অপ্রতিরোধ্য: সুইডেনে ১৯৫৮ বিশ্বকাপে গ্যারিঞ্চার জাদু। ফাইল চিত্র
ফুটবল সম্রাট পেলের আত্মজীবনীর নাম ‘মাই লাইফ অ্যান্ড দ্য বিউটিফুল গেম’। ব্রাজিলের সেই ‘বিউটিফুল গেম’-কে আবার দৃষ্টিনন্দন করেছিলেন তিনি। পাউ গ্রান্দে-তে তাঁর কবরের উপরও যে লেখা রয়েছে সে কথা। সেখানে ফলকের গায়ে পর্তুগিজ ভাষায় জ্বলজ্বল করছে, ‘এখানে এমন একজন চিরনিদ্রায় শুয়ে রয়েছেন, যিনি মানুষের আনন্দ ছিলেন।’
কে তিনি?
তিনি ম্যানুয়েল ফ্রান্সিসকো ডস স্যান্টোস। বিশ্ব ফুটবলে সকলের প্রিয় গ্যারিঞ্চা। বাবা মদ্যপ, তিনিও মদে আসক্ত যৌবন থেকেই। দু’টি বিয়ের বাইরে একাধিক বিবাহ-বহির্ভূত সম্পর্ক, ১৪ সন্তানের বাবা, মাতাল হয়ে গাড়ি চালিয়ে গ্রেফতার—সব রয়েছে তাঁর জীবনপঞ্জিতে। আর শরীরের দিক থেকেও একাধিক প্রতিকূলতা। জন্ম থেকেই মেরুদণ্ড কিছুটা বাঁকা, বাঁ পা ডান পায়ের চেয়ে কয়েক ইঞ্চি ছোট। কিন্তু এই সব প্রতিকূলতা জয় করেই তিনি হয়েছিলেন ফুটবলের জাদুকর। চিলিতে ১৯৬২ বিশ্বকাপের নায়ক।
পেলে, জালমা স্যান্টোস, মারিও জাগালো, টোস্টাও, রিভেলিনো, জিকো, রোমারিও, রোনাল্ডো, নেমার—এই তারকাদের কাছেও তিনি কিংবদন্তি। গ্যারিঞ্চার ড্রিবলে এমনই ফুটবল-জাদু, যা দেখে ১৯৫৮-র বিশ্বকাপে শক্ত-সমর্থ রুশ ডিফেন্ডারও বলে ফেলেছিলেন, ‘‘ও কি রবার দিয়ে তৈরি? শরীর অতটা বাঁকিয়ে ড্রিবল করছে কী ভাবে?’’
উরুগুয়ের ফুটবল লেখক এদুয়ার্দো গ্যালিয়ানো আবার আরও এক ধাপ এগিয়ে বলেছেন, ‘‘গ্যারিঞ্চাকে মাঠে দেখলে মনে হত, ফুটবল মাঠটা যেন সার্কাসের রিং। বলটা ওর পোষা প্রাণী। তা দিয়ে ও যা খুশি তাই করে দেখায়। ফুটবলের চার্লি চ্যাপলিন।’’ যা মেনেছেন পেলেও।
মানবেন না-ই বা কেন? দু’পায়ে স্বর্গীয় ড্রিবলিং, বল যেন পায়ে আঠার মতো লেগে থাকে। তেমনই সাপের মতো শরীরটাকে বাঁকিয়ে-চুরিয়ে নেন। সঙ্গে গতি ও জোরালো শট। লুকানো তাস, রামধনুর মতো বাঁক খাওয়ানো ফ্রিকিক।
১৯৫৩ সালে বোটাফোগো ক্লাবে ফুটবলার হিসেবে ট্রায়াল দিতে গিয়েছিলেন গ্যারিঞ্চা। ব্রাজিলের রাইটব্যাক নিল্টন স্যান্টোস তখন খেলেন ওই ক্লাবে। দাপুটে ডিফেন্ডার। তাঁকে প্রথম দিনেই বোকা বানিয়ে দু’পায়ের মাঝখান দিয়ে বল বার করে নিয়ে গিয়েছিলেন।
১৯৫৮-র বিশ্বকাপের আগে ফিওরেন্তিনার মাঠে ইতালির বিরুদ্ধে গোলকিপারসহ পাঁচজনকে কাটিয়ে গোল করে এসেছিলেন। আটান্নর বিশ্বকাপে গ্যারিঞ্চার প্রথম ম্যাচ সোভিয়েত ইউনিয়নের (রাশিয়া) বিরুদ্ধে। ম্যাচ শুরুর আগে ডিডি আর ভাভা দলের নবাগত সদস্যকে চিন্তামুক্ত করতে গিয়ে তাজ্জব প্রশ্ন শুনলেন। ‘‘রুশ গোলকিপারের গোঁফটা চার্লি চ্যাপলিনের মতো না?’’
ম্যাচ শুরু হতেই গোটা বিশ্ব দেখল জাদু। প্রথম মিনিটেই ডানপ্রান্ত দিয়ে তিন জন রুশ ফুটবলারকে কাটিয়ে বল মারলেন পোস্টে। পরের মিনিটে দু’জনকে কাটিয়ে পেলেকে বাড়ালেন অব্যর্থ গোলের বল। রুশ রক্ষণ সে দিন কোনও ভাবে স্পর্শই করতে পারেননি গ্যারিঞ্চাকে। ব্রাজিল সে বার প্রথম বিশ্বকাপ জিতে বাড়ি ফিরেছিল পেলে-গ্যারিঞ্চার যুগলবন্দিতেই। ফাইনালে সুইডেনের বিরুদ্ধে ভাভাকে দিয়ে জোড়া গোল করিয়েছিলেন গ্যারিঞ্চাই।
চিলেতে বাষট্টির বিশ্বকাপের প্রধান চরিত্রই ছিলেন গ্যারিঞ্চা। কারণ দ্বিতীয় ম্যাচের পরেই গোটা টুর্নামেন্টে বসে গিয়েছিলেন পেলে। কোয়ার্টার ফাইনালে ইংল্যান্ড এবং সেমিফাইনালে চিলের বিরুদ্ধে জোড়া গোল করলেন। করালেনও। ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে বাঁক খাওয়ানো শটে এমন গোল করেছিলেন, যা দেখে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম লিখতে বাধ্য হয়, ‘সাপুড়ে যে ভাবে সাপকে বশ করে ফেলে, সে ভাবেই মন্ত্রমুগ্ধ করে গেলেন গ্যারিঞ্চা।’ সেমিফাইনালে চিলের বিরুদ্ধে মাথা গরম করায়, রেফারি ‘মার্চিং অর্ডার’ দিয়েছিলেন গ্যারিঞ্চাকে। কিন্তু বিশ্ব ফুটবলের এই কিংবদন্তি এতটাই বড় ফুটবলার ছিলেন যে ব্রাজিলের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট সরাসরি অনুরোধ করেন চিলে ও ফিফার প্রেসিডেন্টকে। শেষ পর্যন্ত ফাইনালে চেকোস্লোভাকিয়ার মাঠে নামেন গ্যারিঞ্চা। ব্রাজিলকে সে বার দ্বিতীয় বিশ্বকাপ দেওয়ার পাশাপাশি টুর্নামেন্টের সেরা ফুটবলার ও সর্বোচ্চ গোলদাতার পুরস্কারটাও নিয়ে গিয়েছিলেন গ্যারিঞ্চা।
ব্রাজিলের হয়ে তিনটি বিশ্বকাপে খেলেছেন। দেশের হয়ে ৫০ ম্যাচে ১২ গোল তাঁর। ১৯৭০ বিশ্বকাপে হাঙ্গেরির বিরুদ্ধে শেষ ম্যাচ ছাড়া আর কোনও দিন ব্রাজিলের জার্সি গায়ে হারেননি। আটান্নর বিশ্বকাপে গ্যারিঞ্চার বিরুদ্ধে খেলেছিলেন ওয়েলসের ডিফেন্ডার মেল হপকিন্স। সাধে কি তিনি বলেছিলেন, ‘‘পেলে বড় ফুটবলার। আর গ্যারিঞ্চা জাদুকর। পেলের চেয়েও অনেক বড় ফুটবলার গ্যারিঞ্চা।’’