রোহিত কি পারবেন টেস্টে ওপেনার হিসেবে সফল হতে? ফাইল ছবি।
রোহিত শর্মার প্রতিপক্ষ শুধুমাত্র দক্ষিণ আফ্রিকার বোলাররা নন। তার সঙ্গে যোগ করুন মারাত্মক চাপ। যা কখনও আসছে প্রাক্তন ক্রিকেটারদের মন্তব্যে, কখনও সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে। আর অবধারিত ভাবেই বাড়ছে মিডিয়ার চর্চা। ব্যাপারটা তাই রোহিত বনাম প্রোটিয়া পেসার প্লাস প্রেসার। এ ভাবেই দেখছেন তাঁর কোচ দীনেশ লাড।
টেস্ট ওপেনার হিসেবে রোহিতের নাম ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গেই শুরু হয়েছিল চর্চা। কিন্তু ক্রিকেটমহলেই ব্যাপারটা থামেনি। শনিবার যে মুহূর্তে বোর্ড প্রেসিডেন্ট একাদশের ওপেনার হিসেবে দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে খাতা খোলার আগেই ফিরেছেন মুম্বইকর, সঙ্গে সঙ্গে নেটদুনিয়ায় ট্রোলড হয়ে গিয়েছেন তিনি। আর এখানেই আপত্তি তুলছেন তাঁর কোচ। প্রিয় ছাত্রকে আড়াল করে রবিবার আনন্দবাজার ডিজিটালকে দীনেশ লাড সাফ বললেন, “মিডিয়ায় এত হাইপ তৈরি হয়েছে যে প্রেশার থাকছেই। ওকে নিজেকে প্রমাণ করতে হবে যে ও ভাল ব্যাটসম্যান। ওপেনিং করবে। একটাই চাপ। দেখুন শুধু রোহিতকে নিয়েই হাইপ হচ্ছে। নজর শুধু ওর উপরেই। সবার এক কথা, রোহিত ওপেন করছে আর রোহিত ওপেন করছে। মতামত নেওয়া হচ্ছে সবার। এতটাও তো হওয়া উচিত নয়। রোহিতকে তো খোলা মনে খেলতে দিতে হবে। সেটাই হচ্ছে না। সেই কারণেই সমস্যা হচ্ছে। তবে প্রেশার নিয়েই ওকে খেলতে হবে।”
সমস্যা হল, আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে চাপ নিয়েই তো খেলতে হয়। চাপহীন অবস্থায় খেলতে নামার বিলাসিতা করতে পারে না কেউই। রোহিত কি পারবেন এই চাপকে জয় করতে? আশাবাদী কোচ বললেন, “দেখুন, যে ভাবে রোহিত-রোহিত করা হচ্ছে, তাতে যেন ভারতীয় দল খেলছে না। খেলছে শুধু রোহিত। ইন্ডিয়ান টিমের উপরই কারও ফোকাস নেই। এটা ঠিক হচ্ছে না। আমি আশা করছি রোহিত এই চাপ কাটিয়ে উঠবে ঠিক। বড় রান পাবেই।”
আরও পড়ুন: শূন্য করলেন ওপেনার রোহিত, ব্যর্থ ঈশ্বরনও
আরও পড়ুন: ‘অবসরের সিদ্ধান্তটা ধোনির উপরেই ছেড়ে দিন না’
এমনিতে, টেস্ট ওপেনার হয়ে ওঠার সব গুণই ছাত্রের মধ্যে দেখছেন তিনি। সোজা ব্যাটে খেলা থেকে ‘ভি’-র মধ্যে শট নেওয়া। কাট-পুলে দক্ষতা বা বড় ইনিংস খেলার ধৈর্য। দরকার শুধু জমিতে স্ট্রোক নেওয়া। আকাশে বল না তোলা। তাড়াহুড়ো না করা। তা হলেই হবে। কোচের কথায়, “বিশ্বকাপের ম্যাচগুলো দেখলেই বোঝা যাবে ও উইকেটে টিকে থাকায় জোর দিয়েছিল। বাজে বলকেই মারছিল। এমন মোটেই নয় যে সব বলেই চালিয়েছে। যে বলই আসুক, মারব, এমন কিন্তু করেনি। প্রথমে ক্রিজে বেশিক্ষণ থাকায় জোর দিয়েছিল রোহিত। সে ভাবেই শতরান করেছে। প্লাস পয়েন্ট হল, ও সোজা ব্যাটে খেলার লোক। ভি-তে খেলে। টেম্পারামেন্টও ভাল। ওপেনার হিসেবে সফল তো হবেই। তবে একটাই বলার হল, ওকে আরও ধৈর্য ধরতে হবে। লাল বল ও সাদা বলে তফাত একটা তো আছেই। লাল বল বেশি মুভ করে। সাদা বল অতটা মুভ করে না। তাই লাল বলে শট মারতে হয় জোরে। বল বেশি দূরে যায় না। সাদা বলে কিন্তু কানায় লেগেও বল দূরে যায়। রোহিত যে ছক্কাগুলো মারে এই কারণেই সুবিধা হয়। কিন্তু লাল বলে অধিকাংশ সময়ই ও তুলে মারতে গিয়ে আউট হয়েছে।”
কিন্তু নতুন ভূমিকায় তো তুলে মারার দরকার তেমন নেই। ওপেনারকে নতুন বল যতটা সম্ভব ছেড়ে দিতে হয়। মানসিকতায় পরিবর্তন তাই জরুরি। কোচ শোনালেন, “ও তো মানসিক ভাবে শক্তিশালীই। এই পর্যায়ে মনের জোর না থাকলে কেউ সফল হতে পারে না। আর রোহিত তৈরিও থাকবে। জানে, যে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, তা পালন করতেই হবে।”
কোচ দীনেশ লাডের বিশ্বাস, মারাত্মক চাপ কাটিয়ে উঠবেনই রোহিত, করবেন রানও।
সমস্যা হল, এর আগে মিডল অর্ডারে নেমে পাঁচ দিনের ঘরানায় নিজের জায়গা পাকা করতে পারেননি হিটম্যান। ইডেনে টেস্ট অভিষেকের পর ছয় বছরে খেলেছেন মোট ২৭ টেস্ট। গড় ৪০ ছুঁই ছুঁই। তিন শতরানও রয়েছে। কিন্তু টি-টোয়েন্টি বা ওয়ানডে ফরম্যাটে তাঁর যে দাপট দেখা যায়, তা উধাওই থেকেছে রোহিতের ব্যাটে। তার উপর টেস্ট দলের মিডল অর্ডারে এখন ‘নো ভ্যাকেন্সি।’ পাঁচে অজিঙ্ক রাহানে, ছয় হনুমা বিহারীর জায়গা পাকাপোক্ত দেখাচ্ছে। আর সেই কারণেই মিডল অর্ডার থেকে ওপেনিংয়ে ঘটছে প্রমোশন। না হলে রোহিতের মতো প্রতিভাকে থাকতে হবে টেস্টের এগারোর বাইরে।
রোহিতের সঙ্গে যখনই টেস্ট নিয়ে আলোচনা হয়েছে, কোচ একটাই কথা বলেছেন। উইকেটে থাকতে হবে। দীনেশ লাডের মতে, “ওকে বারবার বলেছি, রোহিত, উইকেট ফেককে আতা হ্যায় তু। আর উইকেট ছুড়ে দিয়ে আসিস না। একটু থাকার চেষ্টা করিস। ওকেও এটা ভাবতে হবে। যদি একটু টিকে থাকে, সাফল্য আসবেই। ওর হাতে ভাল ড্রাইভ আছে, কাট-পুল ভাল মারে।” টেস্টে ওপেনার হিসেবে অভিষেক হচ্ছে ভারতে। এটাকে প্লাস পয়েন্ট হিসেবে দেখছেন তিনি। বলেছেন, “দেশের বাইরে ওপেনার হিসেবে নামতে হচ্ছে না। এটা ওর মস্ত সুবিধা। ভারতে উইকেট অতটা কঠিন থাকে না। বেশি সুইং হয় না। বল ব্যাটে আসে। চিন্তার কিছু নেই। রান পাবেই। সেই আশাই করছি।”
আরও পড়ুন: ‘বিরাট অনেকটা দাদার মতো’, বলছেন সৌরভের দলের সেরা পেস অস্ত্র
আরও পড়ুন: ধোনির সেই কান্না দেখে সামলানো কঠিন ছিল: চহাল
মিডল অর্ডার থেকে ওপেনিং ব্যাটসম্যান হতে চলেছেন রোহিত। আর তাই অবধারিত ভাবেই এসে পড়ছে বীরেন্দ্র সহবাগের নাম। আর এখানেই আপত্তি করছেন রোহিতের কোচ। দীনেশ লাডের যুক্তি, “সহবাগ অন্য ধরনের ব্যাটসম্যান। দু’জনের তুলনা হতেই পারে না। সহবাগের টেকনিক অন্যরকম ছিল। রোহিতের টেকনিকের সঙ্গে কোনও মিল নেই। খেলার স্টাইলেও তফাত রয়েছে দু’জনের। তুলনা তাই ভাল লাগছে না। সহবাগ জলদি শট খেলত। রোহিত কিন্তু প্রচুর সময় পায় শট নেওয়ার।”
রোহিত একদিনের ম্যাচেও একটু দেখে-শুনে খেলার পক্ষপাতী। নেমেই ঝড় তোলা নয়, ধীরে ধীরে গিয়ার পাল্টান তিনি। কোচ মনে করিয়ে দিয়েছেন, এটা কিন্তু টেস্ট খেলারই মানসিকতা। তা হলে রোহিত কেন টেস্টে নিজের জায়গা এতদিনে পাকা করতে পারলেন না? কেন তাঁকে ওপেনার হতে হচ্ছে টেস্টের এগারোয় আসার জন্য? কোচের বিশ্লেষণ, “রোহিত কিন্তু টেস্টে দুর্দান্ত বলে আউট হয়েছে এমন নয়। আসলে ও নিজের উইকেট বিপক্ষকে উপহার দিয়ে এসেছে অধিকাংশ সময়। এটাই মুশকিলের। ভাল বলে ও কদাচিৎ আউট হয়। বেশির ভাগ সময় ও তুলে মারতে গিয়ে ফিরেছে। অফস্পিনারকে মারতে গিয়ে ফিরেছে, লেগস্পিনারকে মারতে গিয়ে ফিরেছে। সাদা বল কিন্তু ব্যাটে লাগার পর দূরে যায়। লাল বলকে দূরে মারতে হয়। রোহিতকে এটা মাথায় রাখতে হবে। নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।”
একটা বিষয়ে কোচ অবশ্য আশাবাদী যে, ওপেন করছেন বলে বড় ইনিংসের সুযোগ থাকবে রোহিতের সামনে। দীনেশ লাডের মতে, “এতদিন টেস্টের মিডল অর্ডারে পরের দিকে নামত ও। অনেক সময়েই দ্রুত রান তোলার দরকার পড়ত। টেলএন্ডারদের নিয়েও ব্যাট করার ব্যাপার থাকত। এখন কিন্তু ও সময় পাবে। ম্যাচকে নিয়ন্ত্রণ করতেও পারবে।”
২ অক্টোবর থেকে বিশাখাপত্তনমে শুরু প্রথম টেস্ট। অর্থাৎ, দেবীপক্ষেই পরীক্ষায় বসছেন ওপেনার রোহিত। হিটম্যান যদি ম্যাচের কন্ট্রোল নিজের ব্যাটে নিতে না পারেন, তা হলে কিন্তু টেস্ট কেরিয়ার ফের নড়বড়ে দেখাবে।