কীর্তিমান: প্রজ্ঞানন্দকে নিয়ে চর্চা অব্যহত ক্রীড়া মহলে। টুইটার
চেন্নাইয়ে নিজের বাড়িতে রাত জেগে ম্যাগনাস কার্লসেনের সঙ্গে ম্যাচ না খেলে আর কিছুদিন পরেই ব্যাঙ্কের চাকরির পরীক্ষায় বসতেই পারত আর প্রজ্ঞানন্দ। নিজের ব্যাঙ্ক অফিসার বাবার মতো। কেমিক্যাল ফ্যাক্টরির কর্মীর পুত্র নাগপুরের রৌনক সাগওয়ানির তো রসায়ন নিয়ে পড়াশোনা করার কথা। কেরলের নিহাল সারিন, তেলঙ্গানার অর্জুন এরিগেইসি, চেন্নাইয়ের দোমারাজু গুকেশ— মেডিক্যাল পেশায় গেলেই যেন স্বাভাবিক কিছু ঘটত। কারণ ওদের তিন জনেরই বাবা রীতিমতো বড় ডাক্তার। নিহালের তো মা-ও।
ভাবলে অবাক হতে হয়, কুড়ির কম বয়সি এই পাঁচ জনই এখন ২৬০০-র উপরে এলো রেটিংয়ে থাকা ভারতীয় দাবাড়ু। গুকেশ যেমন ১২ বছর ৭ মাস ১৭ দিন বয়সে গ্র্যান্ডমাস্টার হয়েছে। অর্জুন চমকে দিয়েছে টাটা স্টিল চ্যালেঞ্জারের মতো কঠিন টুর্নামেন্টে চ্যাম্পিয়ন হয়ে। নিহাল সবচেয়ে কম বয়সে বিশ্বকাপ খেলে ফেলেছে। কমনওয়েলথে চ্যাম্পিয়ন রৌনকও। প্রজ্ঞা তো বিশ্বচ্যাম্পিয়নকেও হারিয়ে এখন খবরের শিরোনামে।ওদের দেখে নিজের ছোটবেলার কথাও ভাবি। একটা সময় বন্ধুদের কোনও অভিভাবকও চাইতেন না তাঁদের ছেলে আমার সঙ্গে মিশুক। যদি দাবায় নেশাগ্রস্ত হয়ে ওঠে? দাবা তখনও ওই তাস-পাশার মতো সর্বনাশা। যা নিয়ে থাকে চায়ের দোকানের আড়ালে বসা ‘আধ-বুড়োরা’। এখন ঠিক উল্টো ছবি।
কার্লসেনের মতো বিশ্বচ্যাম্পিয়নকে প্রজ্ঞা যে হারিয়ে দিল, সেটাকে অনেকে ‘ফ্লুক’ বলে খাটো করতে চান স্রেফ অজ্ঞতার জন্য। তাঁরা জানেনও না, দাবায় ভারতও এখন ‘সুপার পাওয়ার’। ফিডে ক্রমতালিকায় পুরুষদের মধ্যে আমরা এখন রাশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, চিন, ইউক্রেনের পরেই। কীসের ভিত্তিতে এই তালিকা, সেটাও বলতে হয়। ভারতের প্রথম দশ জন দাবাড়ুর গড় রেটিংয়ের হিসাব করে। মেয়েরা রয়েছে তিনে।
যাঁরা প্রজ্ঞার সাফল্যকে ‘দুর্ঘটনা’ বলে লঘু করতে চান, তাঁদের বলব আগামী দিনে নিহাল, অর্জুন, রৌনাক, দোমারাজুদের কাছেও কিন্তু যে কেউ হেরে যেতে পারে। এমনকি কার্লসেনও। আমাকে ইউরোপের তাবড় গ্র্যান্ডমাস্টাররা খোলাখুলিই বলেছেন, ওরা এখন ভারতে খেলতে আসতে ভয় পায়। বলেন এখানকার বাচ্চাদের কাছে হেরে রেটিং খারাপ হতে পারে।
কিন্তু শুধু তো প্রতিভায় হয় না। তার সঙ্গে লাগে নিরলস চর্চা আর পড়াশুনো। এবং যোগ্যতম গুরু। বাড়তি প্রাপ্তি অনলাইন প্রশিক্ষণ। প্রজ্ঞাদের জন্য আছে বিশ্বনাতন আনন্দের মতো স্থায়ী মেন্টর।
তা ছাড়া প্রচুর স্পনসর আসায় ওদের কাছে বিদেশে খেলতে যাওয়া এখন জলভাত। তা-ই রেটিং বা এলো পয়েন্ট ওরা বাড়িয়ে নিচ্ছে অনায়াসে নিজেদের দক্ষতার জোরে।
এখন বাবা-মা’রাও ছেলেমেয়েদের দাবায় ঠেলে দিচ্ছে। সবাই জেনে গিয়েছেন, ডাক্তার বা অধ্যাপকের থেকে কোনও অংশে কম নয় ঝানু পেশাদার দাবাড়ু হওয়ার বৈষয়িক লাভ। দাবায় এখন তাই ‘নূতন যৌবনেরই’ বেড়া ভাঙার সময়। প্রজ্ঞারা সত্যিই বিদ্যুৎ। ওদের সাফল্যকে ‘ফ্লুক’ ভাবার ভুল করবেন না। আরও বড় বিস্ময়ের জন্য প্রহর গুনুন।