একান্ত আলাপচারিতায় টোকিয়োয় ইতিহাস গড়া জাতীয় গর্ব নীরজ চোপড়া
Tokyo Olympics 2020

Neeraj Chopra: এই সোনার পদক শুধু  আমার নয়, সারা দেশের

খেলোয়াড় জীবনের শুরু দিনগুলোতে ওঁর ভিডিয়ো দেখেই কী ভাবে জ্যাভলিন ছুড়তে হয়, অনুকরণ করার চেষ্টা করেছি।

Advertisement

সুমিত ঘোষ

কলকাতা শেষ আপডেট: ১২ অগস্ট ২০২১ ০৮:১৫
Share:

ঐতিহাসিক: অলিম্পিক্সে নীরজের নজির গড়ে সোনা জয় বিশ্বমঞ্চে নতুন স্বপ্ন দেখাচ্ছে ভারতকে। ফাইল চিত্র।

সারা দেশকে আবেগে ভাসিয়ে টোকিয়ো অলিম্পিক্স থেকে সোনা জিতে ফিরছেন তিনি। মিলখা সিংহ ও পি টি ঊষাদের ট্র্যাক অ্যান্ড ফিল্ড ইভেন্টে ভারতের প্রথম সোনা। সর্বকালের সেরা ভারতীয় ক্রীড়াবিদদের তালিকাতেও তাঁর নাম ঢুকে পড়েছে। সারা বিশ্বে তাঁর জয়গান চলছে। এখনই দাবি উঠে গিয়েছে বায়োপিক করার। আর তিনি, জ্যাভলিনে সোনা জেতা জাতীয় নায়ক টোকিয়ো থেকে দেশে ফিরে বসার সময়টুকুও পাচ্ছেন না। তাঁকে নিয়ে এতটাই উন্মাদনা। এতটাই টানাটানি। এবং একের পর এক সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের ডাক। এই চরম ব্যস্ততার মধ্যেই সময় বার করে বুধবার রাতে নতুন জাতীয় গর্ব নীরজ চোপড়া একান্ত সাক্ষাৎকার দিলেন আনন্দবাজারকে। ঐতিহাসিক সোনা জয়ের মুহূর্তের সেই অনুভূতি থেকে শুরু করে পানীপতের ছেলের নাটকীয় যাত্রাপথের কাহিনি, সব কিছু নিয়েই উজাড় করে দিলেন মনের কথা।

Advertisement

প্রশ্ন: চ্যাম্পিয়ন, কিংবদন্তি অনেক অভিনন্দন। সোনা জয়ের ঠিক পরের অনুভূতি কী ছিল?

নীরজ চোপড়া: সেই সময় যেন কিছুই অনুভব করতে পারিনি। মনে হচ্ছিল, একটা স্বপ্ন পূরণ হয়েছে। অদ্ভুত একটা অনুভূতি হচ্ছিল। এর আগে যত বার পদক জিতেছি, তার চেয়ে এ বারের অনুভূতিটা একেবারে আলাদা।

Advertisement

প্র: ভারতীয় ট্র্যাক অ্যান্ড ফিল্ড ইতিহাসে প্রথম এবং সামগ্রিক ভাবে অলিম্পিক্স থেকে আমাদের দ্বিতীয় সোনা। এই সাফল্যকে কী ভাবে আপনি ব্যাখ্যা করবেন?

নীরজ: দেশের জন্য এই পদক জেতাটা অত্যন্ত প্রয়োজনীয় ছিল। ট্র্যাক অ্যান্ড ফিল্ডে একটা পদকের জন্য আমরা দীর্ঘ দিন ধরে অপেক্ষা করে ছিলাম। অবশেষে সোনা এল। দেশের জন্য কিছু করতে পেরেছি বলে আমি নিজেকে ভাগ্যবান মনে করি। দারুণ আনন্দ হচ্ছে। শুরুটা আমি খুব ভাল করেছিলাম। আশা করছি, ভবিষ্যতে অন্যান্যরা বিশেষ করে, যে শিশুরা অ্যাথলিট হতে চায় তাদের প্রেরণা জোগাবে। এবং ভাল ফল হবে।

প্র: দীর্ঘ প্রতীক্ষার পরে দেশের সামনে সেই স্মরণীয় মুহূর্তটা এসেছিল। যখন আপনি পোডিয়ামে বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। সোনার পদক গলায় পরে এবং জাতীয় সঙ্গীত শুনে কী অনুভূতি হয়েছিল?

নীরজ: যোগ্যতা অর্জন পর্বের পর থেকেই আমার মধ্যে ইতিবাচক মানসিকতা তৈরি হয়েছিল। কারণ, জ্যাভলিন আমি দারুণ ছুড়েছিলাম। বলা যেতে পারে, খুব একটা কষ্ট করতে হয়নি। যদিও ৮৬ মিটারের বেশি জ্যাভলিন ছোড়ার জন্য একটু পরিশ্রম তো করতেই হয়। তবে শারীরিক ভাবে সে রকম ক্লান্তি অনুভব করিনি। তখনই মনে হচ্ছিল, ফাইনালে ভাল করব। তবে ফাইনালে আমার মুখ দেখে অনেকেরই মনে হয়েছিল, খুবই চাপমুক্ত ও শান্ত। কিন্তু আমার মনের মধ্যে সেই সময় অনেক কিছু ঘটে চলেছিল। শান্ত থাকার অন্যতম কারণ, ভাল ছুড়তে পারার আত্মবিশ্বাস আমার মধ্যে ছিল। পোডিয়ামের মাঝখানে গলায় সোনার পদক ঝুলিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছি। ধীরে ধীরে তেরঙ্গা উঠছে এবং জাতীয় সঙ্গীত বাজছে, তখন মনে হয়েছিল যাবতীয় প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করেই এই পদক আমি জিতেছি। মন থেকে সব ক্লান্তি উধাও হয়ে গিয়েছিল। সত্যি বলতে, সেই সময়ের অনুভূতি কখনও ভাষায় ব্যক্ত করা যায় না।

প্র: বিশ্বের শ্রেষ্ঠ ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় আপনি শুরু থেকেই আত্মবিশ্বাসী শান্ত ছিলেন। এর রহস্যটা কী?

নীরজ: বারবারই মনে হচ্ছিল, সেরা থ্রো-টা করতে পারব সেদিন। সত্যি কথা বলতে, সোনা জেতার ব্যাপারে নিয়ে খুব একটা চিন্তা-ভাবনা করিনি। বার বারই মনে হচ্ছিল, অনেক কিছুই ঘটে যেতে পারে। কারণ, অন্যান্য যে ভাল প্রতিদ্বন্দ্বীরা রয়েছে, তারা সেরা আটের লড়াই থেকে ছিটকে গিয়েছে। শেষ থ্রো করতে যাওয়ার আগেও চিন্তা হচ্ছিল। কারণ, চেক প্রজাতন্ত্রের অ্যাথলিট খুবই ভাল ছিল। তাই ঠিক করেছিলাম, লক্ষ্য পূরণ হওয়ার আগে কোনও উৎসব করব না।

প্র: ভারত বনাম ইংল্যান্ড টেস্টের ধারাভাষ্য দেওয়ার মধ্যেই সুনীল গাওস্কর ‘মেরে দেশ কি ধরতি’ গান গেয়ে উৎসবে মেতেছিলেন। আপনার কেমন লেগেছে?

নীরজ: আমার খুব ভাল লেগেছে। শুনেছি এবং ভিডিয়োয় দেখেছি, শুধু সুনীল গাওস্করজি নন, আরও অনেকেই উৎসবে মেতে উঠেছিলেন। জিতেছিলাম আমি। কিন্তু পুরো দেশ যে ভাবে আনন্দে মাতোয়ারা হয়েছিল, তখন মনে হচ্ছিল এই পদক আমার একার নয়, গোটা দেশের। তাই যখনই সোনার পদটা দেখি, উপলব্ধি করি সকলের শুভেচ্ছা এবং আশীর্বাদ আমার সঙ্গে ছিল।

প্র: পানীপত থেকে পোডিয়ামের যাত্রা কী ভাবে ব্যাখ্যা করবেন?

নীরজ: শুরুর যাত্রাটা মসৃণ ছিল না। গ্রাম থেকে দীর্ঘ বাসযাত্রা করে স্টেডিয়ামে পৌঁছতে হত। সেই সময় ভাল মানের জ্যাভলিনও ছিল না আমার কাছে। কয়েক দিন অনুশীলনের পরে যখন ফল ভাল হতে শুরু করল, রাজ্যের হয়ে জাতীয় পর্যায়ে প্রতিনিধিত্ব করলাম। জুনিয়র পর্যায়ে পদক পেতে শুরু করলাম। আমি সেই সময় নিজের অনুশীলনের উপরেই সব চেয়ে বেশি জোর দিয়েছিলাম। ধীরে ধীরে জাতীয় শিবিরে ডাক পেলাম। তার পরে সিনিয়র পর্যায়ে বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় নামলাম। জ্যাভলিন থ্রোয়ের যে লক্ষ্য সামনে রেখেছিলাম, ধীরে ধীরে এগোতে শুরু করলাম। তাই শুরুতে সমস্যা হলেও পরে ঠিক দিশা পেয়ে গিয়েছিলাম। আমি সেই পথ ধরেই এগিয়ে গিয়েছি।

প্র: চোটের সেই দিনগুলি কতটা কঠিন ছিল? সেই সময় নিবিড় অনুশীলন আত্মত্যাগ নিয়ে যদি কিছু বলেন। এবং তখন কোচ আপনার পরিবারের সদস্যদের ভূমিকা কতটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল?

নীরজ: চোট পাওয়ার পরে প্রথম দিকে খুব সমস্যা হচ্ছিল। অস্ত্রোপচারের পরে বারবারই মনে হচ্ছিল, কী ভাবে ফিরে আসতে পারব। মনে মনে ভয় পাচ্ছিলাম যে চোট সারতে কত দিন সময় লাগবে। কারণ, আমার লক্ষ্য ছিল বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপ। যদিও শেষ পর্যন্ত আমি ট্র্যাকে নামতে পারিনি। অলিম্পিক্সও খুব কাছে চলে এসেছিল। ঠিক হয়ে যাব এই আত্মবিশ্বাস থাকলেও জানতাম না, কী ভাবে অলিম্পিক্সের জন্য নিজেকে তৈরি করব। শেষ পর্যন্ত অলিম্পিক্স পিছিয়ে যায়। যদিও সেই সময় আমার প্রস্তুতি খুব ভালই হয়েছিল। জানুয়ারিতেই আমি অলিম্পিক্সের যোগ্যতা অর্জন করে ফেলেছিলাম। তখনই বুঝে গিয়েছিলাম, আমি সুস্থ হয়ে গিয়েছি। অলিম্পিক্সের জন্য তৈরি।

প্র: অলিম্পিক্সে পদকের স্বপ্ন দেখা অ্যাথলিট খেলোয়াড়দের জন্য আপনার পরামর্শ কী?

নীরজ: ধৈর্য থাকা সব চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। খেলাধুলো শুরু করার পরেই আমাকে সোনা জিততে হবে ভেবে অতিরিক্ত পরিশ্রম করলে চোট পাওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যাবে। সব চেয়ে বিপজ্জনক হল, রাতারাতি সাফল্য পাওয়ার জন্য বাড়তি ঝুঁকি নেওয়ার প্রবণতা। ধাপে ধাপে এগোন উচিত। রাজ্য ও জাতীয় পর্যায়ে প্রতিযোগিতায় নামা উচিত। অথবা, কোনও আন্তর্জাতিক জুনিয়র প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়া। তার পরে অলিম্পিক্সের কথা ভাবতে হবে। তবে অবশ্যই এই স্বপ্ন দেখা দরকার যে, আমাকে দেশের জন্য কিছু করতে হবে। কিন্তু তার জন্য রাতারাতি ফল পাওয়ার চেষ্টা না করাই বাঞ্ছনীয়।

প্র: আপনার আদর্শ কে? কাকে দেখে তৈরি করেছেন নিজেকে?

নীরজ: চেক প্রজাতন্ত্রের জ্যাভলিন থ্রোয়ার ইয়ান জ়েলেজ়িনি। খেলোয়াড় জীবনের শুরু দিনগুলোতে ওঁর ভিডিয়ো দেখেই কী ভাবে জ্যাভলিন ছুড়তে হয়, অনুকরণ করার চেষ্টা করেছি।

প্র: এই সাফল্যের নেপথ্যে কাদের ভূমিকার কথা বলতে চান?

নীরজ: আমার এই অভিযানে অনেকের প্রচুর অবদান রয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম আমার কোচ ক্লাউস বার্তোনিজ়। ফিজিয়ো ঈশান মারওয়াহা। এ ছাড়াও সাই, টপস, জাতীয় অ্যাথলেটিক সংস্থা, ভারতীয় সেনাবাহিনী এবং আমার স্পনসর জেএসডব্লিউ স্পোর্টস। চোটের সময় পাশে দাঁড়ানো থেকে বিদেশে ট্রেনিং করতে পাঠানো, নানা ব্যাপারে উদ্যোগ নিয়েছে জেএসডব্লিউ।

প্র: সামনে কী? বাড়ি ফিরে কী করবেন?

নীরজ: বাড়ি ফিরে মায়ের রান্না প্রিয় পদগুলি খাব। আমার বিশেষ পছন্দ চুরমা তো থাকবেই। কয়েক দিন এখন উৎসব চলবে। তার পরে অনুশীলন শুরু করব। এই বছরে আর কোনও প্রতিযোগিতা থাকলে তাতে অংশ নেওয়ার চেষ্টা করব। না হলে আগামী বছর এশিয়ান গেমস, কমনওয়েলথ গেমস ও বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে নামব।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement