এ বারের উইম্বলডনের দুই ফাইনালিস্ট। —ফাইল চিত্র
প্রত্যেক মহাকাব্যের কিছু পূর্বকথা থাকে। আসলে হয়তো সেটাই মহাকাব্য হয়ে ওঠার অন্যতম পূর্বশর্ত। রবিবারের এই কাহিনীর ক্ষেত্রেও জাগতিক সেই ফরমানের ব্যত্যয় হয়নি।
সেই পূর্বকথায় লেখা আছে রক্তাক্ত এক নায়কের বীরগাথা। এমন এক ব্যালাড, যা গাওয়া হবে ভবিষ্যতে তাঁকে উৎসর্গ করে। তাঁর ধমনীতে নিরন্তর বয়ে চলে পূর্বপুরুষের সসাগরা ধরিত্রীকে বশ মানানোর স্প্যানিয়ার্ড লোহিতকণা। যাঁকে অনায়াসে মানিয়ে যায় কনকুইস্তাডোর গোছের রোমান্টিক বর্ণনা। ২২টি গ্র্যান্ড স্ল্যাম অর্জন করেও যাঁর খিদে নেভেনি একটুও। এখনও সেই সর্বগ্রাসী খিদে জঠরে জ্বলে থাকে দিবারাত্র। ধিকিধিকি জ্বলতে-থাকা সেই আগুনের ওম তাঁকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায় আরও জয়, আরও জয়ের জন্য। মাটির কোর্ট থেকে সুরকি থেকে সবুজ গালিচা; তাঁকে জিতে নিতে হবে প্রতিটি ম্যাচ, এই সঙ্কল্পে।
সেই সঙ্কল্পকে পাথেয় করে চার দিন আগে তিনি মুখোমুখি হলেন হাঁটুর বয়সি আমেরিকান খেলোয়াড় টেলর ফ্রিৎজের। এই সেন্টার কোর্ট দেখল এ ভাবেও ফিরে আসা যায়! তলপেটের পেশি যখন একটু একটু করে ছিঁড়ে যাচ্ছে, পুরোনো গোড়ালির চোট জানান দিচ্ছে প্রতি বার পা ফেলার সময়ে, তখনও তিনি ভাবছেন আর কিছুক্ষণ মাত্র। তার পরেই জয় অবধারিত। ৪ ঘণ্টা ২১ মিনিটের যুদ্ধ শেষে জয় এল অবশেষে। সঙ্গে নিয়ে এল তাঁর অগণিত ভক্তদের জন্য দুঃসংবাদ।
সেন্টার কোর্টের সামনে লেখক। —নিজস্ব চিত্র
২০০৩ সাল থেকে এই নিয়ে মোট ১২ বার তিনি গ্র্যান্ড স্ল্যামের খেলা ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হলেন আঘাতে জর্জরিত হয়ে। আবার নিশ্চয়ই ফিরে আসবেন। শীঘ্র কোনও একদিন। তিনি নাদাল। তিনি ভক্তকুলের আদরের রাফা।
এবার আসুন চোখ মেলি অন্য এক বর্ণাঢ্য চরিত্রের ওপর। নিকোলাস হিলমি কিরিওস। শুক্রবার এঁর সঙ্গেই মোলাকাত হওয়ার কথা ছিল রাফায়েল নাদালের। দান ছেড়ে দেওয়ায় নিক সরাসরি উঠে এসেছেন ফাইনালে।
কে এই নিক? কেন তাঁর চরিত্র বর্ণাঢ্য বললেও কম বলা হয়? ১৯৯৫ সালে অস্ট্রেলিয়ার ক্যানবেরায় জন্ম নিকের। এখন তাঁর বয়স ২৭ বছর। এই নয় যে নাদালের সঙ্গে তাঁর আগে এখানে মোলাকাত হয়নি। এই উইম্বলডনেই ২০১৪ সালে তিনি হারিয়েছেন বিশ্বের তৎকালীন একনম্বর রাফাকে। তখন তাঁর বয়স ১৯ বছর। আর এটিপি রাঙ্কিং? ১৪৪!
১৯৯২-এর পর সেই প্রথম এমন অঘটন ঘটল টেনিস দুনিয়ায়। কোনও গ্র্যান্ড স্ল্যামে পৃথিবীর এক নম্বরকে হারালেন অজ্ঞাত, এক থেকে একশোর মধ্যে নেই এমন একজন খেলোয়াড়! মনে করা হচ্ছিল, টেনিসের নতুন যুবরাজকে খুঁজে পেয়ে গেছে দুনিয়া। কিন্তু না। সেবার কোয়ার্টার ফাইনাল থেকে খালি হাতে ফিরতে হয় নিককে। পরের কয়েকটা বছরে নিকের টেনিস থেকে প্রাপ্তি মূলত বাদ-বিবাদ, দর্শকদের প্রতি বদ ব্যবহারের জন্য বদনাম আর কোর্টের বাইরে তাঁর প্রেম-জীবন নিয়ে রসালো চর্চা। এক কথায় যিনি হতে পারতেন টেনিসের রাজপুত্র, তাঁকে সমাজ চিনল বিশ্ব টেনিসের ‘ইনফ্যান্তে তেরিবল’ বলে।
সেন্টার কোর্টের ভিতরে। —নিজস্ব চিত্র
খাদের সেই কিনারা থেকে নিক ফিরে এসেছেন মূলত তাঁর ভাই আর সর্বোপরি তাঁর মা, নীল, তাঁদের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায়। টেনিসে নিক বলেন, তাঁর ‘রোল মডেল’ রজার ফেডেরার। বাস্কেটবল লেজেন্ড লে ব্রনকে তিনি নিজের জীবনের ধ্রুবতারা জ্ঞানে দেখেন। ২০০৩ সালের পর আবার একজন অস্ট্রেলীয় খেলোয়াড় এই মাঠে সেরার তকমার জন্য লড়বেন। ঠিক সময় নিক কি পারবেন কষ্টিপাথরে ঘষে নিজেকে সোনা প্রমাণ করতে?
একটা গুরুত্বপূর্ণ তথ্য জানিয়ে রাখি। নিককে উৎসাহ দিতে তাঁর মা নীল থাকবেন না সেন্টার কোর্টে। তিনি অসুস্থ। তাই বাড়ি থেকেই চোখ রাখবেন নিজের অবাধ্য, একগুঁয়ে জেদি কিন্তু বড্ড ভালবাসার পুত্রের উপরে। অন্য সব অস্ট্রেলীয় নাগরিকের মতো তিনিও চাইবেন ছেলের হাতে ট্রফিটা দেখতে।
পরিশেষে তাঁর কথা। ২৭৩ সপ্তাহ বিশ্বের এক নম্বর থেকেছেন। নয় নয় করে সাত বার বছরের শেষে থেকেছেন বিশ্বসেরা। ৩৫ বছর বয়সে এখন অবধি অর্জন করেছেন ২০টি গ্র্যান্ড স্লাম ট্রফি। অনেকে তাঁকে বলেন, পৃথিবীর সর্বকালের শ্রেষ্ঠ টেনিস খেলোয়াড়। সেই অনেকের মধ্যে প্যাট ক্যাশ একজন। বরিস বেকার আর আন্দ্রে আগাসির ছাত্র তিনি। কিন্তু তাঁরা দু’জনেই মনে করেন, তিনি তাঁদের চেয়ে অনেক অনেক বড় খেলোয়াড়।
তবে শুধু পরিসংখ্যান দিয়ে নোভাক জোকোভিচকে মাপা যাবে না একেবারেই। তাঁকে চিনতে হলে, বুঝতে হলে তাঁর জীবনদর্শনকে বুঝতে হবে। যে দর্শনের প্রতি একনিষ্ঠ হতে প্রত্যয়ী নোভাক হেলায় ছেড়ে দেন অস্ট্রেলীয় ওপেন জিতে নেওয়ার সুযোগ। কেননা কোভিড টিকা নিয়ে নিজের মতামত থেকে উনি একচুলও নড়বেন না। তাতে যদি তিনি টেনিস থেকে বঞ্চিত হন, তা-ই সই।
নোভাক এমনই। শান্ত। ধীর-স্থির। প্রত্যয়ী। নির্ভুলতার পূজারী। বিশ্বসেরারা যেমনটি হন আর কি!
উত্তেজনায় ফুটছি সেন্টার কোর্টের গ্যালারি থেকে। কিছুক্ষণ পরে কি দেখব সেন্টার কোর্টের ২০৭ নম্বর গ্যাংওয়ের নিজের আসন থেকে? ডেভিড বনাম গলিয়াথ? টেনিসের নতুন মস্তানকে চিনে নেওয়ার দাস্তান? নাকি, সার্বিয়ান শ্রেষ্ঠত্বের প্রমাণ? আর একবার?