সমীর বন্দ্যোপাধ্যায়: জুনিয়রে সাফল্য পেলেও সিনিয়র পর্যায়ে ব্যর্থ। ছবি টুইটার
মাস দু’য়েক আগে জুনিয়র উইম্বলডনে চ্যাম্পিয়ন হয়ে হইচই ফেলে দিয়েছিলেন বাঙালি টেনিস খেলোয়াড় সমীর বন্দ্যোপাধ্যায়। আমেরিকার হয়ে খেলতে নামা ১৭ বছরের সমীরকে নিয়ে সবার আগে যে প্রশ্নটি উঠেছিল, কবে সিনিয়র বা প্রো সার্কিটে খেলবেন তিনি? জবাবও দিয়েছিলেন সমীর। বলেছিলেন, ইউএস ওপেনে সিনিয়র সার্কিটে নামার চেষ্টা তিনি করবেন। চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু যোগ্যতা অর্জন পর্বের প্রথম রাউন্ডেই ফ্রান্সের অবাছাই কোয়েঁতি হ্যালির কাছে স্ট্রেট সেটে উড়ে যান।
ভবিষ্যতের রাফায়েল নাদাল যাঁকে বলা হচ্ছে, সেই কার্লোস আলকারাজ ইউএস ওপেনে কোয়ার্টার ফাইনাল ম্যাচ শেষই করতে পারেননি। কলকাতার লিয়েন্ডার পেজ জুনিয়র সার্কিটে সাড়া জাগিয়ে শুরু করলেও সিনিয়রে সিঙ্গলস সে ভাবে খেলেননি। সিনিয়রে ডাবলসে লিয়েন্ডার যেখানে ১,২২৭টি ম্যাচ খেলেছেন, সেখানে তাঁর সিঙ্গলস ম্যাচ খেলার সংখ্যা মাত্র ২০০।
জুনিয়র থেকে সিনিয়রে দাগ কাটতে ব্যর্থতার ক্ষেত্রে সমীর, লিয়েন্ডাররা কি ব্যতিক্রম? পরিসংখ্যান তা বলছে না। আন্দ্রে আগাসি, মণিকা সেলেস, সেরিনা উইলিয়ামস, ভিনাস উইলিয়ামস, মারিয়া শারাপোভাদের মাস্টারমশাই, আমেরিকার টেনিস কোচ নিক বলিটিয়েরির টেনিস অ্যাকাডেমিতে ‘বলিটিয়েরি ডেভলপমেন্ট ফিলোজফি’ নিয়ে কাজ করা পিটার ম্যাকক্র এই বিষয়টি নিয়ে কাজ করেছেন। ‘আইটিএফ কোচিং অ্যান্ড স্পোর্টস সায়েন্স রিভিউ’-তে তাঁর গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছে। সেখানে দেখা যাচ্ছে গত দশ বছরে যাঁরা জুনিয়র ক্রমতালিকায় প্রথম দশে ছিলেন, তাঁদের মধ্যে মাত্র ৫৮ শতাংশ সিনিয়র ক্রমতালিকায় প্রথম ১০০ জনের মধ্যে ঢুকতে পেরেছেন।
লিয়েন্ডার পেজ: সিনিয়র পর্যায়ে স্মরণীয় ডাবলস ম্যাচ খেললেও সিঙ্গলসে সে ভাবে খেলেননি।
কেন এই ব্যর্থতা? জুনিয়র এবং প্রো সার্কিটে খেলার মধ্যে কতটা তফাৎ, তার ব্যাখ্যা দিয়েছেন ম্যাকক্র। কয়েকটি কারণ উঠে এসেছে তাঁর গবেষণায়।
১. বাবা, মা-র ভুল বিশ্লেষণ: অনেক বাবা-মা তাঁর সন্তানের খেলায় নাক গলিয়ে ফেলেন। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তাঁদের সেই দক্ষতা বা জ্ঞান থাকে না। বাবা-মা ভাবেন, ১২ বছর বয়সে তাঁর সন্তান জুনিয়র স্তরে এত প্রতিযোগিতা জিতেছে, সে ভবিষ্যতে রজার ফেডেরার বা মারিয়া শারাপোভা হবেই। কিন্তু সন্তানের যোগ্যতা বিচার করতে না পেরে বাবা-মা-র দিবাস্বপ্ন স্বপ্নই থেকে যায়। অ্যান্ডি মারের যেমন জুডি মারে ছিলেন, নাদাল যেমন টনি নাদালকে পেয়েছিলেন, সব সন্তানের সেই সৌভাগ্য হয় না। তারা জুনিয়র স্তরেই হারিয়ে যায়।
কার্লোস আলকারাজ: ভবিষ্যতের নাদাল ইউএস ওপেনের সিনিয়রে ব্যর্থ।
২. আর্থিক পরিকল্পনার অভাব: ছোট থেকেই একজন টেনিস খেলোয়াড়ের জন্য নির্দিষ্ট আর্থক পরিকল্পনা থাকা দরকার। জুনিয়র স্তরে সাফল্য পাওয়ার পর অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায়, সিনিয়র সার্কিটে সফল হওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থের জোগান বাবা-মা দিতে পারছেন না। শেষ পর্যন্ত কোনও মতে যেখান থেকে অর্থের জোগান হয়, দেখা যায় সেই সূত্র সংশ্লিষ্ট খেলোয়াড়ের ক্ষতি করে দিচ্ছে। সাধারণত এই আর্থিক জোগান আসে খেলোয়াড় যে অ্যাকাডেমি থেকে উঠে এসেছে, সেখান থেকে। স্থানীয় ক্লাব বা ফেডারেশনও আর্থিক সাহায্য করে। কিন্তু তাদের ক্ষুদ্র এবং স্বল্পমেয়াদী স্বার্থ খেলোয়াড়দের ক্ষতি করে দেয়। টাকার জোগান দেওয়া সংস্থাগুলি তাদের খেলোয়াড়দের উপর এমন কিছু সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেয়, যাতে তারা নিজেরা ব্যবসায়িক দিক দিয়ে লাভবান হয়। আখেরে ক্ষতি হয় সেই জুনিয়র খেলোয়াড়ের।
রজার ফেডেরার: ছোটেবেলায় সপ্তাহে ১০ ঘণ্টার বেশি অনুশীলন করতেন না।
৩. টেকনিকের অভাব: ফেডেরার, নাদাল, সিমোনা হালেপদের অনূর্ধ-১২ এবং অনূর্ধ-১৪ স্তরের ইউটিউব ভিডিয়ো দেখলে একটা বিষয় স্পষ্ট হয়ে যাবে, তাঁদের তখনকার টেকনিক এবং এখনকার টেকনিকের মধ্যে তফাৎ খুব কম, কারও ক্ষেত্রে তফাৎ প্রায় নেই। সফল টেনিস খেলোয়াড়রা সঠিক টেকনিক ছোটবেলা থেকেই রপ্ত করে ফেলেন। কিন্তু জুনিয়র স্তরে অধিকাংশ খেলোয়াড়ের ক্ষেত্রেই যেটা হয়, তারা সফল হওয়ার পরে নিজেদের টেকনিকে বাড়তি পরিবর্তন আনার চেষ্টা করে। স্বাভাবিক ভাবেই আর সাফল্য আসে না।
৪. অতিরিক্ত ট্রেনিং: সাফল্যের পিছনে ছুটতে গিয়ে জুনিয়র পর্যায়ে অধিকাংশ কোচ এবং বাবা-মা তাঁর ছাত্র বা সন্তানকে শুধু ঘণ্টার পর ঘণ্টা কড়া অনুশীলন করান। পোলান্ডের ইউনিভার্সিটি অফ ফিজিক্যাল এডুকেশন-এর গবেষক এবং টেনিস কোচ পিয়োত্র উনিয়ার্সকি ৪০টি দেশের এক হাজারের উপর জুনিয়র টেনিস খেলোয়াড়কে নিয়ে গবেষণা করেছেন। খেলোয়াড়দের গড় বয়স ১২ থেকে ১৩। এঁদের মধ্য ফেডেরার, কিম ক্লিস্টার্স, জাস্টিন এনা রয়েছেন। উনিয়ার্সকি দেখেছেন, যাঁরা শীর্ষ পর্যায়ে সাফল্য পেয়েছেন, তাঁরা ওই বয়সে সপ্তাহে ১০ ঘণ্টার বেশি অনুশীলনই করতেন না। তাঁর বক্তব্য, অতিরিক্ত অনুশীলনের ফলে দুটি জিনিস হয়, এক, শারীরিক ও মানসিক ক্লান্তি, দুই, ক্ষিপ্রতা কমে যাওয়া। দুটিই সাফল্য পাওয়ার পরিপন্থী।