গুরজিতের গোলে ইতিহাস ভারতের। ছবি টুইটার
উচ্চশিক্ষার জন্য বাড়ি থেকে বেশ অনেকটা দূরে বোর্ডিং স্কুলে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন বাবা। কিন্তু পড়াশুনার বদলে মেয়ে হাত পাকাতে শিখল হকিতে। ধীরে ধীরে হয়ে উঠল ভারত এবং বিশ্বের অন্যতম সেরা ড্র্যাগ ফ্লিকার। সেই গুরজিৎ কৌরের গোলেই অস্ট্রেলিয়াকে হারিয়ে ইতিহাস গড়ে অলিম্পিক্স হকির সেমিফাইনালে ভারত।
আধুনিক হকিতে ড্র্যাগ ফ্লিকারের গুরুত্ব অপরিসীম। যে কোনও দলই এক বা একাধিক ড্র্যাগ ফ্লিকার নিয়ে খেলতে নামে। ফুটবল ভাল ফ্রিকিক মারতে পারা খেলোয়াড়ের যতটা গুরুত্ব, হকিতে ড্র্যাগ ফ্লিকের ক্ষেত্রেও ব্যাপারটা একই। এখানেও পায়ের জঙ্গল থেকে বল জড়াতে হয় জালে।
ভারতের মহিলা হকি দলে সেই একমাত্র ড্র্যাগ ফ্লিকার হলেন গুরজিৎ। বাকি সব বিভাগে উন্নতি করলেও এখনও পর্যন্ত প্রতিভাবান ড্র্যাগ ফ্লিকার নেই ভারতীয় দলে। গুরজিৎ একাই দীর্ঘদিন ধরে সেই দায়িত্ব পালন করছেন।
পঞ্জাবের অমৃতসরের মিয়াদি কলন গ্রামে ১৯৯৫ সালের ২৫ অক্টোবর জন্ম গুরজিতের। বাবা সতনাম সিংহ কৃষক। মা হরজিন্দর কৌর ঘরের দায়িত্ব সামলান। সতনামের কাছে বরাবরই লেখাপড়া বেশি গুরুত্ব পেয়েছে। ভাল মানের শিক্ষা দিতে বড় মেয়ে প্রদীপ এবং গুরজিৎকে ১৩ কিমি দূরের বিদ্যালয়ে ভর্তি করেন। রোজ দুই মেয়েকে সাইকেলে চাপিয়ে স্কুলে নিয়ে যেতেন। সারাদিন বাইরে অপেক্ষা করতেন। দিনের শেষে তাদের নিয়ে বাড়ি ফিরতেন।
কিছুদিন চলার পরেই সতনাম বুঝতে পেরেছিলেন এ ভাবে বেশিদিন এগোনো যাবে না। তাই ৭০ কিমি দূরে তর্ণ তারণ জেলার কাইরনের একটি বোর্ডিং স্কুলে দুই মেয়েকে ভর্তি করে দেন। ঘটনাচক্রে সেই স্কুল ছিল মহিলাদের হকি খেলার আখড়া। বহু খেলোয়াড় উঠে এসেছেন সেই স্কুল থেকে। সেখানেই হকির সঙ্গে পরিচয় গুরজিতের।
ভাল খেলার সুবাদে সরকারি প্রকল্পের আওতায় চলে আসেন দুই বোন। নিখরচায় থাকা-খাওয়ার সংস্থান হয়ে যায়। ২০১১ পর্যন্ত সেই স্কুলে পড়ার পর খেলার উন্নতি এবং প্রশিক্ষণের জন্য লিয়ালপুর খালসা কলেজে চলে যান গুরজিৎ। এখানেই ড্র্যাগ ফ্লিকিংয়ের ব্যাপারে অতিরিক্ত মনোযোগ দিতে শুরু করেন। ক্রীড়াক্ষেত্রে কোটায় ভারতীয় রেলে সরকারি চাকরিও পেয়ে যান তিনি।
জয়ের পর নিজস্বী। ছবি রয়টার্স
২০১৪ সালে প্রথম বার জাতীয় শিবিরে ডাক। তবে প্রথম তিন বছর সে ভাবে খেলার সুযোগ পাননি। ২০১৭ থেকে পাকাপাকি সদস্য হয়ে যান। ড্র্যাগ ফ্লিক করার ক্ষমতাই তাঁকে দলে জায়গা করে দেয়। এক সাক্ষাৎকারে গুরজিৎ বলেছেন, “ড্র্যাগ ফ্লিক করতে ভাল লাগত। প্রথমে শুধু অনুশীলন করতাম। জাতীয় শিবিরে এসে টেকনিক রপ্ত করি। কিন্তু আন্তর্জাতিক মঞ্চের জন্য সেটা যথেষ্ট ছিল না।”
এরপরে ২০১৭-য় নেদারল্যান্ডস সফরে গিয়ে ড্র্যাগ ফ্লিকের গুরু টুন সিয়েপম্যানের থেকে ভাল করে প্রশিক্ষণ নেন গুরজিৎ। সাক্ষাৎকারে বলেছেন, “আমার ছোটখাটো অনেক ভুল দায়িত্ব নিয়ে শুধরে দিয়েছেন উনি। ফুটওয়ার্ক, কোমরের অবস্থান-সহ বিভিন্ন জায়গায় গণ্ডগোল ছিল। ওঁর কাছে শেখার পর সবকিছুতে বদল আসে।”
সাহায্য করেছিলেন তাঁর এখনকার কোচ শোয়ার্ড মারিনও। তিনি গুরজিৎকে হকি স্টিক বদলাতে বলেন। কারণ যে স্টিক গুরজিৎ ব্যবহার করতেন তা খুবই হালকা। ড্র্যাগ ফ্লিক নেওয়ার পক্ষে আদর্শ নয়।
২০১৮-এর এশিয়ান গেমসে দুরন্ত খেলেছিলেন। জাপানে এফআইএইচ সিরিজ ফাইনালসের ভারতের সর্বোচ্চ গোলদাতা হয়েছিলেন। এ বার গুরজিতের হাত ধরেই হকিতে নতুন ইতিহাস তৈরি করল ভারত।