চ্যালেঞ্জ: আজ সামনে বেলজিয়াম। তৈরি হচ্ছেন নেমাররা। ছবি: রয়টার্স
ফিলিপে লুইস এত ভাল খেলা সত্ত্বেও কেন মার্সেলো ভিয়েরাকে ফেরানো হচ্ছে দলে?
তিতে হাসেন! ‘‘দু’জনেই ভাল। কিন্তু বেলজিয়ামের মতো টিমের বিরুদ্ধে আমার মার্সেলোকে দরকার।’’
পাওলিনহো কি চোট সারিয়ে খেলতে পারবেন? যদি না পারেন তা হলে আপনার হাতে আর অস্ত্র কী?
ব্রাজিল কোচের মুখে ফের হাসি!
‘‘পাওলিনহো আজ অনুশীলনে নামবে। কাল খেলবে। যদি না খেলে তা হলে আমার রিজার্ভ বেঞ্চে পরিবর্ত তৈরি।’’
গ্যাব্রিয়েল জেসুসের তো একটাও গোল নেই এখনও। তাও বয়ে বেড়াবেন? কেন শুরু থেকে রবের্তো ফির্মিনো নয়?
কলেজ প্রফেসরের মতো প্রশ্ন কর্তার দিকে তাকান তিতে।
‘‘ফির্মিনো খুব ভাল। কিন্তু জেসুস গোল না পেলেও ও আমার দলের সঙ্গে মানিয়ে নিয়েছে। যে কাজটা দেওয়া হচ্ছে সেটা করছে। গোল ছাড়াও অনেক কাজ করতে হয় টিমে।’’
নেমার দা সিলভা স্যান্টোস (জুনিয়র) একটু ধাক্কা খেলেই পড়ে যাচ্ছেন! তা নিয়ে নানা কথা হচ্ছে।
সামান্য গম্ভীর হয় মুখটা। তারপরে সাম্বার দেশের কোচকে নির্বিকার ভঙ্গিতে বলতে শোনা গেল, ‘‘নেমারকে বলেছি রেফারির দিকে না তাকিয়ে বলের দিকে তাকাতে। যত দিন যাচ্ছে তত নেমারের খেলা ভাল হচ্ছে।’’
পেনাল্টি মারা অনুশীলন করাচ্ছেন? ম্যাচ টাই ব্রেকারে গেলে ব্রাজিল কি পেনাল্টি মারতে তৈরি?
এ বার দার্শনিক তিনি।
আরও পড়ুন: চার ম্যাচে ১৪ মিনিট গড়াগড়ি খেয়েছেন নেমার, জানেন?
‘‘ব্রাজিল থেকেই ওটা করছে ছেলেরা। আমি মনে করি মানসিক স্থিতি বজায় রাখার জন্য পেনাল্টির অনুশীলন জরুরি। পেনাল্টি মারাটা টেকনিক্যাল ব্যাপার। গোল পেলে মনের জোর বাড়ে। আর মনের জোর না থাকলে ম্যাচ জেতা যায় না।’’
রোমেলু লুকাকুর শক্তিশালী বেলজিয়ামের বিরুদ্ধে ধুন্ধুমার ম্যাচ নিয়ে উত্তেজনা তুঙ্গে। কাজানে আসার কোনও প্লেনের বা ট্রেনের টিকিট নেই। বুধবার, ম্যাচের দু’দিন আগে মধ্যরাতের বিমানও ভর্তি। উৎকণ্ঠা আর উদ্বেগ নিয়ে ব্রাজিল মিডিয়ার ধারালো প্রশ্ন ধেয়ে আসছে বিষ হয়ে। কিন্তু নেমারদের কোচের যেন তাতে কোনও বিকার নেই। সাংবাদিক সম্মেলন থেকে ওঠার সময় শুধু বললেন, ‘‘দু’টো ভাল টিমের খেলা। আরও একটা অসাধারণ ম্যাচ হবে।’’
কোচের মতোই শান্ত তাঁর সাম্বা-বাহিনী। মূল স্টেডিয়াম থেকে অনেক দূরের একটা মাঠে নেমাররা অনুশীলনে নামলেন বিকেলে। ঝিরঝিরে বৃষ্টির মধ্যে। সেখানে যতক্ষণ মিডিয়াকে থাকতে দেওয়া হল ততক্ষণ শুধু হাত-পা ছুঁড়ে অনুশীলন করে গেলেন থিয়াগো সিলভারা। পেনাল্টি অনুশীলনও হল। তবে বেশি জোর দেওয়া হল ফ্রি-কিকে। নেমার সবার শেষে নামলেন। মাঠের মাটি ছুঁয়ে তারপর আকাশের দিকে দু’হাত বাড়িয়ে দিলেন। ঈশ্বরের কাছে কৃপা চাওয়ার ভঙ্গী যেমন হয়। অনুশীলনের মাঝে নেমারের সঙ্গে খুনসুটি করতে দেখা গেল সতীর্থদের।
তা হলে কি রবের্তো মার্তিনেসের সোনালি প্রজন্মের বেলজিয়ামকে নিয়ে কোনও উদ্বেগ নেই তিতে-বাহিনীর?
এই ম্যাচে ব্রাজিলের অধিনায়ক ডিফেন্ডার মিরান্দা ফিলহো বলছেন, ‘‘বেলজিয়াম টিমটা শুধু একা লুকাকুকে নিয়ে নয়। এডেন অ্যাজার, মুসা দেম্বেলেরাও আছে। গতি ওদের সম্পদ। সেটা কী ভাবে থামানো যাবে তার কাজ চলছে।’’ বলেই তাকালেন পাশে বসা কোচের দিকে। তিতে আরও দার্শনিক। ‘‘ফুটবলাররা জানে কী করতে হয় মাঠে। মনের ভিতর থেকে ইচ্ছাশক্তি জাগ্রত না হলে কোনও যুদ্ধেই জেতা যায় না।’’
তিতের কথা শুনে মনে হল ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিনের বেড়ে ওঠার শহরে এসে ব্রাজিলকে তিনি জাগ্রত করতে চাইছেন, হৃদয় দিয়ে যুদ্ধে জেতার কথা বলে। রুশরা মনে করেন, আধুনিক রাশিয়ার মধ্যে কাজান হচ্ছে সব চেয়ে সম্প্রীতির শহর। এখানে মসজিদের পাশে বড় বড় গির্জার অবস্থান। এ দিন সকালে আবার দেখলাম ‘কৃষ্ণ নাম’ গাইতে গাইতে চলেছেন একদল লোক। এবং সেটা মূল স্টেডিয়ামের পাশের রাস্তা দিয়ে। জেসুসের গোল না করা নিয়ে যে সমালোচনাই হোক, নেইমারের ঝাঁপানো নিয়ে যে কটাক্ষই উড়ে আসুক, যে প্রশ্নই করা হোক মার্সেলোকে নিয়ে, পুরো টিমকে এককাট্টা করতে চাইছেন তিতে। সম্প্রীতির বাতাবরণ তৈরি করে সোনালি প্রজন্মের বেলজিয়ামকে হারাতে চাইছেন তিনি।
এমনিতে তিতে আজ রণনীতিতে সামান্য বদল ঘটাতে চাইছেন বলে খবর। ব্রাজিল মিডিয়ার খবর যদি সত্যি হয় তা হলে ৪-১-৪-১ এ দল নামাবেন তিতে। কার্ডের জন্য কাজিমিরো দলের বাইরে চলে গিয়েছেন। তাঁর জায়গায় খেলবেন ফের্নান্দিনহো লুইস রোসা। লুকাকুকে মাঝমাঠে থামাতে রক্ষণের সামনে দেওয়াল হবেন তিনি। তিতে ড্রেসিংরুমে ফুটবলারদের ইঙ্গিত দিয়েছেন, বেলজিয়ামের গতিকে থামাতেই হবে।
এমনিতে চার ম্যাচে ব্রাজিল একটা মাত্র গোল খেয়েছে। এ দিনও নেমারের কোচকে বলতে শোনা গিয়েছে, ওটা গোল ছিল না। কিন্তু সেই ধারা কি কাজানের মাঠে বজায় রাখতে পারবেন কুটিনহো, অ্যালিসনরা। কাজ়ান বিশ্ব খ্যাত বড় বড় ট্রাক তৈরির জন্য। সারা বিশ্বে এখান থেকে বিশাল বিশাল ট্রাক চালান হয়। বেলজিয়াম এখানে এসেছে যেন ট্রাক ভর্তি গোল নিয়ে। চার ম্যাচে বারো গোল করেছেন লুকাকুরা। গড়ে ম্যাচ প্রতি তিনটে করে গোল। সেটা কি থামাতে পারবে ব্রাজিল? কোন অস্ত্রে রবের্তো মার্তিনেসের গোলন্দাজ বাহিনীকে থামান মিরান্দা-সিলভারা সেটা দেখতে মুখিয়ে ফুটবল বিশ্ব।
মস্কো থেকে এ দিন অনুশীলন করে বিকেলে এসেছেন অ্যাজাররা। তাদের কোচ রবের্তো মার্তিনেস রাতের সাংবাদিক সম্মেলনে বললেন, ‘‘আমাদের শক্তি আছে। সেটা ব্যবহার করব আমরা। আমরা রক্ষণ করতে জানি। আবার আমাদের পায়ে বল পড়লে অন্যদের তটস্থ করতেও জানি।’’ তাঁর পাশে বসে তখন লুকাকু হাসছেন। দু’জনে চোখ চাওয়াচাওয়ি করলেন। এর পর যা বললেন কেভিন দ্য ব্রুইনদের কোচ তা শোনায় হঙ্কারের মতো। ‘‘আমাদের ছেলেরা এই ম্যাচটা খেলার জন্য বহুদিন ধরে অপেক্ষা করছে। ওরা স্বপ্ন ছুঁতে চায়। সেটা ছুঁতে গেলে কাল জিততে হবে।’’
মুখে শক্তি প্রদর্শনের কথা বললেও, ব্রাজিলকে সমীহ করার কথাও অবশ্য শোনা গেল লুকাকুর গলায়। সোনার বুটের লড়াইতে থাকা বেলজিয়াম তারকা বলে দিলেন, ‘‘ব্রাজিল দারুণ টিম। যত দিন যাচ্ছে তত উন্নতি করেছে। সবথেকে বড় কথা আমরা গোল খেয়েছি জাপান ম্যাচেও।’’
লুকাকু আসল কথাটাই বলে গেলেন শেষ পর্যন্ত। গতি থামানোর অঙ্ক কষার পাশাপাশি সাম্বা ব্রিগেড স্বস্তি পাচ্ছে এ জন্যই। বেলজিয়াম রক্ষণ পলকা, সেজন্যই কী তিতের মুখে এত হাসি আর নেমাররা নিশ্চিন্ত? কে জানে!