জোড়া গোল করে ভারতকে বাঁচানো সবিতা পুনিয়ার লড়াই ও উত্থান। ফাইল চিত্র
২০০৩ সালের কথা। হকির প্রেমে তখন বুঁদ সবিতা পুনিয়া। এই খেলাকে ধরে বেঁচে থাকার জন্য মাত্র ১৩ বছর বয়সে হরিয়ানা গভর্নমেন্ট হকি নার্সারিতে ভর্তি হয়ে যান। শুরু হয় সুন্দর সিংহ খারাবের অধীনে অনুশীলন। তবে জোধকা গ্রাম থেকে রোজ বাসে চেপে হকি শিখতে যাওয়া তাঁর কাছে মোটেও জলভাত ছিল না। দুটি কিট ব্যাগ সব সময় তাঁর সঙ্গে থাকত। সেই দুটো বড় ব্যাগ বাসে চাপিয়ে যাতায়াত করতে তাঁকে অনেক অপমান হজম করতে হয়েছে। মাঝেমধ্যেই বাসের কনডাক্টারের কাছ থেকে বকুনি খেতেন। এক এক সময় তো কনডাক্টার মেজাজ হারিয়ে তাঁর কিটব্যাগে লাথিও মেরে দিতেন। তবুও কোনওদিন বাবা-মার কাছে নালিস করেননি সবিতা। পাছে তাঁর অনুশীলন বন্ধ হয়ে যায়।
সোমবার এই মেয়ের মনের জোরই ভারতীয় মহিলা হকি দলকে প্রথম বার অলিম্পিক্সের সেমি ফাইনালের টিকিট দিল। চলতি টোকিয়ো অলিম্পিক্সে শক্তিশালী অস্ট্রেলিয়াকে ১-০ ব্যবধানে হারিয়ে ইতিহাস গড়ল রানি রামপালের ভারত। ম্যাচের একেবারে শেষ দিকে অজিরা দুটো পেনাল্টি কর্নার আদায় করে। তবে লাভ হয়নি। সবিতা দাপটের সঙ্গে ঝাঁপিয়ে পড়ে দলের পতন রোধ করেন। তাঁর এমন লড়াকু মনোভাব দেখে ধারাভাষ্যকাররা বলতে বাধ্য হন, ‘ও ভারতীয় হকির জন্য দুটো গুরুত্বপূর্ণ গোল বাঁচাল।’
মেয়ের এমন লড়াকু মনোভাব দেখে ওঁর বাবা মহিন্দর সিংহ পুনিয়া অতীতে ফিরে গেলেন। বলছিলেন, “ছোটবেলা থেকেই সবিতা বাকিদের থেকে আলাদা মানসিকতার ছিল। প্রতিদিন অনুশীলনে যাওয়ার সময় ওর সঙ্গে দুটো কিট ব্যাগ থাকত। একটা ব্যাগে অন্যান্য জিনিসপত্র রাখত সবিতা। আর একটি ব্যাগে রাখত গোলকিপিং করার সাজ সরঞ্জাম। দুটি ব্যাগ নিয়ে বাসে চাপার জন্য ওকে অনেক অপমান হজম করতে হয়েছে। ও তখন সেই অপমান মানতে না পারলেও প্রতিবাদ করতে পারেনি। তবে এখন দেশের মান বাঁচিয়ে ও সেই লাঞ্ছনার জবাব দিচ্ছে।”
রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোভিন্দের কাছ থেকে অর্জুন পুরস্কার নিচ্ছেন সবিতা। ফাইল চিত্র
বাবা ওষুধের ব্যবসায়ী। ওঁর দাদু কৃষক। পরিবারের কেউ হকির সঙ্গে জড়িত না থাকলেও সবার এই খেলার প্রতি আলাদা টান ছিল। সময় পেলেই সবিতার দাদু রেডিয়োতে হকি ম্যাচের ধারাবিবরণী শুনতেন। হকির প্রতি ভালবাসা তৈরি হওয়ার সেটা বড় কারণ। তবে সবিতা কিন্তু গোলরক্ষক হতে চাননি। বরং স্ট্রাইকার হতে চেয়েছিলেন ২০১৮ সালের অর্জুন পুরস্কার জয়ী। তবে শেষ পর্যন্ত দাদু ও ছোটবেলার প্রশিক্ষকের ইচ্ছাকে প্রাধান্য দিয়েছিলেন।
সুন্দর সিংহ খারাবের প্রতিক্রিয়া, “আমার বেশ মনে আছে, প্রথম দিন মাঠে আসার পর সবিতার বাবা বলেছিল, ‘আমার মেয়েকে ভাল স্ট্রাইকার কিংবা মিডফিল্ডার তৈরি করুন।’ তবে যত দিন এগিয়েছে তত দেখেছি যে ও গোলরক্ষক হিসেবে বেশি ভাল খেলছে। ওর দৃষ্টিশক্তি, গোল বাঁচানোর দক্ষতা শুরু থেকেই ছিল আন্তর্জাতিক মানের। সেটা সবিতা ও মহিন্দর সিংহকে বোঝাতে সমস্যা হয়নি। সেই ফল এত দিনে পাওয়া গেল।”
গোলরক্ষক হিসেবে অনুশীলন শুরু করা বেশ কঠিন ছিল। কারণ সেই সময় সবিতার বাবা আর্থিক দিক থেকে স্বচ্ছল ছিলেন না। তাছাড়া যেখানে হকি প্রশিক্ষণ নিতেন, সেখানে ইতিমধ্যে রয়েছে দুই গোলরক্ষক। সংস্থার তরফ থেকে দেওয়া দুটি কিট অন্য মেয়েরা ব্যবহার করত। তবে সুন্দর সিংহের তাঁর ছাত্রীর প্রতি আস্থা ছিল। তাই সেই সময় ১৭ হাজার টাকা দিয়ে সবিতার জন্য নতুন সরঞ্জাম কিনে দেন তিনি।
অজিদের বিরুদ্ধে নামার আগে সতীর্থদের সঙ্গে জাতীয় সঙ্গীত গাইছেন সবিতা। ছবি - টুইটার
গর্বিত বাবা মহিন্দর সেই জন্য সুন্দর সিংহের কাছে কৃতজ্ঞ। বলছিলেন, “সুন্দর সিংহ আমাদের পাশে না দাঁড়ালে মেয়েটার হকি খেলা হতো না। সবিতাও ওর কোচের বিশ্বাসের দাম দিয়েছে। দুটো কিট ব্যাগকে সব সময় নিজের কাছে আগলে রাখত। মনে করত কিট ব্যাগ ও এই খেলাকে সম্মান করলেও, একদিন হকি প্রাপ্য সম্মান ফিরিয়ে দেবে। তাই তো হল।”
সবিতা ছোট থেকে আর্থিক কষ্ট দেখেছেন। তাই আর্থিক দিক থেকে পিছিয়ে যাওয়া কোনও প্রতিভাবান খেলোয়াড় দেখলেই তাদের সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসেন সবিতা। এমনটাই জানালেন তাঁর মা লীলাবতী পুনিয়া। তিনি বলছিলেন, “আমরা সবাই ওর গলায় অলিম্পিক্সের পদক দেখতে চাই। তবে পদক না পেলেও আমাদের আফসোস নেই। কারণ গ্রামের আর্থিক কষ্টে থাকা অনেকে ছেলে-মেয়েকে ও খেলার জিনিস দিয়ে সাহায্য করে। মেয়ের এই কাজের জন্যও আমরা গর্বিত।”