আশাবাদী: তরুণ দলের উপর ভরসা দেশঁর। ফাইল চিত্র
গোটা কোচিং জীবনে দিদিয়ের দেশঁ কখনও ফাটকায় যাননি। কোচিং করানোর সময় তিনি সব সময় নিজস্ব নীতি মেনে চলেছেন। তার বেশিরভাগই গোঁড়া এবং রক্ষণাত্মক। তাঁর যে কোনও সিদ্ধান্তের পিছনেই দীর্ঘ ভাবনা-চিন্তা থাকে। তাড়াহুড়ো করে কখনও তিনি কিছু করেন না। সেটা ২০১৪ বিশ্বকাপ এবং ২০১৬ ইউরোতেও দেখা গিয়েছে। তাঁর কোচিংয়ে এই দুই টুর্নামেন্টেই ফ্রান্সের খেলায় নিজস্ব একটা স্টাইল ছিল। একটা ভাবনা ছিল।
২০১৮ বিশ্বকাপে ছবিটা আমূল পাল্টে গিয়েছে। এ বার সবাইকে অবাক করে দিয়ে, এমনকি দলের ফুটবলারদেরও বিস্মিত করে দেশঁ বিশ্বকাপ শুরু এক মাস আগে সব পাল্টে ফেলার সিদ্ধান্ত নেন। ম্যাচে নামার ছকও।
আয়ারল্যান্ডের বিরুদ্ধে ইউরো কাপের প্রি-কোয়ার্টার ম্যাচ থেকেই ৪-৪-২ ছক দেশঁর প্রিয়। গত দু’বছর তিনি এই ছক নিয়ে কাজ করে গিয়েছেন। দুই স্ট্রাইকার আঁতোয়া গ্রিজম্যান ও অলিভিয়ের জিহুর বোঝাপড়া আরও কী ভাবে বাড়ানো যায়, মাঝমাঠে চার মিডফিল্ডারের অবস্থান কী করে আরও কার্যকরী করে তোলা যায়, তা নিয়ে অক্লান্ত পরিশ্রম চালিয়ে গিয়েছেন দেশঁ। তবু শেষ মূহূর্তে হঠাৎ তাঁর মনে হল, বিশ্বকাপে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে শনিবার মাঠে নামার আগে এই ছক যথেষ্ট নয়। বদল দরকার।
কী সেই বদল?
ছক পাল্টে ফেলা। ৪-৩-১-২। ডায়মন্ড মিডফিল্ডের এই ছকে গ্রিজম্যানের অবস্থানও বদলে গেল। তিনি খেলবেন মিডফিল্ডার এবং দুই স্ট্রাইকারের মাঝে। বিশ্বকাপে নামার তিন সপ্তাহ আগে এমন একটা সিদ্ধান্তকে সাহসী তো বলতেই হবে। ঝুঁকি আছে, পাগলামিও হয়তো বলবেন কেউ কেউ।
কিন্তু কেন তিনি এই বদলটা আনতে গেলেন? সংবাদমাধ্যমের সামনে এখনও কারণ জানাননি দেশঁ। যখনই প্রশ্ন উঠেছে, এড়িয়ে গিয়েছেন। ‘‘কোচের মনে হয়েছে এই সিদ্ধান্তে দলের আরও ভাল হবে,’’ বললেন কিলিয়ান এমবাপে।
সম্ভবত নতুন ছক অনুযায়ী দলের ভারসাম্য আরও ভাল হতে পারে। তিন জন মিডফিল্ডার চার ডিফেন্ডারকে আরও বেশি সুরক্ষা দিতে পারবেন। এই ভাবনাটাই কাজ করেছে হয়তো। তাই রক্ষণের দিক থেকে এই ছক আরও কার্যকরী হতে পারে। কিন্তু গোল করার দিক থেকে কিন্তু একই কথা বলা যাচ্ছে না।
ফ্রান্স কিন্তু ৪-৪-২ ছকে খুব খারাপ খেলেনি। তা ছাড়া বেশির ভাগ ফুটবলারই এই ছকে খেলতে স্বচ্ছন্দ। গ্রিজম্যান এই ছকে আটলেটিকো মাদ্রিদে খেলেন। বার্সেলোনায় উসমান দেম্বেলেও তাই। টমাস লেমার, বেঞ্জামিন মেন্ডি, জিব্রিল সিদিবে, এমবাপে এক বছর আগে মোনাকোর হয়ে এই ছকে খেলেই লিগ জিতেছিলেন।
কয়েকটি সংবাদমাধ্যমে আবার প্রকাশ হয়েছে এই হঠাৎ বদল ফ্রান্সের ফুটবলাররা খুব সহজ ভাবে নেননি। ফলে দলের মধ্যে অস্বস্তি একটা আছেই। গ্রিজম্যানের কথাই ধরা যাক। চলতি মরসুমে ২৯টা গোল আর ১৩টা গোলের পাস বাড়িয়েছেন ৪-৪-২ ছকে খেলে আতলেতিকোর স্ট্রাইকার। তাঁকে এখন নতুন জায়গায় খেলতে হলে তিনি অনেক বেশি ফাঁকা জায়গা পাবেন ঠিকই, কিন্তু এই নতুন ছকে তাঁকে বক্স থেকে দূরে থাকতে হচ্ছে। যে বক্সে তিনি সবচেয়ে ভয়ঙ্কর। গ্রিজম্যানের পাস দেওয়ার ক্ষমতা যতই ভাল হোক তিনি কিন্তু নিখাদ প্লে-মেকার নন।
ফরাসি মিডিয়ার মতে এই মিনি বিপ্লবের কারণ এমবাপে। দেশঁ চান তাঁর ডায়মন্ড মিডফিল্ডকে যতটা সম্ভব সুবিধা দিতে। এমবাপে ৪-৪-২ ছকে খেললে তাঁকে রক্ষণে অনেক বেশি জোর দিতে হবে। কিন্তু স্ট্রাইকার হিসেবে খেললে রক্ষণে তাঁর অতটা দায়িত্ব থাকবে না। তাঁর খেলার স্টাইলের সঙ্গে যা জুতসই পরিস্থিতি। একই কথা বলা যায় দেম্বেলের ক্ষেত্রেও। তা ছাড়া ২০১৬ ইউরো ফাইনালের পর থেকে এই ছকে ফ্রান্স কিন্তু খুব বেশি উন্নতি করতে পারেনি। ছকটার কার্যকারিতার একটা
সীমা রয়েছে।
তবে বিশ্বকাপের ঠিক আগেই এ ভাবে ছক পাল্টে দেশঁ যে বিরাট ঝুঁকি নিয়েছেন তাতে কোনও সন্দেহ নেই। যদি দেঁশর পরিকল্পনা শনিবার ফলে যায়, তা হলে তাঁর আর ফুটবলারদের উপর চাপ অনেক কমে যাবে। কিন্তু ব্যর্থ হলে ড্রেসিংরুমের পরিবেশ কিন্তু আরও ভারি হয়ে উঠবে, বাড়বে অস্বস্তি।
শুধু তাই নয়, দেশঁ বৃহস্পতিবার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন সিদিবেকে দলে রেখে দেওয়ার। মোনাকোর ডিফেন্ডার সপ্তাহ খানেকের বেশি ধরেই ফিট হওয়ার জোরদার লড়াই করে যাচ্ছেন। তাঁকে দেশে ফেরৎ পাঠিয়ে বদলি হিসেবে মাথিউ ডেবুশিকে ডাকার পরিকল্পনাও করে ফেলেছিলেন তিনি। কিন্তু তাঁর সেই ভাবনা এর পরে আর এগোয়নি।
ফাটকায় অভ্যস্ত নন, তবু দেশঁ কিন্তু সেই পথেই হাঁটতে পারেন।