমি অভিভূত..।” ওহ্, পরিচয়টা দেওয়া হয়নি। ইনি, মাহমুদুল্লাহ রিয়াদের বাবা! ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে অ্যাডিলেড ওভালে সেঞ্চুরি করা মাহমুদুল্লাহর বাবা!
দেখলে-শুনলে ঘোর লেগে যাবে। কলম চলবে না। কচি থেকে বুড়ো, ছাত্র থেকে শিক্ষক— কে নেই রাজধানীর রাজপথে আজ? খবর, পুরনো ফ্রেম সব ভিড় করছে একসঙ্গে, দাঁড়িয়ে পাশাপাশি। ঐতিহাসিক জয়ের পর সরকারের তরফে টিমকে কুড়ি লক্ষ টাকা পুরস্কার ঘোষণা হয়ে গেল। একটু পর রুবেল হোসেনকে উদ্দেশ্য করে এক অভিনেত্রীর ফেসবুক আপডেট— ‘আমি খুব খুশি। বাবু চালিয়ে যাও।’ ইনিই বিশ্বকাপের আগে রুবেলের বিরুদ্ধে ‘নিগ্রহে’-র অভিযোগ এনেছিলেন না? রুবেলকে তো তখন জেলেও যেতে হয়েছিল!
আসলে এই মুহূর্তে দেশটার মেজাজটাই এমন যে ব্যক্তিগত সমস্যা, রাজনৈতিক অস্থিরতা, কোনও কিছুই আর প্রাসঙ্গিক নয়। ঢাকা থেকে ফরিদপুর, টাঙ্গাইল থেকে নোয়াখালি সর্বত্র একটাই গর্জন উঠছে— বাংলাদেশ। বিশ্বমঞ্চে জাতীয় প্রতিনিধি বলতে একটাই জিনিস বুঝছে, মাশরফির নেতৃত্বাধীন এগারো বাঙালি। ভারত কোয়ার্টার ফাইনালে পড়বে কি না, পড়লে আট বছর আগের কাপ-ইতিহাসকে ফেরানো যাবে কি না, ভাবতেই চাইছে না কেউ। বরং মনে করছে, দেশ ছাড়ার আগে মহাতারকাদের বলে যাওয়া কথাগুলো।
এক মাস আগের শের-ই-বাংলা স্টেডিয়াম। মাশরফি মতুর্জা কথা বলছেন। বলছেন, বিশ্বকাপ কোয়ার্টার ফাইনাল খেলা লক্ষ্য নিয়ে আমরা কাল অস্ট্রেলিয়া যাচ্ছি। রুবেল এলেন একটু পর। বললেন, ভেবেছিলাম আমার ক্রিকেটার জীবন শেষ। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে ভাল দিন আসছে।
কানে বাজবে কথাগুলো। সে দিনের টেনশনাক্রান্ত অধিনায়ক আজ বিশ্বের সবচেয়ে সুখী ব্যক্তিত্বের অন্যতম। সে দিনের ‘খলনায়ক’ পেসার আজ চার উইকেট নেওয়া মহানায়ক। ব্যাঘ্রগর্জনে আজ নিহত ব্রিটিশ সিংহ।
পদ্মাপাড়ে জীবনের আজ একটাই রং। প্রিয়, অতি প্রিয় লাল-সবুজ!