উচ্ছ্বাস: স্পাইডারম্যানও ব্রাজিলের। ছবি: এএফপি
সাতসকালেই বিশ্বকাপ নিয়ে কবিতাটা এসেছিল এসএমএসে। প্রেরক বেহালায় আমার পাড়ার এক আর্জেন্টিনা সমর্থক। তাতে লেখা, ‘জার্মান ফিরেছে, মেসিও ফিরেছে/রোনাল্ডোও গেছে ফিরিয়া/আজ রাতে নেমারও ফিরিবে/ ওচোয়ার কাছে হারিয়া।’ যা পড়ে হাসি সামলাতে পারিনি।
সোমবার সকালে আসা এই এসএমএসের পাল্টা জবাব পেলাম রাত সাড়ে ন’টায়। তাও সেটা বেহালায় নয়। হাওড়ার কদমতলায় কৈলাশ ব্যানার্জি লেনে, সরস্বতী ক্লাবের প্রাঙ্গনে। ব্রাজিলের ম্যাচ দেখতে গিয়ে। মেক্সিকোকে হারিয়ে ২-০ জয় দেখে ‘নেমার, নেমার’ বলে স্লোগান তুলছিল পুরো ক্লাব। তারই মাঝে ব্রাজিল সমর্থক অমিতাভ দাস দিলেন সেই কবিতার উত্তর। ভারতীয় জাদুঘরের কর্মী অমিতাভবাবু তালে তালে উদ্বাহু নৃত্য করতে করতেই বলছিলেন, ‘ভুলিয়া কেন যাচ্ছ তোমরা/নাম ব্রাজিল হল দেশটার/তিতে জানেন কী ভাবে করিবেন/বিশ্বকাপের শেষটা/যে ভাবে তাঁরা বিশ্বকাপ মোট জিতিয়াছে পাঁচবার/রুশ দেশেতে সেই লক্ষ্যেই/ গোল করছেন নেমার...।’
ব্রাজিলের জার্সি গায়ে পেলের দেশের আদ্যন্ত এই সমর্থকের কবিতা শুনে আরও বাড়ে উল্লাসের মাত্রা। ক্লাব প্রাঙ্গন জুড়ে সাম্বা ফুটবলের ভক্তদের হট্টমেলার মাঝে গোখেল মেমোরিয়াল স্কুলের ষষ্ঠ শ্রেণীর ছাত্রী অন্বেষা দাস এরই মধ্যে পরনের ব্রাজিল জার্সি দেখিয়ে বলে দেয়, ‘‘মেসি তো পারল না। তা দলবদল করে আজ ব্রাজিলের জার্সি পরে নিয়েছি। পাড়ার কাকুদের মতো আজ থেকে আমি নেমারের দলে।’’ যা শুনে হাত তালি দিয়ে ওঠে সমবয়সী অমৃতা দাস, সুতীর্থ দাসরা।
লাতিন আমেরিকার দেশের জন্য কলকাতার ব্রাজিল ভক্তদের এই উল্লাস দেখে পলকেই মনে পড়ে যায়, কলকাতায় ক্লাব ফুটবলে খেলা ডু, এদুয়ার্দো, ফিজিক্যাল ট্রেনার গার্সিয়ার কথা। যাঁরা এই পরিবেশ দেখতে পেলে বোধহয় লাফাতে শুরু করতেন। এঁদের খুব কাছ থেকে দেখার সুবাদেই জানি, ব্রাজিলীয়দের কাছে ফুটবলটা হল ধর্ম। আর ওঁদের ফুটবল নিয়ে ওঁরা প্রচণ্ড গর্বিত। ওঁদের থেকেই জেনেছি, ব্রাজিলীয়রা সবাই মনে করেন, এই গ্রহে ফুটবলটা সবচেয়ে ভাল খেলেন তাঁরাই। আর তাঁরা যখন ফুটবল খেলেন, সারা বিশ্ব তা মুগ্ধ হয়ে দেখে। কী কুক্ষণে গত বছর ইস্টবেঙ্গল ড্রেসিংরুমে গার্সিয়া আর এদুয়ার্দোকে বলেছিলাম, ‘‘তোমাদের ব্রাজিল আর আগের মতো খেলে না।’’ যেই না বলা তখনই উঠে চলে গেল দু’জনে। দু’দিন কথাই বলল না। রাশিয়া বিশ্বকাপে ব্রাজিল নিয়ে এমনই আবেগ দেখলাম হাওড়ার ৮৫ বছরের
এই ঐতিহ্যবাহী ক্লাবে।
বিশ্বকাপ প্রি-কোয়ার্টার ফাইনালে জার্সি গায়ে, মাথায় হলুদ-সবুজ ফেট্টি, পতাকা নিয়ে খেলা দেখতে বসে পড়েছিলেন পাড়ার আট থেকে আশি। গোটা ক্লাব হলুদ-সবুজ বেলুন, পতাকা দিয়ে সাজিয়েছেন ক্লাব সদস্য বিকাশ জায়সবাল, দেবায়ন দাস। ক্লাবের বর্ষীয়ান সদস্য বীরেন মান্না বলছিলেন, ‘‘সাতাত্তরে পেলের সেই কসমসের ম্যাচ ইডেনে বসে দেখেছি। ব্রাজিল ইজ ব্রাজিল। আমাদের এই ক্লাবটাই একটা ছোট্ট রিয়ো বা সাও পাওলো হয়ে যায় ব্রাজিল খেললে।’’
ম্যাচের শুরুতেই যখন মেক্সিকো ‘প্রেসিং ফুটবল’ খেলে আক্রমণের ঝড় তুলতে শুরু করেছিল ব্রাজিল রক্ষণে। তখনই দেখলাম বাঙালির সেই কুসংস্কারও রয়েছে সরস্বতী ক্লাবে। পাড়ার একমাত্র আর্জেন্টিনা সমর্থক কৃষ্ণেন্দু মুখোপাধ্যায়কে কিছুতেই ব্রাজিলের জার্সি পরতে দেবেন না ক্লাব সদস্য অভিজিৎ দাস, নিখিলরঞ্জন বসুরা। যুক্তি, তা হলেই নাকি নেমারদের খারাপ সময় ঝুপ করে নেমে পড়বে মাঠে।
প্রথমার্ধ যখন গোলশূন্য শেষ হল, তখন সরস্বতী ক্লাবের টিভির সামনে বসে দেখছিলাম উৎকণ্ঠায় ভরা মুখগুলোকে। আইএসএলে ব্রাজিলীয় বিশ্বকাপার ইলানো ব্লুমারের বিরুদ্ধে এটিকে রক্ষণ সামলেছি। সেই সুবাদে স্বল্প ধারণা আছে, ব্রাজিলীয়দের স্কিল, শারীরিক সক্ষমতা সম্পর্কে। অমিতাভবাবু জানতে চাইছিলেন, ব্রাজিলের হলটা কী? তাঁর প্রশ্ন, ‘‘পেলে-গ্যারিঞ্চা, রোমারিয়ো-বেবেতোদের মতো এই ব্রাজিল গোলের পর গোল করতে পারছে না কেন?’’ আদ্যন্ত এই ব্রাজিল সমর্থককে বোঝাচ্ছিলাম, পেলেদের সময়ের ফুটবলের সঙ্গে এই ফুটবলের তফাৎ অনেকটাই। আধুনিক ফুটবলে বিশ্বকাপে কোনও দলই বিপক্ষকে ফাঁকা জায়গা উপহার দেবে না। তা তৈরি করে নিতে হবে প্রান্ত বরাবর আক্রমণ শানিয়ে বা গোলের সামনে একাধিক পাস খেলে। যার ফলে তৈরি হবে সেই কাঙ্খিত ‘ওপেন স্পেস’। খুলে যাবে গোলের দরজা। তা ছাড়া প্রথম ম্যাচে সুইৎজ়ারল্যান্ডের বিরুদ্ধে বাদ দিলে আর কোনও ম্যাচে গোল খায়নি তিতের দল। গোল দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে গোল আটকানোর কাজটাও ভাল ভাবে করছেন থিয়াগো সিলভা, মিরান্দা, কাজ়িমিরোরা।
কিন্তু এই সব যুক্তি-তক্ক উড়ে গেল নেমার গোলটা করতেই। ক্লাব ঘরে তখন বেজে উঠল ভুভুজেলাও। একজনকে চেঁচিয়ে বলতে শুনলাম, ‘‘বিশ্বকাপে ছ’টা গোল হয়ে গেল নেমারের। ও কিন্তু মেসির মতো নাইজিরিয়ার বিরুদ্ধেই তিনটে গোল করেনি।’’ বুঝলাম এই টিপ্পনি কাদের জন্য ভেসে এল। আর ফির্মিনোকে দিয়ে নেমার দ্বিতীয় গোলটা করার পর খেলা শেষ হতেই একজন চেঁচিয়ে বললেন, ‘‘শেষ পঁচিশ ম্যাচের ১৯টাতে গোল খাইনি আমরা।’’
গোল করে ও করিয়ে ওচোয়াদের হারিয়ে কোয়ার্টার ফাইনালে ব্রাজিলকে নিয়ে গেলেন নেমার। হাওড়া আশাবাদী, ষষ্ঠ গোলের পরে এ বার ষষ্ঠ বিশ্বকাপটাও ব্রাজিলে নিয়ে ফিরবেন নেমার।