ঐক্যবদ্ধ: সিডনি টেস্ট ড্র করে ফুরফুরে মেজাজে (বাঁ দিক থেকে) ঋষভ, অশ্বিন, হনুমা, পুজারা, মায়াঙ্ক। টুইটার
এক জন ব্যাটসম্যান, যে দৌড়তে পারছে না। হ্যামস্ট্রিংয়ের চোটে কাবু। অন্য দিকে যে ব্যাটসম্যান, সে মাথায় আঘাত পেয়েছে বাউন্সারে। পিঠে এমন অসহ্য যন্ত্রণা নিয়ে মাঠে এসেছে যে, জুতোর ফিতে না কি বাঁধতে পারছিল না।
প্রথম জন হনুমা বিহারী। দ্বিতীয় জন আর অশ্বিন। এঁরা দু’জনে ৪২.৪ ওভার অবিচ্ছিন্ন থেকে টেস্ট ড্র করে দেবে, কে ভেবেছিল! হনুমা বা অশ্বিন কত রান করল, সেটা বড় কথা নয়। দিনটাই যে ছিল ভারতের কাছে রক্ষা পাওয়ার। প্রবল প্রতিকূলতার মধ্যে যে অস্ট্রেলিয়ার জয় আটকে দিয়ে তারা ফিরল, তা আসলে জেতারই সমান। কে ভাবতে পেরেছিল, সিডনিতে শেষ দিন এমন মরিয়া ব্যাটিং করে সিরিজ ১-১ অবস্থায় শেষ টেস্টে যেতে পারবে ভারত!
এখানেই শেষ নয়। বিহারী-অশ্বিন জুটির আগে চেতেশ্বর পুজারা আর ঋষভ পন্থের যুগলবন্দি দেখা গেল। একদম যেন বিপরীত মেরুর দুুই বাসিন্দা। পুজারা মাটি কামড়ে পড়ে থাকে, ঋষভ আক্রমণাত্মক। সোমবার এমন চাপের মধ্যে যে রকম প্রতিআক্রমণ ঋষভ করল, তা মুগ্ধ করার মতো। বোঝা গেল, পরিস্থিতি যেমনই থাকুক, ঋষভের অভিধানে এক ধরনের ক্রিকেটই রয়েছে। আগ্রাসী ব্যাটিং করে ছত্রভঙ্গ করে দিল অস্ট্রেলীয় বোলিংকে।
এই ঋষভও ব্যাট করতে এসেছিল চোট নিয়ে। প্রথম ইনিংসে মিসাইলের মতো অস্ট্রেলীয় পেসারের গোলা আছড়ে পড়েছে ওর কনুইয়ে। মনে হয়েছিল, দ্বিতীয় ইনিংসে হয়তো ব্যাটই করতে পারবে না। বদলি উইকেটকিপার নামাতে হয়েছে। যন্ত্রণা নিয়ে ব্যাট করতে নেমে ডাকাবুকো এক ইনিংস খেলে গেল ঋষভ।
টিভিতে আবার দেখলাম, বিহারী এবং অশ্বিন যখন ব্যাট করছে, প্যাড পরে বসে আছে রবীন্দ্র জাডেজা। এই ছেলেটারই তো বুড়ো আঙুলের হাড় সরে গিয়েছে প্রথম ইনিংসে। তার পরে আর বল করতে পারেনি। ব্রিসবেনে শেষ টেস্টে খেলতে পারবে না। হাতে প্লাস্টার করা। সতীর্থরা জল এগিয়ে দিচ্ছে, কলা খাইয়ে দিচ্ছে। অথচ, যাবতীয় যন্ত্রণা, কষ্ট উপেক্ষা করে বাইশ গজে গিয়ে জান লড়িয়ে দিতে প্রস্তুত।
যে ভাবেই হোক সিডনিতে অস্ট্রেলিয়াকে জিততে দেব না। এই মরিয়া মনোভাবটাই ভারতকে জয়ের সমান ড্র পাইয়ে দিল। আর সেই কারণেই সিরিজ এখনও ‘ওপেন’ থাকল। তবে সন্দেহ নেই, ব্রিসবেনের অতিরিক্ত বাউন্সের উইকেটে নতুন করে পরীক্ষা দিতে হবে ভারতীয় দলকে। চোট-আঘাতে হাসপাতাল হয়ে যাওয়া দল পাবে না রবীন্দ্র জাডেজাকেও। আমার মতে, যা অপূরণীয় ক্ষতি।
শুনলাম, সোশ্যাল মিডিয়ায় না কি জনতা বিভক্ত। কারও কারও মত, ভারত জেতার চেষ্টা কেন করল না? দরকার ছিল ৪০৭ রান। শেষ ইনিংসে চারশোর উপর রান তাড়া করে পোর্ট অব স্পেনে ঐতিহাসিক জয় রয়েছে। কেন শুধু ড্র নিয়েই সন্তুষ্ট থাকব? আরও বলা হচ্ছে, পুজারা, বিহারীদের এমন ঠুকঠুক ব্যাটিং দেখতে এখনকার দিনে কে মাঠে আসবে?
আমি তাঁদের সঙ্গে একমত হতাম, যদি না ভারতীয় দল এমন হাসপাতালের চেহারা নিত। কোহালি আগেই ফিরে গিয়েছে। কতগুলো ভাল ক্রিকেটারের চোট ভাবুন। মহম্মদ শামি নেই। ইশান্ত শর্মা আসতে পারেনি। কে এল রাহুল ছিটকে গিয়েছে। এ বার জাডেজাও বেরিয়ে গেল। সফরে গিয়ে এমন অবস্থা হলে পুরো দলের মনোবল দুমড়ে যেতে দেখেছি। কিন্তু এই ছেলেগুলো যেন অন্য ধাতুতে গড়া। কী মানসিকতা দেখাচ্ছে সবাই! যত ধেয়ে আসছে চোট, তত যেন সোজা হচ্ছে বাকিদের শিরদাঁড়া। কুর্নিশ করতেই হবে।
অনেক দিন পরে টেস্ট ম্যাচে ড্রয়ের ব্যাটিং দেখলাম। এই টি-টোয়েন্টির রমরমার যুগে শেষ বল পর্যন্ত টেস্ট খেলা হচ্ছে, এমনও তো দেখা যায় না। আমাদের সময়ে ড্রয়ের ব্যাটিংকেও শিল্প মনে করা হত। সেটা এখন লুপ্তপ্রায়। লোকে পুজারার স্লথ ব্যাটিং নিয়ে কথা তুলছে। শেষ দিনটা কিন্তু দেখিয়ে দিয়ে গেল, এই ব্যাটিংয়েরও দরকার আছে। তবে হ্যাঁ, পুজারার অতি রক্ষণাত্মক হয়ে খোলসে ঢুকে পড়া উচিত নয়। তাতে বোলারদের ছন্দ পেতে সুবিধা হয়ে যায়। সুনীল গাওস্করের রক্ষণ টলানো যেত না। কিন্তু সানি ছিল নিয়ন্ত্রিত শাসক। কখনও বোলারদের মাথায় চড়তে দেয়নি। রক্ষণ সামলেও তা মাথায় রাখতে হবে।
তবে সোমবার ঋষভ ঝড় তোলার পরে ভারতের পক্ষে রানটা তাড়া করা আর সম্ভব হত না। তার কারণ, শেষ স্বীকৃত জুটি হিসেবে ছিল বিহারী ও অশ্বিন। ওরা দু’জনের কেউ খুব আক্রমণাত্মক ব্যাটসম্যান নয়। বরং দুর্গ আগলে ড্রয়ের খেলা খেলে ঠিকই করেছে। ড্রেসিংরুমে ছিল শুধু আহত জাডেজা। যতই চোট নিয়েও ব্যাট করতে নামার সিদ্ধান্ত নিক, ওর পক্ষে স্বাভাবিক ছন্দ দেখানো সম্ভব হত না। ভাগ্যের সহায়তাও পেয়েছে ভারতীয় ব্যাটসম্যানেরা। ঋষভের ক্যাচ দু’বার পড়েছে, সব মিলিয়ে অন্তত চারটি সুযোগ হাতছাড়া করেছে অস্ট্রেলীয়রা। সেগুলো নিতে পারলে কী হত, বলা কঠিন। কিন্তু এটাও ঠিক যে, ভারতীয়রা ক্যাচ ফেলেছে।
আরও দু’টো জিনিস অস্ট্রেলীয়দের বিরুদ্ধে গিয়েছে। প্রথমত, নেথান লায়নের মতো স্পিনারের শেষ দিনের সিডনি পিচে ভয়ঙ্কর হয়ে উঠতে না পারা। আমাদের সময়ে ভাবাই যেত না যে, শেষ দিনের খারাপ হয়ে পড়া বাইশ গজে নির্বিষ বোলিং করছে স্পিনার। আমি এই টেস্টে অশ্বিনের বোলিং দেখেও খুব একটা খুশি হইনি। স্টিভ স্মিথ, মার্নাস লাবুশেনরা পাল্টা আক্রমণ করতেই কোনও ‘প্ল্যান বি’ দেখলাম না। দ্বিতীয়ত, অস্ট্রেলীয় অধিনায়ক টিম পেনের নেতৃত্ব আমার অতি সাধারণ মানের লেগেছে। কী সব অধিনায়ক দিয়েছে অস্ট্রেলিয়া! সেখানে স্টাম্পের পিছনে দাঁড়িয়ে বকবক করা ছাড়া এই পেনের কাছ থেকে কিছুই পাওয়া গেল না। শেষ দিনের পিচে চারশো রানের পুঁজি নিয়ে যদি আক্রমণাত্মক ফিল্ডিং না সাজাই, তা হলে আর কবে সাজাব? এত কথা না বলে পেনের উচিত ছিল, নিজের নকশায় মন দেওয়া।
সিডনিতে বর্ণবৈষম্যের ঘটনাতেও আমি হতাশ। অস্ট্রেলিয়ায় গ্যালারি খুব সরব, ঠিকই। আমাদের সময়েও দেখেছি। কিন্তু সিডনিতে বর্ণবিদ্বেষী মন্তব্য খেলার সময়ে শুনিনি।