Football

দূরদৃষ্টি আর পেশাদারিত্বের অভাবেই কি এটিকের সঙ্গে মিশে যেতে হল মোহনবাগানকে?

বিদেশি ক্লাবগুলো প্রাক মরসুম করার জন্য অন্য দেশে যায়। সেখানকার ক্লাবের সঙ্গে প্রস্তুতি ম্যাচ খেলে।  কলকাতার দুই বটবৃক্ষ ক্লাব নিজেদের আটকে রাখল দেশের গণ্ডিতেই। থুড়ি, এখন তা নিজের রাজ্যেই এসে পর্যবসিত হয়েছে।

Advertisement

কৃশানু মজুমদার

কলকাতা শেষ আপডেট: ১৭ জানুয়ারি ২০২০ ১৭:৩২
Share:

সবুজ-মেরুন রং কি আরও উজ্জ্বল হবে আগামিদিনে? সেই প্রশ্নই ময়দানে।

মোহনবাগান-এটিকে সংযুক্তিকরণের খবর শুনে কেউ বলছেন, ভারতীয় ফুটবলে ঐতিহাসিক ঘটনা। এতে একদিকে ভালই হল মোহনবাগানের।

Advertisement

আবার কেউ বলছেন, মোহনবাগান তো আর মোহনবাগান রইলই না। ক্লাবের অস্তিত্বই যে সঙ্কটে।

বৃহস্পতিবারের নজিরবিহীন সংযুক্তিকরণ নিয়ে ভাল-মন্দর ঝড় কলকাতা ময়দানে। মোহনবাগান সচিব টুটু বসু বলেছেন, ‘‘নির্বাচনের সময় প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম, মোহনবাগান আইএসএল খেলবে। সেটা হচ্ছে। তা ছাড়া এটিকে ফুটবলটা জানে। সমর্থকদের আবেগ বুঝবে। মাঝপথে চলে যাবে না।’’ আইএসএল স্রোতে গা ভাসানোর জন্যই এটিকে-তে এসে মিশে গেল মোহনবাগান। আর এই মিলে যাওয়ার ফলে উঠছে প্রশ্ন, শতাব্দীপ্রাচীন ক্লাবকে কেন এই রাস্তা নিতে হল? ক্লাবকর্তা, প্রাক্তন ফুটবলারদের একটা অংশের দাবি, আধুনিক চিন্তার অভাব, দূরদর্শিতা এবং পেশাদারিত্বের অভাবেই আজ মোহনবাগানকে এটিকে-র সঙ্গে সংযুক্তিকরণের রাস্তা নিতে হল।

Advertisement

ঐতিহাসিক শিল্ড জয়ী অমর একাদশ।

বহু বছর আগে মোহনবাগানের কিংবদন্তি ফুটবলার গোষ্ঠ পাল তাঁর পদ্মশ্রী পদক-সহ একাধিক পুরস্কার তুলে দিয়েছিলেন ক্লাবকে। তাঁর ছেলে নীরাংশু পাল বলছিলেন, ‘‘বাবা দূরদৃষ্টি সম্পন্ন মানুষ ছিলেন। বাবার দেওয়া ট্রফিগুলো মোহনবাগান প্রদর্শনের ব্যবস্থা করতে পারত। সেগুলো দেখিয়ে অর্থাগমেরও ব্যবস্থা করা যেত। ক্লাবকর্তারা সাধারণ মানুষের জন্য টিকিট কেটে প্রদর্শনী দেখার বন্দোবস্ত করতে পারতেন। বিদেশের ক্লাবগুলো এ ভাবেই টাকা রোজগার করে।’’ সেই পথে হাঁটেনি সবুজ-মেরুন। গোষ্ঠ পালের পাওয়া পুরস্কারগুলোর আর হদিশই নেই বাগানে।

ম্যানেচস্টার ইউনাইটড, চেলসি, বার্সেলোনার মতো ক্লাবের স্টেডিয়াম, ট্রফি দেখতে হলে টিকিট কাটতে হয় দর্শকদের। সেই সব ক্লাবের রয়েছে বিভিন্ন নিজস্ব প্রোডাক্ট। তা বিক্রি করে আসে অর্থ। ইস্টবেঙ্গল ও মোহনবাগান সেই জায়গায় নিজেদের নিয়ে যেতে পারেনি। লাল-হলুদের সহ সচিব শান্তিরঞ্জন দাশগুপ্ত বলছিলেন, ‘‘দূরদর্শিতা এবং গভীর ভাবে চিন্তার অভাব রয়েছে দুটো ক্লাবে। বিদেশের ক্লাবকে অনুসরণ করতে হলে যে পরিকাঠামোর দরকার, তা আমাদের এখানে নেই। এখনও ময়দানে একটা চারাগাছ পুঁততে হলে সেনাবাহিনীর অনুমতির দরকার হয়। ফলে আমাদের পক্ষে একটা মিডিয়া সেন্টার আর ক্যাফেটেরিয়ার বেশি তৈরি করা সম্ভব হয়নি। সেটা করেই মনে করেছি অনেক কিছু করে ফেলেছি। ক্লাবকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার বিশেষ চেষ্টাই করিনি কেউ।’’

ডার্বি ম্যাচে এই ভরা গ্যালারি কি আর দেখা যাবে?

বিদেশি ফুটবলের ঢেউ এখন আছড়ে পড়েছে ভারতের ফুটবলে। কর্তা থেকে সমর্থকরা মেসি-রোনাল্ডো নিয়ে আলোচনা করেন। চায়ের পেয়ালায় তুফান তোলেন অথচ নিজেদের অ্যাকাডেমি থেকে ফুটবলার তুলে এনে সেই ফুটবলারকে বিক্রির রাস্তায় হাঁটেন না। ইউনাইটেড স্পোর্টসের কর্তা কুন্তল মুস্তাফি বলছিলেন, ‘‘প্রভাত লাকরা আমাদের অ্যাকাডেমির ফসল। ওকে আমরা বিক্রি করে টাকা পেয়েছিলাম।’’

মোহনবাগানও নিজেদের অ্যাকাডেমি থেকে ভাল ফুটবলার তুলে এনে তাঁকে অন্য ক্লাবে ট্রান্সফার করতেই পারত। এতে ক্লাবের কোষাগারে টাকা আসতে পারত। যত বেশি ফুটবলার ট্রান্সফার করা যাবে, ততই অর্থ পাবে ক্লাব। এমন ভাবনাচিন্তার বাস্তবায়নের রাস্তায় হাঁটেননি বাগান কর্তারা। নিজেদের প্লেয়ার তুলে না এনে নিম্নমানের বিদেশি ফুটবলারকে সই করিয়েছেন প্রচুর টাকার বিনিময়ে। হয়েছে অর্থের অপচয়। অনেকে বলতেই পারেন, বলা যতটা সহজ, কাজে করে দেখানো খুবই কঠিন। কারণ শিবঠাকুরের দেশের ফুটবল যে চলে তার নিজের নিয়মেই।

বিদেশি ক্লাবগুলো প্রাক মরসুম করার জন্য অন্য দেশে যায়। সেখানকার ক্লাবের সঙ্গে প্রস্তুতি ম্যাচ খেলে। কলকাতার দুই বটবৃক্ষ ক্লাব নিজেদের আটকে রাখল দেশের গণ্ডিতেই। থুড়ি, এখন তা নিজের রাজ্যেই এসে পর্যবসিত হয়েছে। বাগানের প্রাক্তন কোচ স্টিভ ডার্বি একবার বলেছিলেন, ‘‘ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান নিয়ে বিশ্ব ফুটবলের কোনও মাথাব্যথা নেই।’’ সহজ কথায়, নিজেদের ব্র্যান্ড হিসেবে আন্তর্জাতিক স্তরে পৌঁছতে ব্যর্থ হয়েছে দুই প্রধান। অবশ্য এ পর্যন্ত পড়ে অনেকে বলতেই পারেন, বার্সেলোনা-রিয়াল মাদ্রিদ-ম্যাঞ্চেস্টার ইউনাইটেড তো ভিনগ্রহের। ওদের সঙ্গে তুলনা না করাই ভাল। ওরা এগিয়ে যাচ্ছে। আর আমরা পিছিয়ে পড়ছি।

সময়ের সঙ্গে সঙ্গে খেলার মান কমেছে ইস্ট-মোহনের। হারিয়ে গিয়েছে তারকা। দুটো ক্লাবে সংখ্যা বেড়েছে নিম্নমানের বিদেশি আর ভিন রাজ্যের ফুটবলারদের। বাঙালি প্লেয়ারের সংখ্যা কমেছে হু হু করে। ভিন রাজ্যের ফুটবলাররা কী ভাবে কলকাতার দুই প্রধানের নাড়ির টান আর বুঝবেন? ‘মাঝমাঠের বেকেনবাওয়ার’ বলে পরিচিত গৌতম সরকার বলছিলেন, ‘‘দুটো ক্লাবের খেলার মান যে পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে, তাতে টাকা দেওয়ার জন্য স্পনসর এগিয়ে আসবে কেন?’’

ক্লাব বাঁচাতেই ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত, বলছেন কর্তারা।

ক্লাব পরিচালনা করতে দরকার প্রচুর অর্থ। অর্থের অভাবে ভাল দল গঠন করা সম্ভব নয়। ভাল দল না হলে ট্রফি জেতাও সম্ভব নয়। মোহনবাগানে বেশ কয়েক বছর ধরেই চলছে অর্থকষ্ট। সংবাদমাধ্যমে খবর হয়, টাকা না পেয়ে বিদেশি ফুটবলার ফিফা-র কাছে মোহনবাগানের নামে নালিশ করছে। টাকা না পাওয়ায় ফুটবলাররা অনুশীলনে নামতে চাইছেন না, এমন উদাহরণও আছে। টাকার প্রতিশ্রুতি পেলে তবেই মাঠে নামছেন তাঁরা। অর্থ জোগাড় করা আর সম্ভব হয়ে উঠছিল না কর্তাদের পক্ষে। শান্তিবাবু বলছেন, ‘‘এখানেই তো দূরদর্শিতার অভাব। মহমেডান স্পোর্টিং ক্লাবের যে হাল হল, তা দেখে আমরা শিক্ষা নিইনি। দু’একজন ব্যক্তি স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্যই ক্লাবকে বেছে নিয়েছে। তাঁরা ক্ষমতায় থাকতেই ভালবাসেন। মনে করেন এতে ক্লাবের উন্নতি হবে। কিন্তু, এতে যে সার্বিক ভাবে উন্নতি হয় না, তা তো দেখাই যাচ্ছে।’’

পেশাদারিত্বের অভাবের কথা শোনালেন এশিয়ান অল স্টার-খ্যাত গোলকিপার অতনু ভট্টাচার্যও। তিন প্রধানের হয়ে খেলা অতনু বলছিলেন, ‘‘ভারতীয় ফুটবল যে দিকে যাচ্ছে, তাতে সব ক্ষেত্রে পেশাদারিত্বের দরকার। এই পেশাদারিত্বের অভাব কলকাতার দুটো ক্লাবে।’’

সারা বিশ্বে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছেন প্রচুর মোহনবাগান সমর্থক। সদস্য সংখ্যা বাড়িয়ে ক্লাবের আয় বাড়ানোই যেত। নিন্দুকদের দাবি, সদস্য সংখ্যা বাড়াতে অনীহা ক্লাব কর্তাদের। সদস্য সংখ্যা বাড়ালে ক্লাবের অর্থাগম হয় ঠিকই। কিন্তু আনুগত্য ভাগ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কাও থাকে। সেই কারণে কর্তারা সদস্য সংখ্যা বাড়ানোর পক্ষপাতীও নন। নিজেদের পছন্দের মানুষকেই বেছে বেছে সদস্য করা হয়। যাতে ক্ষমতা নিজেদের হাতেই থাকে। কর্তাদের বিরুদ্ধে যাতে কেউ গলা না তোলেন।

তবে এর একটা বিপরীত মতবাদও রয়েছে। যা শোনাচ্ছেন সত্যজিৎ চট্টোপাধ্যায়। ঘরের ছেলে বলে পরিচিত সত্যজিৎ বলছিলেন, ‘‘এটিকে-র সঙ্গে মোহনবাগানের চুক্তি ঐতিহাসিক। ভারতীয় ফুটবল এখন যে দিকে এগোচ্ছে, তাতে এই চুক্তিটার দরকারই ছিল। আইএসএল খেলতে হলে প্রচুর টাকার দরকার। সেই অর্থ জোগাড় করা সম্ভব ছিল না। আইএসএল না খেললে মোহনবাগানকে সবাই ভুলে যাবে। সেটা আমরা হতে দিতে পারি না। আগামী পঞ্চাশ বছর যাতে আমাদের আর ভাবতে না হয়, সেই কারণেই এটিকে-র সঙ্গে চুক্তি করা হয়েছে। এতে লাভবান হবে মোহনবাগান।’’

মোহনবাগান এখন প্রতিষ্ঠানে পর্যবসিত হয়েছে। প্রতিষ্ঠানকে বাঁচানোর জন্যই এমন নজিরবিহীন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলে দাবি কর্তাদের।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement