রবিবার ব্রাজিল-সুইৎজারল্যান্ড ম্যাচে নেমার। ছবি: গেটি ইমেজেস
রাশিয়া বিশ্বকাপ চার দিনও গড়ায়নি। তার মধ্যেই রেফারির নানা সিদ্ধান্তে উত্তাল ফুটবল বিশ্ব।
ফিফার চালু করা নতুন প্রযুক্তি ভিডিয়ো অ্যাসিস্ট্যান্ট রেফারিদের (ভার) ক্ষমতা ও ব্যবহার নিয়েই উঠে গিয়েছে প্রশ্ন। রবিবার রাতে ব্রাজিল-সুইৎজারল্যান্ড ম্যাচের একটি বিতর্কিত গোল ও নেমার দ্য সিলভা স্যান্টোস (জুনিয়র)-কে জার্সি ধরে টেনে ফেলার পরেও রেফারিরা ঘটনাকে গুরুত্ব না দেওয়ায় তা আরও সামনে এসেছে।
অথচ রেফারি ব্রাজিলের বিরুদ্ধে সমতায় ফেরার জন্য স্টিভন জুবেরের করা গোলটা বাতিল করেননি। টিভি রিপ্লেতে দেখা গিয়েছে, সুইৎজারল্যান্ডের হয়ে গোল করার সময় জুবের কনুই দিয়ে ধাক্কা দিয়েছিলেন ব্রাজিলের স্টপার মিরান্দা ফিলহোকে। মেক্সিকান রেফারি সেসার র্যামোসের কাছে প্রতিবাদও করেছিলেন কুটিনহোরা। কিন্তু তিনি গুরুত্ব দেননি। এ বারের বিশ্বকাপে চালু হওয়া ভিডিয়ো অ্যাসিস্ট্যান্ট রেফারি (ভার) মাথা ঘামাননি। অথচ ওঁরা নিজে থেকেই কিন্তু হস্তক্ষেপ করতে পারতেন। রেফারির চোখ এড়িয়ে গেলেও টিভি মনিটররের সামনে বসে নানা কোণ থেকে দেখা ভারের তিন অতিরিক্ত রেফারির কাজই তো সেটা করা।
নেমারকে প্রথমার্ধে নিজেদের বক্সে দেখলাম জার্সি টেনে ফেলে দিলেন সুইৎজারল্যান্ডের এক ডিফেন্ডার। সেখানেও পেনাল্টির দাবি উঠেছিল। রেফারি গুরুত্ব দেননি। ‘ভার’ও চুপ। ফিফা রেফারি হিসেবে প্রায় এগারো বছর একশো আটটা আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলিয়েছি। ১৪টা ডার্বি খেলিয়েছি। অনেক চতুর, মারকুটে ফুটবলার সামলেছি। পেনাল্টি দিয়েছি, গোল বাতিল করেছি, লালকার্ড দেখিয়েছি। কিছু সিদ্ধান্ত নিয়ে বিতর্কও হয়েছে। আবার থেমেও গিয়েছে। কারণ ভুল করলেও রেফারিদের তা শোধরানোর ব্যবস্থা ছিল না। আমিও পারিনি।
আজ যে সব আধুনিক প্রযুক্তি রেফারিদের সাহায্য করছে তার কোনও সাহায্য তখন পাইনি। এমনকি, সহকারীর সঙ্গে যোগাযোগের ব্যবস্থাও ছিল না। এখন তো রেফারির কানে সারাক্ষণ রিলেও করতে পারেন ভিডিয়োর সামনে বসে থাকা সহকারীরা। সঙ্গে ফিফা চালু করেছে অত্যাধুনিক ‘ভার’।
ফিফার এই প্রচেষ্টা ভাল, কিন্তু প্রয়োগে বা নিয়মে অনেক ফাঁক থেকে যাচ্ছে। যেমন আমি মনে করি ১৯৮৬-তে আর্জেন্টিনা হয়তো চ্যাম্পিয়নই হতে পারত না ‘ভার’ নিয়ম চালু থাকলে। দিয়েগো মারাদোনার করা সেই বিখ্যাত ‘হ্যান্ড অব গড’ গোলটা ধরা পড়ে যেত। তবে প্রশ্ন হল, সে ক্ষেত্রে তো রেফারি বা ‘ভার’-এর সদস্যদের উদ্যোগ নিতে হত। প্রশ্নটা এখানেই। এখন যা নিয়ম তাতে টিভির সামনে বসে থাকা রেফারিরা কোনও সিদ্ধান্ত নিয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলেও রেফারিই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবেন। তিনি তা মানতেও পারেন, না-ও পারেন। তার চেয়েও বড় কথা হল, যাঁরা খেলছেন সেই ফুটবলারদের দাবিকে গুরুত্ব দেওয়াটাও নির্ভর করছে রেফারির উপর। এখানেই কিন্তু সব চেয়ে বড় সমস্যা। ক্রিকেট বা টেনিসে এটা কিন্তু হয় না। সেখানে আম্পায়ারের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে খেলোয়াড়রা পাল্টা আবেদন জানিয়ে ভিডিয়ো আম্পায়ারের সাহায্য চাইতে পারে। যেটাকে বলা হয় ‘রেফারেল’ প্রক্রিয়া। ভিডিয়ো আম্পায়ার যে সিদ্ধান্ত দেবেন, সেটা মেনে নিতে হয় মাঠের আম্পায়ারকেও। আমার মনে হয়, ফুটবলেও এই নিয়ম চালুকরা উচিত।
নেপথ্যে: এ ভাবেই নজর রাখা হয় খেলার ওপরে। ফাইল চিত্র
বিরাট কোহালি বা রজার ফেডেরাররা যে সুযোগ পান, তা পাওয়া উচিত নেমার, লিয়োনেল মেসিদেরও। রেফারির কোনও সিদ্ধান্ত নিয়ে যদি আপত্তি থাকে, তা হলে তাঁরাও ভিডিয়ো সহকারীর সাহায্য পেতে পারেন।
এক্ষেত্রে অবশ্য প্রশ্ন উঠতে পারে, ফুটবল গতির খেলা। নব্বই মিনিটেই ম্যাচ শেষ। বারবার নানা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফুটবলাররা আবেদন করলে ম্যাচই তো শেষ হবে না। আমার মত, সে ক্ষেত্রে তিন বা চার বার আবেদন করা যাবে, এই নিয়ম চালু হোক। তাতে সময় বাঁচবে। ঠিক যেমন নিয়ম রয়েছে ক্রিকেট বা টেনিসের ক্ষেত্রে।
শুনেছি এখন ৩০-৩৫টা টিভি ক্যামেরায় ম্যাচ দেখানো হয়। নানা কোণ থেকে নানা ভাবে ভিডিয়ো উঠছে। মাঠে যে দৃশ্য এক বার মাত্র দেখেন রেফারি। বাঁশি মুখে হাজার হাজার দর্শকের সামনে বাইশ জন ফুটবলারকে সামলাতে হয় তাঁকে। রেফারিও তো মানুষ। তাঁর কোনও একটা সিদ্ধান্ত ভুল হতেই পারে।
সব ডাক্তার যেমন সব রুগীকে বাঁচাতে পারেন না, রেফারিরা চেষ্টা করেও অনেক সময় নির্ভুল থাকতে পারেন না। সেকেন্ডের ভগ্নাংশের মধ্যে সিদ্ধান্ত নিতে হয়। ভুল হোক কেউ চায় না, তবু ভুল হয়ে যায়।
ফিফা ফুটবলারদের দাবিকে গুরুত্ব দিলে এবং প্রযুক্তিকে ঠিক ভাবে ব্যবহার করতে পারলে রেফারিরাই লাভবান হবে। জুবেরদের করা গোল নিয়ে বিতর্কও অনেক কমবে।