‘কলকাতা নয়, মনে হচ্ছিল সাও পাওলোতেই আছি’

ক্লাবময় মুঠো মুঠো ব্রাজিল। দেওয়ালে নেমার দ্য সিলভা স্যান্টোস (জুনিয়র), থিয়াগো সিলভা, গ্যাব্রিয়েল জেসুসদের পোস্টার, কোলাজ।

Advertisement

শিশির ঘোষ

শেষ আপডেট: ২৩ জুন ২০১৮ ০৪:২৭
Share:

গো-ও-ও-ল: বেহালা চৌরাস্তার শীতলাতলা সঙ্ঘশ্রী ক্লাবে কোস্টা রিকার বিরুদ্ধে নেমারের গোলের পরে জয়োল্লাসের মুহূর্ত। খুদে ভক্তদের মাঝে উচ্ছ্বসিত ভারতীয় দলের প্রাক্তন তারকা শিশির ঘোষও। শুক্রবার বিকেলে। ছবি: সুদীপ্ত ভৌমিক

অফিস থেকে বেরিয়ে ব্রাজিল বনাম কোস্টা রিকা ম্যাচটা দেখতে চলে গিয়েছিলাম সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের পাড়ায়। বেহালা চৌরাস্তার সেই শীতলাতলা সঙ্ঘশ্রী ক্লাবে ঢুকেই মনে হল, কলকাতা নয়। এক টুকরো সাও পাওলো বা রিয়ো দে জেনেইরোতে এসেছি।

Advertisement

ক্লাবময় মুঠো মুঠো ব্রাজিল। দেওয়ালে নেমার দ্য সিলভা স্যান্টোস (জুনিয়র), থিয়াগো সিলভা, গ্যাব্রিয়েল জেসুসদের পোস্টার, কোলাজ। পেলের দেশের জাতীয় পতাকায় মুড়ে দেওয়া হয়েছে পুরো ক্লাবঘর। খেলা দেখতে ভিড় জমানো আট থেকে আটান্ন প্রত্যেকের গায়ে ব্রাজিলের জার্সি। পাড়ার বাচ্চা ছেলে-মেয়েরা গাল রাঙিয়ে রেখেছে সবুজ-হলুদ রঙে। ব্রাজিলীয় সংস্কৃতি মেনে হাজির ড্রাম, ঢাকের মতো বাদ্যযন্ত্র। টিভিতে নেমার, অ্যালিসনদের দেখা যেতেই বাজতে শুরু করল ড্রাম, ঢাক— দু’টোই। সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ব্রা-জি-ল, ব্রা-জি-ল চিৎকার। কলকাতার ব্রাজিল-ডেরায় বসে এই আবেগ-বিস্ফোরণ দেখে ঠাওর করতে পারছিলাম না কোথায় রয়েছি!

তিতে, কুটিনহো, নেমারদের নিয়ে কলকাতার এই স্বতঃস্ফুর্ত আবেগটাই পরের নব্বই মিনিটে ব্লটিং পেপারের মতো প্রায় শুষে নিতে চলেছিলেন কোস্টা রিকার কোচ রামিরেস অস্কার। তিতের দলকে বোতলবন্দি করতে তাঁর রণকৌশল ছিল গোলের সামনে পায়ের জঙ্গল তৈরি করা। আর তাই রক্ষণে পাঁচ জনের সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিলেন মাঝমাঠের চার জনকে। উপরে একা মার্কোস উরেনা।

Advertisement

৫-৪-১ ছকে কোস্টা রিকা কোচের লক্ষ্য ছিল দু’টি। এক, নিজেদের গোলের সামনে রক্ষণ ও মাঝমাঠ মিলিয়ে নয় জনের একটা পাঁচিল তৈরি করা। যেখানে ধাক্কা খাবে ব্রাজিলের আক্রমণের ‘সাম্বা-ঢেউ’। দুই, এই দেওয়ালে বল ধাক্কা খেলেই, তা ধরে চকিতে প্রতি-আক্রমণে ব্রাজিলের গোলমুখে হানা দেওয়া।

প্রথমার্ধে এই রণকৌশলেই উইলিয়ানদের গোলমুখী সব প্রচেষ্টা আটকে যাচ্ছিল। অস্কারের হাতে ছিল, সাম্বা ফুটবলকে ভোঁতা করার আরও একটা অস্ত্র। তিনি হলেন, কোস্টা রিকার গোলকিপার কেলর নাভাস। পাউলিনহোরা বিপক্ষের পায়ের জঙ্গল, রক্ষণের পাঁচিল টপকালেও তার পরেই আটকে যাচ্ছিলেন এই নাভাসের বিশ্বস্ত হাতে।

প্রথমার্ধের শেষে ফল ছিল ০-০। সঙ্ঘশ্রী ক্লাবের হাসিখুশি পরিবেশটাই বদলে গিয়েছিল এই সময়। বাচ্চা-বড় সকলের মুখ ভার। কেউ কেউ পারলে কেঁদেই ফেলেন। কেউ আবার ক্লাব ঘরে টাঙানো ঠাকুরের ছবির সামনে গিয়ে মাথা ঠুকছিলেন নেমারের একটা গোলের জন্য। উচ্ছ্বাসটা ফিরল নেদারল্যান্ডসের রেফারি বিয়র্ন কুইপার যখন পেনাল্টির নির্দেশ দিলেন দ্বিতীয়ার্ধে। গোটা ক্লাবটা যেন কোনও অদৃশ্য যাদুমন্ত্রে হঠাৎ জেগে উঠল। বাজতে শুরু করেল ঢাক-ড্রামও। কিন্তু প্রযুক্তির সাহায্য নিয়ে রেফারি সেই সিদ্ধান্ত নাকচ করতেই শ্মশানের স্তব্ধতা। মাটিতে সূচ পড়লেও যেন শব্দ শোনা যাবে।

কিন্তু সংযুক্ত সময়ে প্রথমে ফিলিপে কুটিনহো, তার পরে নেমার গোল করার পরে যে শব্দব্রহ্ম তৈরি হল, তা শুনে ক্লাবের পাশের ফ্ল্যাটের দিদি-বৌদিরাও বারান্দায় চলে এলেন জয়োল্লাসের চিৎকার শুনে। খেলা দেখতে আসা বড়দের কেউ কেউ আর আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে পারলেন না। নেমারের আগেই একে অপরকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়লেন।

উচ্ছ্বাস: সেন্ট পিটার্সবার্গে ব্রাজিলের জয়ের পরে গ্যালারিতে সাম্বা সুন্দরীরা। ছবি: রয়টার্স

খেলাটা দেখে আমার মাথায় আসছে রূপঙ্করের সেই গানটা। ‘এ তুমি কেমন তুমি, চোখের তারায় আয়না ধরো/এ কেমন কান্না তুমি আমায় যখন আদর করো...।’ নির্ধারিত সময়ে ম্যাচ বার হয়নি। সংযুক্ত সময়ে গোল করেছে ব্রাজিল। কিন্তু, তিতের দল শুক্রবার দেখাল, বলটা ব্রাজিলীয়দের হাসি-কান্না-উচ্ছ্বাসে আবেগে জড়িয়ে ধরে আদর করার বস্তু। প্রথমার্ধে গোল হয়নি। বিপক্ষ গোলের দরজা বন্ধ করে রেখেছে। এই পরিস্থিতিতে যে কোনও দল মুষড়ে পড়বে। ধাক্কা খাবে মনোবল। নেমাররা উল্টে প্রবল উৎসাহে দুই প্রান্তে ছড়িয়ে গেলেন। কোস্টা রিকা রক্ষণের ওই নয় জনের মানব-প্রাচীর ভাঙতে। দ্বিতীয়ার্ধে গোটা ম্যাচের দুই-তৃতীয়াংশ সময়ই বল ব্রাজিলের পায়ে। বিপক্ষ রক্ষণের সামনে চার-পাঁচ-ছ’টি-সাতটি পাস খেলে তৈরি করছিলেন ফাঁকা জায়গা। আর সেই পাস ‘ওয়াল পাস’ নয়। সব কোনাকুনি ও সামনের দিকে খেলছিলেন মার্সেলোরা।

খেলাটা দেখে আমার সেই বিরাশির তেলে সান্তানার ব্রাজিলের কথাও মনে এল। সেই সান্তানার পরে ব্রাজিলীয় ফুটবলে অনেক বড় বড় কোচ এসেছেন। লাজারোনি, কার্লোস আলবার্তো পাহিরা, মারিয়ো জাগালো, দুঙ্গা, স্কোলারি আরও কত নাম! কিন্তু ব্রাজিলের সেই হারানো সৌন্দর্যটা সেই বিরাশির পরে দেখতাম না। পেতাম না গোলের জন্য জিকো, সক্রেটিস, ফালকাওদের মতো সেই সাহসী চালগুলো। কোচ তিতে ব্রাজিলের সেই বিখ্যাত ‘জোগো বোনিতো’ (সুন্দর ফুটবল) ফিরিয়েছেন মার্সেলোদের এই দলে।

দ্বিতীয়ার্ধে গোল পাওয়ার জন্য বিপক্ষ রক্ষণের পিছনে ফাঁকা জায়গা ব্যবহার করতে হত। তিতে তাই উইলিয়ানকে বসিয়ে নামিয়ে দিলেন ডগলাস কোস্তাকে। ওঁর ‘বুলডোজার’-এর মতো এগিয়ে যাওয়াকে কাজে লাগাতে। শেষের দিকে দিলেন আরও একটি সাহসী চাল। পাউলিনহো বসে গিয়ে নামলেন ফির্মিনো। আক্রমণ আরও জোরদার করতে। লক্ষ্য করবেন আত্মবিশ্বাসটা। গোল হচ্ছে না মানে? গোল করতেই হবে। এ রকমই শরীরের ভাষা। যেমন আত্মবিশ্বাস, তেমন ইচ্ছাশক্তি। তেমনই তিতের ফুটবলার পরিবর্তন।

ফির্মিনোর হেড গ্যাব্রিয়েল জেসুস রিসিভ করতে না পারায় তা বেরিয়ে যাচ্ছিল। যা লক্ষ্য করে ছুটে এসে বল গোলে রাখলেন ফিলিপে কুটিনহো। তার পরে কোস্তা-নেমারের যুগলবন্দিতে দ্বিতীয় গোলটাও দুর্দান্ত।

সব শেষে নেমার ও পেনাল্টির সিদ্ধান্ত বদল। দ্বিতীয়ার্ধে একের বিরুদ্ধে এক পরিস্থিতিতে তিন বার বেরোতে দেখলাম নেমারকে। যেটা ভাল লাগল। গোল পাওয়ায় এ বার অনেক চনমনে থাকবেন। ব্রাজিল যত এগোবে, ততই ভয়ঙ্কর হবেন নেমার।

তবে মাঠে অভিনয় করার স্বভাবটা ছাড়তে হবে নেমারকে। টিভিতে দেখলাম পেনাল্টির ক্ষেত্রে বিপক্ষ ডিফেন্ডার ওঁর জার্সি এক মুহূর্তের জন্য টেনেছিলেন। নেমার সঠিক জায়গায় না থাকায় ভারসাম্য রাখতে পারেননি। যা মনিটরে দেখে রেফারি পেনাল্টির সিদ্ধান্ত বাতিল করলেন। প্রশ্ন এটাই, যদি এটা কোস্টা রিকার পক্ষে ফাউল হয়। তা হলে নেমারকে রেফারি কার্ড দেখালেন না কেন? এর উত্তর পেলাম না।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement