Wriddhiman Saha

‘আর কত পরীক্ষা দিতে হবে? সেরা হয়েও কেন বার বার দলের বাইরে থাকবে ঋদ্ধি?’

ভাল পারফর্ম করেও কেন বার বার অবহেলিত থাকতে হবে প্রিয় ছাত্রকে? প্রশ্ন তুললেন জয়ন্ত ভৌমিক।

Advertisement

সৌরাংশু দেবনাথ

কলকাতা শেষ আপডেট: ০২ অগস্ট ২০২০ ১৩:৪৭
Share:

কেন ‘সুপারম্যান সাহা’ বার বার বঞ্চনার শিকার হবেন? ছবি: বিসিসিআই।

এক জন ক্রমাগত সুযোগ পেয়েই যাবেন। পারফরম্যান্স না করেও।

Advertisement

আর এক জন নিজেকে প্রমাণ করে, প্রশংসিত হয়েও থাকবেন বাইরে।

বৈষম্য, অবিচার, বঞ্চনা, অন্যায়! চুম্বকে এই শব্দগুলোই যেন উঠে আসছে।

Advertisement

প্রথম জন ঋষভ পন্থ। পরের জন অবধারিত ভাবেই ঋদ্ধিমান সাহা। কিন্তু এমন কেন ঘটবে, ঘটতেই থাকবে? ভাল পারফর্ম করেও কেন বার বার অবহেলিত থাকতে হবে প্রিয় ছাত্রকে? প্রশ্ন তুললেন জয়ন্ত ভৌমিক। ছোটবেলার কোচের প্রশ্ন, কেন অজস্র বার পরীক্ষায় বসতে হবে পাপালিকেই!

গত নভেম্বরের শেষে ইডেনে গোলাপি বলে দিন-রাতের টেস্টে শেষ বার আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে দেখা গিয়েছিল ঋদ্ধিকে। ক্রিকেটের নন্দনকাননে দুর্দান্ত কিপিংয়ে ‘সুপারম্যান সাহা’ ফের নজর কাড়েন ক্রিকেটমহলের। বিশ্বের সেরা কিপারদের তালিকায় উপরের দিকেই তিনি, রায় দেন ক্রিকেট পণ্ডিতরা। কিন্তু, কোনও এক রহস্যময় কারণে তার পরও জাতীয় দলের দরজা বন্ধই থেকে গিয়েছে। ইডেনের পর আরও দুটো টেস্ট খেলেছে ভারত। দুটোই নিউজিল্যান্ডে। লকডাউনের আগে সেই টেস্ট সিরিজে প্রথম এগারোয় জায়গা হয়নি তাঁর। কেন, এই প্রশ্নের উত্তর মেলেনি এখনও।

আরও খবর: বন্যা আক্রান্তদের জন্য বিরাট-ঋদ্ধিদের নিলাম

ক্রিকেটমহলে ‘ভাইদা’ নামেই পরিচিত জয়ন্ত ভৌমিক শিলিগুড়ি থেকে আনন্দবাজার ডিজিটালকে বললেন, “নিউজিল্যান্ডে ওকে সুযোগই দিল না! এটাই মানতে পারছি না। আমার মতে, যে কোনও ক্রিকেটারকে দলে সুযোগের ক্ষেত্রে ফিটনেস, পারফরম্যান্স ও ডিসিপ্লিন হল মাপকাঠি। ঋদ্ধি এর প্রতিটাতেই এগিয়ে। ও দারুণ ফিট, শেষ টেস্টে ইডেনে অসাধারণ খেলেছে। ফিটনেস, পারফরম্যান্সের পর ডিসিপ্লিন। মানে, দলের স্বার্থকে এগিয়ে রাখা। ঋদ্ধির ক্ষেত্রে এটা নিয়েও আলোচনার জায়গা নেই। তা হলে কেন বাদ পড়তে হল নিউজিল্যান্ডে? বয়সের কথা এ ক্ষেত্রে বিবেচ্য হতে পারে না। কার বয়স তিরিশের উপরে, কার বয়স কুড়ি-বাইশ, এগুলো ভাবা অর্থহীন। আরে, আমাদের বোর্ড প্রেসিডেন্ট সৌরভই তো বার বার বলে এসেছেন যে, বয়স একটা সংখ্যা মাত্র, পারফরম্যান্সই আসল। তা হলে ঋদ্ধির বয়স নিয়ে কেন ভাবতে হবে। পারফরম্যান্স করতে পারছে কি না, শুধু সেটাই দেখার কথা।”

ঋদ্ধির বয়স এখন ৩৫। ঋষভের ২২। তারুণ্য নীতি, সামনে তাকানোর জন্যই কি বাইরে বসতে হচ্ছে বঙ্গ কিপারকে? কোচের পাল্টা যুক্তি, “১৮ বছরের একটা ছেলে যা পারছে না, তা যদি ৩২ বছরের এক জন করতে পারে, আমি তো তাঁকেই ভাল বলব। আর ঋদ্ধি দলে আসছে সব রকম ফিটনেস পরীক্ষায় পাশ করে। ও কাজটা করতে পারছে কি না, আসল হল এটাই। ভারতের মতো এত বড় দেশে এই ধরনের লেভেলে কম্পিটিশন থাকবেই। নইলে আরও ভাল করার তাগিদ থাকবে না। তরুণদের উঠে আসা তাই দরকার। তবে তার পরেও যে যোগ্য, খেলাতে হবে তাঁকেই। এটায় আপোস হতে পারে না। বার বার কেন পরীক্ষায় বসতে হবে ঋদ্ধিকে, বুঝতে পারি না।”

গুরু-শিষ্য। জয়ন্ত ভৌমিকের সঙ্গে ঋদ্ধিমান সাহা। —নিজস্ব চিত্র।

দেখা যাচ্ছে বাউন্সি উইকেটে ঋষভের উপর ভরসা রাখা হচ্ছে। আর দেশের মাঠে ধুলোওড়া পিচে আস্থা দেখানো হচ্ছে ঋদ্ধির উপর। এটাও হজম করতে পারছেন না কোচ। তাঁর প্রশ্ন, “বিদেশে ও কি কিপিং করতে পারে না? বাউন্সি উইকেটে কি ওর কখনও সমস্যা হয়েছে? ঘূর্ণি উইকেটই হোক বা বাউন্সি, সবেতেই তো ওকে বিশ্বের সেরা কিপার বলা হচ্ছিল। উইকেটের পিছনে ওর যা সাফল্য সেটা তো কেউ অস্বীকার করতে পারবে না।”

ব্যাটিং কি কোথাও গিয়ে কাঁটা হয়ে ফুটছে কেরিয়ারে? বলা হচ্ছে, ঋষভ ব্যাট হাতে অনেক বেশি নির্ভরযোগ্য। জয়ন্ত ভৌমিক বললেন, “দেখুন, ঋদ্ধি হল উইকেটকিপার ব্যাটসম্যান। ও প্রথমে কিপার। কিন্তু, ব্যাট হাতে ও দলকে ভরসা দেয়নি এমন নয়। ব্যাটিং অর্ডার ঠিক থাকেনি কখনও। তার পরও দলের বিপদে লোয়ার অর্ডারকে সঙ্গে নিয়ে ও রান করে গিয়েছে। লক্ষ্য করলে দেখবেন, টেস্টে ওর রানগুলো এসেছে প্রতিকূলতার মধ্যে। প্রথম দিকে উইকেট পড়ে যাওয়ার পর ও টেনেছে দলকে। ওয়েস্ট ইন্ডিজে সেঞ্চুরিটাই দেখুন না। আর ঘরোয়া ক্রিকেটেও ব্যাটিং অর্ডার ঠিক থাকেনি। যে কোনও জায়গায়, যে কোনও কন্ডিশনে নেমে রান করেছে। আইপিএলেও তাই। যে বার আইপিএল ফাইনালে সেঞ্চুরি করল, সে বারও ব্যাটিং অর্ডার ঠিক ছিল না। দ্রুত উইকেট পড়লে ওকে তিনে নামানো হত। না হলে নামত পরে। ঋদ্ধি সাদা বলের ক্রিকেটে পারবে না, এটা কেন বলা হয় বুঝি না। আইপিএল ফাইনালের সেঞ্চুরিতেই তো প্রমাণিত যে ঋদ্ধি মারতে পারে। সব ফরম্যাটেই যোগ্যতা রয়েছে ওর। সুযোগ দিয়ে দেখা হোক না এক বার।”

দেখা গিয়েছে যে, কেরিয়ারে কখনও পারফরম্যান্সের জন্য বাদ পড়তে হয়নি। বরং চোটের জন্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে কেরিয়ার। যুক্তি অনুসারে, চোট সারিয়ে ওঠার পর তো এমনিতেই প্রথম এগারোয় ফেরার কথা। জয়ন্ত ভৌমিক সেই দাবিই তুলছেন। বললেন, “দেখুন, ঋষভ পন্থ খারাপ, এটা বলছি না। ও ভাল। কিন্তু আমাকে তো এক জনকেই খেলাতে হবে। তখন সেরাকেই বেছে নিতে হবে। আর চোটের জন্য সমস্যা হয়েছে, পিছিয়ে পড়েছে ঋদ্ধি। পারফরম্যান্সের জন্য কিন্তু কখনও বাদ দিতে হয়নি।”

আরও খবর: দর্শক রেখে ম্যাচ করার পরিকল্পনা মরুদেশের কর্তাদের

করোনাভাইরাসের কারণে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে এখনও অনুশীলন শুরু করতে পারেননি ঋদ্ধি। জিম, শরীরচর্চা যদিও চলছে। ব্যাট হাতে শ্যাডোও থাকছে প্র্যাকটিসের মেনুতে। তবে সবচেয়ে বেশি থাকছে মানসিক ভাবে তরতাজা থাকার সাধনা। কোচের কথায়, “ঋদ্ধির মনের জোরকে আমি প্রশংসা করি। ওকে তো শুধু মাঠের লড়াই লড়তে হয় না। তার বাইরেও অনেক কিছু থাকে। কতটা চাপ ওর উপর, সেটা ভাবলেই বুঝতে পারবেন। ও কিন্তু এগুলো নিয়ে কথা বলতে চায় না। চুপচাপ থাকে। দেশের মাঠে পারফরম্যান্সের পরও বিদেশে বসতে হওয়ার যন্ত্রণা সহ্য করতে হয়েছে। নিজেকেই বুস্ট আপ করতে হয়েছে তার পর। আমি অবশ্য নিয়মিত কথা বলি। ওকে বলি যে, এটা খেলার অঙ্গ। আমাদের কারও কিছু করার নেই। ছেড়ে দিলে তো হয়েই গেল। ছাড়ার কোনও প্রশ্নই নেই! আর রাজনীতি থেকে বিনোদন, সব পর্যায়ে, সব কাজেই এগুলো থাকবে। খেলাতেও থাকবে। উঁচুতে উঠলে ব্যাক-বাইটিং থাকবেই। ও বলে, ‘না আমি স্ট্রং আছি।’ কিন্তু কাজটা তো সোজা নয়। মনের জোর সব সময় রাখা যায় না। কত রকমের লড়াই করে ও নিজেকে ঠিক রাখে, সেটাই ভাবি মাঝে মাঝে।”

কোথায় ঋদ্ধি কিপার হিসেবে বাকিদের থেকে আলাদা? কোচের বিশ্লেষণ, “এই তো ইংল্যান্ড বনাম ওয়েস্ট ইন্ডিজের টেস্ট দেখছিলাম। দেখলাম, দুই দলের কিপারই বাই দিচ্ছে, বল ফস্কাচ্ছে, লাফিয়ে ধরছে। ভাবছিলাম যে এগুলো পাপালি অনায়াসে রিচ করে ফেলবে। আসলে ওর ফুটওয়ার্ক এত ভাল যে চেহারা ছোটখাট হলেও ঠিক পৌঁছে যায়। যেগুলো অন্যরা ঝাঁপ দিয়ে ধরার চেষ্টা করে, সেগুলো ও ফুটওয়ার্কেই পৌঁছয়। কে কত দ্রুত, কার অনুমানক্ষমতা বেশি, এগুলোই তফাত গড়ে দেয়। মানে কঠিন কাজটাও সহজে করে তোলে ঋদ্ধি। এখানেই বাকিদের চেয়ে এগিয়ে।”

আইপিএল ফাইনালে সেঞ্চুরির পরও কেন সাদা বলের ক্রিকেটে ঋদ্ধির ব্যাটিং নিয়ে সংশয়, প্রশ্ন কোচের।—ফাইল চিত্র।

সামনে আইপিএল। কিন্তু আইপিএলেও তো সব সময় সুযোগ মেলেনি। বসিয়ে রাখা হয়েছে। ফলে, নিজেকে চেনানোর সুযোগ আমিরশাহিতে কতটা পাবেন, ধন্দ থাকছে। কোচের মতে, “যখন চেন্নাই ডেকে নিয়ে গেল, তখন সুযোগ মিলত না। যে ম্যাচে খেলত, ধোনি বলত, ‘আমি কি আর তোর মতো আউটফিল্ডে ফিল্ডিং করতে পারব? তুই বাইরে ফিল্ডিং কর।’ শুধু আইপিএল বা চেন্নাই সুপার কিংসের কথা নয়, বাংলার হয়েও তো দীপ দাশগুপ্ত খেলছিল বলে দেরিতে অভিষেক হয়েছে। আবার সানরাইজার্সের হয়েও যে কতটা সুযোগ পাবে কেউ জানে না। ইন্ডিয়া টিমেও ধোনির জন্য দীর্ঘ দিন স্কোয়াডে থেকেও বসতে হয়েছে বাইরে। ধোনি অবসর করার পরও তো নিয়মিত নয়। চোটও আছে। কপাল শুধু নয়, এর পিছনে অনেক রকম ব্যাপারও থাকে। সেটা আমি বলতে পারব না।”

সব ঠিকঠাক থাকলে বছরের শেষে অস্ট্রেলিয়ায় যাবে ভারত। কিন্তু, সেখানে কি টেস্ট সিরিজে সুযোগ মিলবে? জয়ন্ত ভৌমিক আশাবাদী, “যদি অস্ট্রেলিয়াতে না খেলানো হয়, তা হলে দুর্ভাগ্য। একটা কথাই শুধু মনে করাতে চাইব, নিউজিল্যান্ডেও তো খেলানো হয়নি ঋদ্ধিকে। ভারত হেরেছিল। অজস্র বাই হয়েছে, ব্যাটেও রান পায়নি ঋষভ। ভুলের পুনরাবৃত্তি করা কি উচিত?” থাকল জোরালো সওয়াল।

রক্তাক্ত, ক্ষত-বিক্ষত ‘সুপারম্যান সাহা’ কি বছরের শেষে পাবেন নিজেকে চেনানোর মঞ্চ? মেঘ সরিয়ে কেরিয়ারে কি পড়বে সোনালি রোদ? কে জানে! ক্রিকেট এমনিতেই অনিশ্চয়তার খেলা। আর ঋদ্ধিকে ঘিরে বঞ্চনার আবহ তো কেরিয়ার জুড়েই!

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement