ভাগ্যিস, অভিনেতা নাসিরুদ্দিন শাহ সে বার শীতকাল ছাড়া শুটিংয়ের সময় বার করতে পারেননি! না হলে, আমার জীবনের প্রেরণা ‘ক্ষিদ্দা’ ওরফে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে দেখাই হত কি না, কে জানে!
‘কোনি’ ছবিতে ক্ষিদ্দার ভূমিকায় অভিনয় করার কথা ছিল আসলে নাসিরুদ্দিনের। কিন্তু তিনি শীতকাল ছাড়া সময় বার করতে না পারায় পরিচালক সৌমিত্রদাকে নিয়েছিলেন। আর আমিও তাঁর সঙ্গে অভিনয়ের পাশাপাশি জীবনের পথে পেয়েছিলাম এক শিক্ষককে। ওঁর মতো প্রেরণা আমি খুব কম পেয়েছি। ‘কোনি’-র শুটিংয়ে সৌমিত্রদার থেকে পাওয়া শিক্ষা পরবর্তীকালে আমার শিক্ষক জীবনেও কাজে লেগেছে।
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে প্রথম দেখা হওয়ার সময় আমি স্নাতকোত্তর স্তরের ছাত্রী। সাঁতারে জাতীয় স্তরে ১০০ ও ২০০ মিটার ব্রেস্ট স্ট্রোকে পদকজয়ী। কোনি ছবির পরিচালক সরোজ দে আমাকে নাম ভূমিকায় নির্বাচিত করেন। আমরা থাকতাম হিন্দুস্তান রোডে। এক সকালে বাড়িতে সরোজবাবু দলবল নিয়ে এসে ছবি তুলছিলেন। তার পরে উনি আমার বাড়ি থেকেই ফোন করলেন সৌমিত্রদাকে। বললেন, ‘‘কোনিকে পেয়ে গিয়েছি।’’ সৌমিত্রদা তখন থাকতেন লেক রোডে। মিনিট পনেরোর মধ্যেই গাড়ি চালিয়ে আমাকে দেখতে চলে এলেন। সেদিনই কাজের প্রতি ওঁর দায়বদ্ধতা দেখে মুগ্ধ হয়েছিলাম। কোনও এক ছাত্রী, ওঁর সঙ্গে অভিনয় করবে ছবিতে। ঠিকঠাক নির্বাচন হয়েছে কি না, দেখতে বাড়ি চলে এলেন! সৌমিত্রবাবু কিংবদন্তি। অথচ কোনও তারকাসুলভ অহংবোধই ছিল না। পরে এ ব্যাপারে আলোচনা প্রসঙ্গে তিনি বলেছিলেন, ‘‘শ্রীপর্ণা জীবনে যে কাজেই হাত দেবে, তা মন দিয়ে করবে। মনে রাখবে, কাজের ক্ষেত্রে কেউ বড় বা ছোট নয়। বড় হতে গেলে ছোট হতে হয়।’’ জীবনে চলার পথে এই উপদেশগুলো আমার কাছে বড় শিক্ষা।
অমলিন: পর্দায় কোনির ভূমিকায় শ্রীপর্ণা মুখোপাধ্যায়।
কোনি-তে অভিনয় করার অন্য সাঁতারুদের আমিই জোগাড় করেছিলাম। কিন্তু পুরো দলটার সঙ্গেই সৌমিত্রদা বন্ধুর মতো মিশতেন। বলতেন, ‘‘তোদের মধ্যে কোনও অহংবোধ নেই। আমাকে সন্তুষ্ট করারও কোনও প্রচেষ্টা নেই। তাই তোদের সঙ্গে আড্ডা মারতে আমার বেশ লাগে।’’ কোনির শুটিং হয়েছিল আহিরিটোলা গঙ্গার ঘাট, চেন্নাই, ফোর্ট উইলিয়াম-সহ অনেক জায়গায়। সব জায়গাতেই আমাদের সঙ্গে যেতেন উনি। বলতেন, ‘‘কোনও কাজই কেউ একা করতে পারে না। ছবি তৈরিও একটা দলগত প্রচেষ্টা। সব সময়ে দলগত ভাবে কাজ করবে, দেখবে অর্ধেক চাপ কমে যাবে।’’ শুটিংয়ের ফাঁকে সৌমিত্রদার গলায় গান বা আবৃত্তি শোনাও ছিল প্রাপ্তি।
আরও পড়ুন: মাথার উপর থেকে বিশাল ছাতাটা হঠাৎ করে সরে গেল
আরও পড়ুন: সৌমিত্রকাকু বলল, উইগ পরলে বেশি ফেলুদা-ফেলুদা লাগবে
অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় সম্পর্কে বলতে যাওয়ার ধৃষ্টতা নেই। কলেজ স্কোয়ারে আমাকে অনুশীলন করাতেন কোচ অনিল দাশগুপ্ত। কোচ কী ভাবে প্রতিভা তুলে আনেন, তা দেখতে শুরুর দিকে ভোর সাড়ে পাঁচটা-ছ’টা নাগাদ গাড়ি চালিয়ে সৌমিত্রদা চলে আসতেন কলেজ স্কোয়ারে। দেখতেন, অনিলদা কী ভাবে আমাদের নির্দেশ দিচ্ছেন, বকুনি দিচ্ছেন। সেগুলোই অভিনয়ে আত্মস্থ করে ফেলেছিলেন।
সৌমিত্রদার জ্ঞানও সাগরের মতো! খেলার চরিত্রদের প্রতি বিশেষ আকর্ষণও ছিল ওঁর। এক বার জেসি ওয়েন্সের গল্প শুনিয়ে বলেছিলেন, ‘‘প্রতিভা লুকিয়ে থাকে জনসমুদ্রে। জহুরির চোখ দিয়ে তা খুঁজে বার করতে হয়।’’
স্মৃতি: ইডেনে প্রদর্শনী ক্রিকেট ম্যাচে দিলীপ কুমার, সায়রা বানুর সঙ্গে সৌমিত্র।
আর ক্ষিদ্দার সেই অমর হয়ে যাওয়া সংলাপ ‘ফাইট কোনি, ফাইট’ আমাকে ব্যক্তি জীবনে শিখিয়েছে, কেউ কিছু পাওয়ার জন্য মরিয়া হলে সাফল্য আসবেই। কোনি ছবিতে সৌমিত্রদার সঙ্গে অভিনয় করে আমি শিখেছি, সমাজে একজন শিক্ষকের ভূমিকা হল সাধারণকে অসাধারণের স্তরে নিয়ে যাওয়া।
নিজে পরবর্তীকালে শিক্ষকতা করার সময়ে এই দর্শনেই এগিয়েছি। ২৭ বছর ধরে একটি স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা হিসেবে কাজ করছি। সেখানে অনেক ছাত্রছাত্রী পাই, যাদের কেউ অসুস্থ, কারও বাবা বা মা অল্প বয়সে প্রয়াত, কারও পারিবারিক বা অর্থনৈতিক সমস্যা, কেউ অমনোযোগী। কেউ প্রবল প্রতিভাবান কিন্তু মানবিক নয়, এ রকম বহু জটিল সমস্যার সমাধান করতে পেরেছি ‘ফাইট, কোনি ফাইট’ মন্ত্র দিয়েই। সৌমিত্রদার থেকে কোনির শুটিংয়ে পাওয়া অমূল্য সব পরামর্শ দারুণ সাহায্য করেছে।
সেই সৌমিত্রদা রবিবার দুপুরে আমাদের সব প্রার্থনা না শুনে চলে গেলেন। তবে যাঁর স্থান হৃদয়ে সোনার সিংহাসনে, তাঁকে মৃত্যু চিরতরে কাড়তে পারে না। ওই তো উনি আছেন। পরিষ্কার শুনতে পাচ্ছি সেই গলা, ‘ফাইট, কোনি ফাইট’।