বেথুয়াডহরির এক স্কুলে চলছে প্রশিক্ষণ। — নিজস্ব চিত্র
ছাপোষা বাঙালির কাছে এখনও ব্যাডমিন্টন মানে শীতকাল।
দুপুরের নরম রোদে পিঠ দিয়ে কমলালেবুর খোসা ছাড়ানো, রাতে ডুম জ্বেলে র্যাকেট হাতে ছোটা!
নিছকই শখের ব্যাপার। তাতে তো আর সিন্ধু-সাইনা তৈরি হয় না। তার জন্য বছরভর ঘাম ঝরাতে হয়। ভাল ইন্ডোর কোর্ট লাগে। দামি ফেদার লাগে। সে সব জোগাবে কে?
নদিয়ায় ইন্ডোর কোর্ট আছে এক মাত্র কল্যাণীর টাউন ক্লাবে। জেলার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে সেখানে প্রশিক্ষণ নিতে যায় খেলোয়াড়েরা। অনেকেরই সামর্থ্যে কুলায় না। শীতকালে পাড়ার দাদাদের সঙ্গে গা ঘামিয়েই তাদের সন্তুষ্ট থাকতে হয়।
শীতের সন্ধ্যায় যে ব্যাডমিন্টন খেলার চল, তার অন্যতম বড় কারণ ওই সময় হাওয়া দেয় না সাধারণত। কিন্তু হাওয়ার মেজাজ-মর্জির উপরে নির্ভর করে তো পেশাদার প্রশিক্ষণ সম্ভব নয়। তাই ইন্ডোর কোর্ট থাকাটা জরুরি। মুর্শিদাবাদেও তেমন কোর্ট একটাই, বহরমপুরের রামকৃষ্ণ ব্যায়াম মন্দির ক্লাবে।
তবু ভাল, বেথুয়াডহরি জেসিএম স্কুলে শিক্ষক, জেলা ক্রীড়া সংস্থার অন্যতম সম্পাদক দেবব্রত ঘোষের উদ্যোগে বছরভর সিমেন্টের কোর্টে অনুশীলন চলে। ছাত্রছাত্রীরা ছাড়াও বাইরে থেকে জনা পঁয়তাল্লিশ শিখতে আসে। কিন্তু বাধা খরচ। দেবব্রতবাবু বলেন, “একটু ভাল র্যাকেট কিনতে তিন থেকে পাঁচ হাজার টাকা লাগে। ফেদারের দাম আকাশছোঁয়া।” তা সত্ত্বেও ফি বছর তাঁদের ছ’-সাত জন খেলোয়াড় রাজ্যস্তরে যাচ্ছে। দু’বার জাতীয় স্তরেও গিয়েছে। ২০১৪-য় জাতীয় স্তরে খেলে আসা কৌশিক বিশ্বাস ইন্ডোরে অনুশীলনের জন্য সপ্তাহে চার দিন নৈহাটিতে যায়।
বহরমপুর একটি কোচিং সেন্টারে চলছে খেলা। — নিজস্ব চিত্র
নবদ্বীপে এক সময়ে ব্যাডমিন্টনের রমরমা ছিল। ওয়াইএমসিএ থেকে খেলা শিখে এসে অসীম সঙ্ঘের মাঠে এলাকার ছেলেদের প্রশিক্ষণ দিতেন পরিমল দাস। নবদ্বীপ নির্ভীক সমিতি ও রয়েল ক্লাব বড় টুর্নামেন্ট করত। এক সময়ের নামি খেলোয়ার ব্রজকিশোর মণ্ডলের মনে পড়ে, নয়ের দশকে ব্যাডমিন্টন লিগও চালু হয়েছিল। সে সবই এখন অস্তমিত।
রানাঘাটের ইমরান আলি আগে কলকাতায় গোপীচাঁদ অ্যাকাডেমিতে খেলা শেখাতেন। এখন কল্যাণীতে শেখাচ্ছেন। তাঁর সঙ্গে শেখাচ্ছেন রানাঘাটেরই সোমশুভ্র চট্টোপাধ্যায়। তাঁদের অভিজ্ঞতা, প্রতিভাবান ও আগ্রহী ছেলেমেয়ের অভাব নেই। তাঁদের কাছে প্রশিক্ষণ নিয়ে অনেকে রাজ্যস্তরেও খেলছে। কিন্তু জেলা জু়ড়ে প্রশিক্ষণের পরিকাঠামো নেই।
বীরনগরের বাসিন্দা, মাজদিয়ার সুধীরঞ্জন লাহিড়ী মহাবিদ্যালয়ের তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী প্রীতিলতা দাসের খুব উৎসাহ ব্যাডমিন্টনে। কিন্তু নিয়ম করে কল্যাণীতে গিয়ে অনুশীলন করা অসম্ভব। কৃষ্ণগঞ্জের প্রত্যন্ত গ্রাম চন্দননগরের সোমা ঘোষ আর চাঁপা দেবনাথ ব্যাডমিন্টন খেলছে বহু দিন। চাঁপা রাজ্যস্তরেও খেলেছে এক বার। কিন্তু শীত ছাড়া অন্য সময় তারা অনুশীলনের সুযোগ পায় না।
যা পরিস্থিতি, তাতে মূলত স্বচ্ছল পরিবারের ছেলেমেয়েরাই বাড়ির সাহায্য পেলে খেলাটা খানিক শিখতে পারছে। তাতেও অবশ্য অদম্য জেদ সম্বল। যেমন, মেয়েকে রোজ সালার থেকে বহরমপুরে রামকৃষ্ণ ব্যায়াম মন্দিরে নিয়ে যান ব্যবসায়ী রবিউল হক। তাঁর মেয়ে তহমিনা ইয়াসমিন ক্লাস সিক্স থেকে শেখা শুরু করেছিল, এখন নাইনে পড়ে। কয়েক ঘণ্টা অনুশীলন শেষে ফের ট্রেন ধরে বাড়ি ফিরতে রাত ১১টা বেজে যায়।
বহরমপুর গার্লস কলেজের তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী তন্বী শিকদার ২০১৫ সালে আন্তঃকলেজ ব্যাডমিন্টনে জয়ী হয়েছিলেন। বছরখানেক আগে বিয়ে হলেও খেলা ছাড়েননি। এই উৎসাহ রয়েছে সর্বত্রই। রামকৃষ্ণ ব্যায়াম মন্দির ক্লাবের কর্তা ইন্দ্রনীল সেনগুপ্ত বলেন, ‘‘আশা করি, রিও-তে সিন্ধুর সাফল্যের পরে সরকার পরিকাঠামো তৈরির দিকে নজর দেবে।’’
নদিয়া জেলা ক্রীড়া সংস্থার সাধারণ সম্পাদক জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায় অবশ্য জানিয়েছেন, রানাঘাটে ইন্ডোর কোর্ট হচ্ছে। জেলা পরিষদ বেথুয়াডহরি জেসিএম স্কুলকে ৮০ লক্ষ টাকা দিচ্ছে ইন্ডোর তৈরির জন্য। ২০২০-র মধ্যে প্রতি মহকুমায় একটি ইন্ডোর গড়ার পরিকল্পনা আছে। অর্থাভাবেই এত দিন কাজ এগোয়নি।
সিন্ধুর রুপোর দ্যুতি আরও-আরও ছেলেমেয়েদের উঠে আসার পথ করে দেবে তো?