হুঙ্কার: আইপিএল ফাইনালে ওঠার পরে বেঙ্কটেশ, মাভি, শুভমন, নীতীশ, রাহুলরা। ট্রফি জেতার লড়াইয়ে যাঁদের দিকে তাকিয়ে কেকেআর। ছবি: টুইটার
ব্রেন্ডন ম্যাকালাম, কলকাতা নাইট রাইডার্সের ইতিহাসে সব চেয়ে প্রভাবশালী চরিত্র হিসেবে আপনার মনোনয়নকেই সব চেয়ে শক্তিশালী দেখাচ্ছে। অন্য গোলার্ধের নিউজিল্যান্ড থেকে এসেও কলকাতার হৃদয় জিতে নেওয়া বীর নাইট!
আইপিএল বোধনে আপনার সেই ৭৩ বলে ১৫৮ শুধু নবজাতক লিগকে হাঁটতেই শেখায়নি, শাহরুখ খানের মতো জনপ্রিয় তারকার ফ্র্যাঞ্চাইজিকে দুর্দান্ত ভাবে টেক-অফ করিয়ে দিয়েছিল। যত বার ‘করব, লড়ব জিতব রে’ বাজবে, বেঙ্গালুরুতে আপনার মহাকাব্যিক ইনিংসের কথা স্মরণ করা হবে। শাহরুখ তাঁর দলের নাম রেখেছিলেন বিখ্যাত টিভি সিরিজ় ‘নাইট রাইডার’-এর অনুকরণে। ডেভিড হেস্লহফ আর তাঁর হাইটেক, বিলাসবহুল গাড়ি! আশির দশককে যা ভাসিয়ে নিয়ে গিয়েছিল।
ব্রেন্ডন ম্যাকালাম, আপনি আইপিএলের উদ্বোধনী দিনেই ডানা মেলে ওড়া তো শিখিয়েছিলেনই, নাইটদের গুরু হিসেবে ফিরে এসে লড়ঝড়ে একটা গাড়িকে ফেরারিতে পরিণত করে দেখালেন। চলতি আইপিএলের প্রথম পর্বে দেশের মাটিতে যারা সাত ম্যাচের পাঁচটিতে হেরেছিল, তারাই আমিরশাহিতে মরুঝড় তুলে ফাইনালে। প্রথম পর্বে আপনি টিম চালাননি, আতঙ্কিত চোখমুখ নিয়ে মাঠে নামছিল কেকেআর। আমিরশাহিতে দ্বিতীয় পর্বে আপনিই দলের সর্বময় ব্যক্তি হিসেবে মাঠে ছেড়ে দিয়েছেন খোলামেলা, ভয়ডরহীন মনোভাবে টগবগ করে ফুটতে থাকা একটা দলকে। বেঙ্কটেশ আয়ার আপনার আবিষ্কার। প্রথম পর্বে একটাও ম্যাচ না খেলা অনামী এক অলরাউন্ডার এ বারের আইপিএলের সিন্ডেরেলা-কাহিনি। শুভমন গিলের মধ্যে আত্মবিশ্বাস ফিরিয়েছেন। বরুণ, নীতীশ রানা, রাহুল ত্রিপাঠী, শিবম মাভি, প্রসিদ্ধ কৃষ্ণদের তরুণ ব্রিগেড আপনার মন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে নাইট সমর্থকদের আরব্য রজনী উপহার দিয়ে চলেছে।
নিউজিল্যান্ড মানেই যেন ক্রিকেট সংস্কারকদের দেশ। মার্টিন ক্রো যেমন ১৯৯২ বিশ্বকাপে মার্ক গ্রেটব্যাচকে দিয়ে প্রথম পনেরো ওভারের বিধিনিষেধের ফায়দা তুলিয়ে উঁচু করে মারা শট খেলিয়েছিলেন। স্পিনার দীপক পটেলকে দিয়ে বোলিং শুরু করানোর অভিনবত্ব দেখিয়েছিলেন। নিউজিল্যান্ড মানেই নিঃশব্দ, নীরব বিপ্লব। ফিল হিউজের মর্মান্তিক মৃত্যু যখন ক্রিকেটবিশ্বকে স্তব্ধ করে দিল, আপনাদের টিমের বোলাররা সারাদিনে একটাও বাউন্সার দিলেন না। কী অভিনব শোকজ্ঞাপন!
ব্রেন্ডন ম্যাকালাম, আপনিও তো অধিনায়ক হিসেবে নিউজ়িল্যান্ড দলের মনোভাবই পাল্টে দিয়েছিলেন। ২০১৫ বিশ্বকাপে আপনার নেতৃত্বে কিউয়িরা ক্রিকেট খেলেনি, অ্যাডভেঞ্চারে নেমেছিল। মাইকেল ক্লার্কের অস্ট্রেলিয়া বিশ্বকাপ জিতলেও সেরা বিনোদন উপহার দিয়ে জনতার হৃদয়ে কাপ জিতেছিলেন আপনারাই। অতি আগ্রাসী ব্যাটিংয়ের সেই নকশা সব দেশ, সব অধিনায়ক এর পরে অনুসরণ করল। ইংল্যান্ডের ২০১৯ বিশ্বকাপ জয়ের নেপথ্যে অইন মর্গ্যানের যে ব্যাটিং অ্যাডভেঞ্চার নীতি, তা আপনাদের ২০১৫ বিশ্বকাপের কার্বন কপি।
এ বার নাইট রাইডার্সের অভিযানের অন্তিম যুদ্ধ। দরকার শুধু শেষ গিরিশৃঙ্গ পেরনো। কিন্তু শুক্রবারের ফাইনালের জন্য শুধু গুরু ম্যাকালামকে পেলেই চলবে না, দরকার সংস্কারক ম্যাকালামকেও। যিনি তাঁর অধিনায়ককে বসানোর সাহস দেখাতে পারবেন। অপ্রিয় কাজটা করতে হয় না যদি ইংল্যান্ডের অধিনায়ক নিজে থেকে নিজেকে সরানোর কথা ভাবেন। আইপিএলে এমন উদাহরণ রয়েছে। কুমার সঙ্গকারা নিজেকে বসিয়ে দিয়েছিলেন ডেকান চার্জার্স দল থেকে। অ্যাডাম গিলক্রিস্ট নিজেকে পঞ্জাবের প্রথম একাদশে রাখেননি। ড্যানিয়েল ভেত্তোরি রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স ব্যাঙ্গালোরে অধিনায়ক থাকা অবস্থায় নিজে বসে মুরলীধরনকে জায়গা করে দিয়েছিলেন।
মর্গ্যানের ইংল্যান্ড ক্রিকেট ইতিহাসেই উদাহরণ রয়েছে। ১৯৭৪-’৭৫ মরসুমে অ্যাশেজ সফরে সিডনিতে চতুর্থ টেস্টে নিজেকে বসিয়ে দিয়েছিলেন মাইক ডেনেস। ছয় ইনিংসে লিলি-থমসনের সামনে মাত্র ৬৫ রান করা ডেনেসের অপসারণের দাবিতে ইংল্যান্ডের ক্রিকেট মহলে ঝড় বয়ে যাচ্ছিল। অমর হয়ে আছে ডেনেসকে পাঠানো এক ক্রিকেট ভক্তের চিঠি। খামের উপরে লেখা ‘মাইক ডেনেস, ক্রিকেটার’। ভিতরে একটিই মাত্র লাইন— ‘‘যদি এই চিঠি তোমার কাছে পৌঁছয়, বুঝতে হবে পোস্ট অফিস তোমার কথা আমার চেয়েও বেশি করে ভেবেছে!’’
মর্গ্যানকে নিয়ে কেকেআরের কোনও ভক্ত এমন চিঠি পাঠিয়ে দিয়ে থাকলে অবাক হওয়ার নেই। নাইট অধিনায়ক ১৫টি ম্যাচে করেছেন ১২৯ রান, গড় ১১.৭২, স্ট্রাইক রেট ৯৮.৪৭। দিল্লি ক্যাপিটালসের বিরুদ্ধে বুধবার রাতেও শূন্য করে ফের কাঠগড়ায়। ফিট হয়ে যাওয়া আন্দ্রে রাসেলকে যদি দলে ফেরাতে হয়, তা হলে বসানো উচিত মর্গ্যানকেই। শাকিব-আল-হাসানকে বাদ দিয়ে রাসেলকে ফেরানো মানে ক্রিকেটীয় যুক্তি-তক্ক বিসর্জন দিয়ে অধিনায়ককে আড়াল করা হবে। অধিনায়ক তো কী, তাঁকে প্রথম একাদশে জায়গা পাওয়ার যোগ্যতা অর্জন করতে হবে না? আর ব্রেন্ডন ম্যাকালাম, মাঠে দল পরিচালনার দিকনির্দেশ হিসেবে আপনারাই তো ডাগআউট থেকে সঙ্কেত পাঠাচ্ছেন। তার মানে রিমোটেও অধিনায়কত্ব চালানো যায়। তা হলে অন্য কারও হাতে নেতৃত্ব তুলে দিয়ে সেরা প্রথম একাদশ বেছে নেব না কেন?
আন্দ্রে রাসেল ফিট থাকলে তিনি, সুনীল নারাইন, লকি ফার্গুসন এবং শাকিব-আল-হাসান— এঁরাই যে নাইট রাইডার্সে চার বিদেশি হওয়া উচিত, তা বোঝার জন্য ফেলু মিত্তির হওয়ার দরকার নেই। অধিনায়ক? দীনেশ কার্তিক করে দিতে পারেন। সুনীল নারাইন করে দিতে পারেন। ব্রেন্ডন ম্যাকালাম, শুধু ট্রফি নয়, নাইট রাইডার্স সংস্কৃতিও তৈরি করে দিয়ে যান, যেখানে বরাবর ব্যক্তির আগে অগ্রাধিকার পাবে দলীয় স্বার্থ।
তা হলেই ম্যাট বাসবির ম্যাঞ্চেস্টার ইউনাইটেডের সেই বিখ্যাত ‘বাসবি বেব্স’-এর মতো অদূর ভবিষ্যতে নাইট সমর্থকদের মুখে মুখেও ঘুরবে ‘ব্রেন্ডন্স বয়েজ’!