কেন এই বিদ্রোহী সুপার লিগ?

ফুটবলবিশ্বে তোলপাড় ফেলে ঘোষণা করা হয়েছে, নতুন লিগ আসছে। যার নাম ইউরোপীয় সুপার লিগ। সব চেয়ে নামী ১২টি ক্লাব এই বিদ্রোহী লিগে খেলবে বলে সম্মতি দিয়ে দিয়েছে।

Advertisement

নিজস্ব প্রতিবেদন

শেষ আপডেট: ২১ এপ্রিল ২০২১ ০৭:৫৬
Share:

নজরে: ইউরোপের সেরা ১২টি ক্লাব এখনও পর্যন্ত সম্মতি দিয়েছে সুপার লিগে খেলার। রয়টার্স

Advertisement

ফুটবলবিশ্বে তোলপাড় ফেলে ঘোষণা করা হয়েছে, নতুন লিগ আসছে। যার নাম ইউরোপীয় সুপার লিগ। সব চেয়ে নামী ১২টি ক্লাব এই বিদ্রোহী লিগে খেলবে বলে সম্মতি দিয়ে দিয়েছে। কারা এই উদ্যোগের নেপথ্যে? ফুটবল দুনিয়ায় এর কী প্রভাব পড়তে চলেছে? নানা প্রশ্নের উত্তর খুঁজল আনন্দবাজার...

Advertisement

সুপার লিগ কী?

গত এক দশক ধরেই ভিতরে ভিতরে এমন একটি লিগের পরিকল্পনা চলছে। কার্যত ফুটবল প্রতিষ্ঠানগুলির বিরুদ্ধে গিয়ে বিদ্রোহী লিগের ভাবনা। চ্যাম্পিয়ন্স লিগের আদলে ইউরোপের শক্তিশালী ফুটবল দেশগুলির লিগে খেলা সেরা দলগুলি যেখানে খেলবে। এত দিন শুধু পরিকল্পনার স্তরেই ছিল। গত রবিবার ভারতীয় সময় অধিক রাতে ঘোষণা করা হয়, দ্রুতই এ বার ইউরোপীয় সুপার লিগ আসছে।

নতুন লিগে কারা খেলবে?

এখনও পর্যন্ত ১২টি দল সম্মতি দিয়ে দিয়েছে। স্পেন থেকে রিয়াল মাদ্রিদ, বার্সেলোনা, আতলেতিকো দে মাদ্রিদ, ইংল্যান্ড থেকে ম্যাঞ্চেস্টার ইউনাইটেড, ম্যাঞ্চেস্টার সিটি, লিভারপুল, চেলসি, আর্সেনাল, টটেনহ্যাম হটস্পার, ইটালি থেকে জুভেন্টাস, ইন্টার মিলান, এসি মিলান। এরা প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। শোনা যাচ্ছে, দ্রুতই ইউরোপের আরও তিনটি নামী ক্লাব যোগ দিচ্ছে।

কারা হতে পারে বাকি ক্লাব?

প্যারিস সাঁ জারমাঁ এবং পোর্তোর নাম ভাসছিল, তবে তারা জানিয়েছে বিদ্রোহী লিগে যোগ দিচ্ছে না। আয়োজকেরা বায়ার্ন মিউনিখের জন্য ঝাঁপিয়েছেন। কিন্তু জার্মানির অন্য নামী ক্লাব বরুসিয়া ডর্টমুন্ডের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, তারা এর মধ্যে নেই, বায়ার্নও যোগ দেবে না। এই ১৫টি দলের সঙ্গে আরও পাঁচটি ক্লাব যুক্ত হয়ে মোট ২০টি দলের প্রতিযোগিতা হবে।

কী পদ্ধতিতে খেলা হবে?

মোট ২০টি দলকে দু’টি গ্রুপে ভাগ করা হবে। চ্যাম্পিয়ন্স লিগের মতোই ‘হোম অ্যান্ড অ্যাওয়ে’ পদ্ধতিতে খেলা হবে। প্রত্যেক গ্রুপের প্রথম তিনটি দল কোয়ার্টার ফাইনালে যাবে। চতুর্থ এবং পঞ্চম স্থানাধিকারী চারটি দলের মধ্যে প্লে-অফ হবে এবং সেখান থেকে আরও দু’টি দল যোগ্যতা অর্জন করে শেষ আটের বাকি দু’টি স্থান পূরণ করবে। তার পর ফাইনাল পর্যন্ত সব দ্বৈরথই দুই লেগের নক-আউট পর্ব।

পদ্ধতিতে তফাত কী?

যোগ্যতা অর্জনের কোনও ব্যাপার থাকছে না। প্রত্যেক দেশের লিগে টেবলের শীর্ষে থাকা দলেরা চ্যাম্পিয়ন্স লিগে খেলার যোগ্যতা অর্জন করে। সুপার লিগে সে সবের বালাই থাকছে না। প্রধান ১৫টি দল প্রত্যেক বছরই খেলবে। আর্সেনাল যেমন ২০১৬-’১৭ মরসুম থেকে চ্যাম্পিয়ন্স লিগের যোগ্যতামান অর্জন করতে পারেনি। কিন্তু নতুন লিগে তাদের অংশগ্রহণ সব বছরেই নিশ্চিত।

কারা আছে নেপথ্যে?

রিয়াল মাদ্রিদের প্রেসিডেন্ট ফ্লোরেন্তিনো পেরেজ়কে পাণ্ডা মনে করা হচ্ছে। তিনিই বিদ্রোহী লিগের প্রধান নির্বাচিত হয়েছেন। তবে ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের বড় ক্লাবগুলি এখন মার্কিন মালিকদের হাতে। ম্যাঞ্চেস্টার ইউনাইটেড, লিভারপুল, আর্সেনালের প্রধান মালিকেরা মার্কিন ধনকুবের। লগ্নিকারী হিসেবে শোনা যাচ্ছে মার্কিন ব্যাঙ্ক জেপি মর্গ্যানের নাম। এটা নতুন মার্কিন অভিযান কি না, তা নিয়ে গবেষণা শুরু হয়েছে।

অসন্তোষ: অ্যানফিল্ডের বাইরে সুপার লিগ নিয়ে প্রতিবাদ লিভারপুলের সমর্থকদের রয়টার্স

এই দলগুলি কি তাদের দেশের লিগে খেলতে পারবে?

তারা নিশ্চয়ই খেলতে চায় এবং প্রয়োজনে আইনি পদক্ষেপ করার কথাও শুনিয়েছে। তবে সেই দেশের লিগ কর্তৃপক্ষ বহিষ্কারের হুমকি দিয়েছে।

অর্থের টোপই কি কারণ?

এ নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই। ইউরোপের বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, প্রত্যেকটি দলকে শুরুতেই ৪০০ মিলিয়ন ডলার (ভারতীয় মুদ্রায় ৩০১৬ কোটি) করে দেওয়া হবে, যাতে শক্তিশালী আর্থিক পরিকাঠামো গড়ে তোলা যায়। বায়ার্ন মিউনিখ শেষ বার চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জিতে যা পেয়েছিল, এই অর্থ তার চার গুণ! এবং, এটা শুধুই শুরু। এর পরে রেকর্ড মূল্যে টিভি স্বত্ব বিক্রি হওয়াটা শুধু সময়ের ব্যাপার।

অর্থ নিয়ে উষ্মার কারণ?

বড় ক্লাবগুলি মনে করে, টিভি স্বত্ব থেকে তাদের আরও বেশি অর্থ পাওয়া উচিত। ছোট ক্লাবের সঙ্গে ভাগ-বাঁটোয়ারা করতে হচ্ছে বলে প্রাপ্ত অর্থ যথেষ্ট নয় বলে তাদের মত। সুপার লিগে বাছাই করা সব সেরা দলগুলি খেলবে, তাই টিভি স্বত্বের দর আরও বাড়বে। ক্লাবগুলির প্রাপ্ত অর্থের অংশও অনেক বেশি হবে। তার সঙ্গে বিজ্ঞাপন থেকে আসা বিপুল অর্থও যোগ হবে।

আইনি পদক্ষেপ কী হবে?

এই ১২টি ক্লাবকে সব স্বীকৃত লিগ এবং চ্যাম্পিয়নশিপ থেকে নির্বাসিত করার ব্যাপারে উয়েফা অনড়। তারা এমনও দাবি তুলেছে যে, বিশ্বকাপ থেকেও নির্বাসিত করা হোক এই ক্লাবগুলিতে খেলা ফুটবলারদের। কিন্তু খেলোয়াড়ের প্রাথমিক অধিকার খেলা। জীবিকা নির্বাহের পথ। সেই রোজগারে এ ভাবে বাধা দেওয়া যায় কি না, তা নিয়ে দীর্ঘ আইনি লড়াই হতে পারে।

প্যাকার মামলা কী এবং কেন এখানে প্রাসঙ্গিক?

কেরি প্যাকারের ওয়ার্ল্ড সিরিজ ক্রিকেটের সময়ে বিদ্রোহী খেলোয়াড়দের দেশের বোর্ডগুলি নির্বাসিত করার সিদ্ধান্ত নেয়। প্যাকার-পক্ষে টোনি গ্রেগ ইংল্যান্ড প্রশাসকদের বিরুদ্ধে মামলা করেন। তাতে ইংল্যান্ডের বোর্ডই হারে। প্যাকার-পক্ষের জয় হয়। সেই রায়ে বলা হয়েছিল, খেলোয়াড়ের প্রাথমিক অধিকার খেলা। তা কেউ আটকাতে পারে না। প্যাকার বলেন, বোর্ডগুলি তাঁর সঙ্গে আলোচনায় বসতে রাজি নয়। তবে প্যাকার ভাঙিয়ে নিয়েছিলেন খেলোয়াড়দের, এখানে ক্লাবগুলিই বিদ্রোহী হয়েছে। খেলাধুলোর ক্ষেত্রে প্যাকার মামলার রায় যুগান্তকারী হয়ে রয়েছে। আগামী সপ্তাহেই চ্যাম্পিয়ন্স লিগে রিয়াল মাদ্রিদ, ম্যাঞ্চেস্টার সিটি, চেলসি খেলবে। উয়েফা বলছে, তাদের খেলতে দেবে না। আদালত পর্যন্ত মামলা গড়াতেই পারে।

কেন হঠাৎ এই লিগ?

করোনা অতিমারিতে মন্দার স্রোত আছড়ে পড়েছে খেলাধুলোতেও। বিশেষ করে ইউরোপের ক্লাবগুলি ক্ষতিতে চলছে। এই অবস্থায় সব ক্লাবই আর্থিক মুনাফার দিকে ঝুঁকছে। সুপার লিগের বিপুল অর্থের টোপ তাই তারা দূরে ঠেলতে চাইছে না।

প্রভাব কী হতে পারে?

এই ১২টি দল এককাট্টা হওয়া মানে এদের বহিষ্কার করলে ইউরোপের সব লিগই জৌলুস হারাবে। দ্বিতীয় সারির দল নিয়ে চালাতে হবে সব লিগ। চ্যাম্পিয়ন্স লিগও চাকচিক্য হারাবে সেরা দলগুলি না থাকলে। তবে তারকা ফুটবলার এবং তারকারা কী করেন, সেটাও দেখার। বিশ্বকাপ বা আন্তর্জাতিক স্তরের ম্যাচ থেকে নির্বাসিত হতে হলে মেসি-রোনাল্ডারা কি বিদ্রোহী লিগে খেলতে চাইবেন? না অন্য ক্লাবে চলে যাবেন? আবার উল্টো প্রশ্ন হচ্ছে, তথাকথিত ছোট ক্লাবগুলির পক্ষে এত উচ্চ দর দিয়েও কি তাঁদের কেনা সম্ভব? উদ্বেগ, বিভ্রান্তি, অনিশ্চয়তা নিয়ে অপেক্ষায় ফুটবলবিশ্ব।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement