উল্লাস: গোল করার পরে উমতিতিকে (৫ নম্বর) ঘিরে উচ্ছ্বাস গ্রিজ়ম্যাম (৭ নম্বর), পোগবাদের (৬ নম্বর)। ১-০ জিতে বিশ্বকাপ ফাইনালে ফ্রান্স। ছবি: গেটি ইমেজেস
ম্যাচ শুরুর আগে দু’দলের খেলার সেরা মুহূর্তগুলো দেখানো হচ্ছিল স্টেডিয়ামের বড় পর্দায়।
দিদিয়ে দেশঁ যখন মাঠে ঢুকছেন, তখনই দেখানো হল সেই ছবিটা। বিশ্বকাপ হাতে দাঁড়িয়ে ফ্রান্স কোচ। উঁচু করে তুলে ধরেছেন ট্রফি। বড় পর্দায় তাঁকে দেখানোর সঙ্গে সঙ্গে পুরো স্টেডিয়ামে উচ্ছ্বাসের ঢেউ উঠল। দেশঁ হাসলেন। মাঠে তখন অনুশীলন করছিলেন ফ্রান্সের ফুটবলাররা। স্যামুয়েল উমতিতিকে ডেকে কিছু একটা বললেন ফ্রান্সের একমাত্র বিশ্বকাপ জয়ী অধিনায়ক। প্রেসবক্স থেকে বোঝা গেল না, ফ্রান্স কোচ তাঁর রক্ষণের অন্যতম স্তম্ভকে কী বললেন ছবি দেখিয়ে। হয়তো বলেছিলেন, ‘‘ওই ছবিটা আবার ফেরাতে হবে।’’
কী আশ্চর্য, সেই উমতিতির গোলেই ফ্রান্স পৌঁছে গেল রাশিয়া বিশ্বকাপের ফাইনালে। আঁতোয়া গ্রিজ়ম্যানের কর্নার থেকে বল পেয়ে গোলটা করার পরে উমতিতি নাচতে নাচতে চলে গেলেন ফ্রান্স সমর্থকরা যেখানে নাগাড়ে গান গেয়ে যাচ্ছিলেন। তার পর স্যালুটের ভঙ্গিতে ডান হাতটা কপালের উপরে রাখলেন। নাচটা তাঁর মজ্জাগত। কারণ আদতে উমতিতির জন্ম তো ক্যামেরুনেই। তাঁর পরিবার যখন পাততাড়ি গুটিয়ে চলে আসেন ফ্রান্সে, তখন উমতিতির বয়স পাঁচ। কিন্তু স্যালুটটা কাকে করলেন বার্সেলোনার স্টপার, বোঝা গেল না। তবে কিছুক্ষণ পরে এসেই তাঁকে দেখা গেল কোচকে জড়িয়ে ধরতে।
আরও পড়ুন: অশ্বমেধের ঘোড়া আটকে ফাইনালে ফরাসি ব্রিগেড
খেলা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দেশঁ পাগলের মতো দৌড়লেন মাঠের দিকে। পুরো রিজার্ভ বেঞ্চের সঙ্গে। দুটো হাত মুষ্টিবদ্ধ, আকাশের দিকে তুলে। তত ক্ষণে পুরো ফ্রান্স দল নাচতে শুরু করেছে উমতিতির সঙ্গে। আর গোলকিপার হুগো লরিস—বেলজিয়ামের একের পর এক নিশ্চিত গোল অসাধারণ দক্ষতায় রুখে দিয়ে তিনি দেখালেন, কুর্তোয়া নয়, তিনিই সেরা। উমতিতি আর দেশঁকে দেখা গেল অধিনায়ককে জড়িয়ে ধরে নাচতেও। আসলে উমতিতি যদি ফ্রান্সকে তৃতীয়বার ফাইনালে তোলার গঙ্গা হন, তা হলে লরিস ছিলেন ভগীরথ। সেন্ট পিটার্সবার্গের এই মাঠটার নাম জেনিথ এরিনা। জেনিথ এখানকার বিখ্যাত ফুটবল ক্লাব। রাশিয়ার লিগে তারা ইস্টবেঙ্গল বা মোহনবাগানের মতো। এই মাঠের বাইরে গিয়ে দাঁড়ালে দেখা যায় দু’টো দৃশ্য। এক) ফিনল্যান্ড উপসাগরের ঢেউ। দুই) প্রতি সেকেন্ডে বদলে যায় স্টেডিয়ামের রং। লাল, নীল, সবুজ, হলুদ। কত রং সেখানে। এ দিনের ম্যাচটারও তো রং বদল হল প্রতি মুহূর্তে। বিরতি পর্যন্ত দেখে মনে হচ্ছিল অঙ্ক কষা ফুটবলের আরও একটা ম্যাচ হতে চলেছে দুই কোচের সাবধানতায়। বিরতির পর সেখানেই সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো আক্রমণ, প্রতি-আক্রমণে উত্তাল। দু’টো উইং দিয়ে ফ্রান্স আক্রমণের ঢেউ তুলছিল গ্রিজ়ম্যান আর কিলিয়ান এমবাপেকে দিয়ে। উল্টোদিকেও বেলজিয়ামও নাকানি চোবানি খাওয়ালো ফ্রান্স রক্ষণকে। এডেন অ্যাজার, কেভিন দে ব্রুইন, রোমেলু লুকাকুরা একের পর এক আক্রমণের ঝড় তুললেন। ফলে বিরতির আগে রুক্ষ ফুটবল প্রাণ পেল শেষ পঁয়তাল্লিশ মিনিটে। সেটা একটাই যে খেলা শেষ হওয়ার পরও গানে গানে উত্তাল হয়ে উঠল স্টেডিয়াম। প্রেস বক্স থেকে দেখা যাচ্ছিল, বেলজিয়ামের লাল-হলুদ সমর্থকরা বসে আছেন ঠায়। কারও চোখে জল, কেউ শুয়ে পড়েছেন মাটিতে। বাড়ি যাওয়ার কোনও তাড়া নেই। রবের্তো মার্তিনেস তাঁদের স্বপ্নের ফেরিওয়ালা হয়ে এসেছিলেন ইতিহাস গড়তে। তা ধুলিসাৎ। অন্যদিকে ফ্রান্স সমর্থকেরা গান গাইছিলেন ব্রাজিল সমর্থকদের সঙ্গে একই গ্যালারিতে। সেই সমর্থকদের দলের পাশ দিয়ে বেরিয়ে গেলেন দেশঁ। নতুন এক মাইলস্টোন ছোঁয়ার দরজার সামনে তিনি। কোচ ও ফুটবলার হিসাবে বিশ্বকাপ জিততে তাঁর আর একটা ম্যাচেই সফল হতে হবে। তা হলেই তিনি বিশ্ব ফটবলের দুই কিংবদন্তি ফ্রানৎস বেকেনবাউয়ার আর মারিয়ো জ়াগালোর সঙ্গে একই আসনে জায়গা পেয়ে যাবেন।