কিংবদন্তি: প্যারিসে তৃতীয় সোনা জেতার পথে বাইলস। সব মিলিয়ে ১০ নম্বর অলিম্পিক্স পদক। ছবি: সংগৃহীত।
পুরুষদের ফ্লোর এক্সারসাইজ় সবে শেষ হয়েছে। পদক বিতরণ হল। এর পর একে একে তাঁদের নাম ডাকা।
পুরো নামও উচ্চারণ করতে হল না ঘোষিকাকে। শুধু ‘সি’ শুনেই যা গর্জন উঠল, ভারতের মাঠে ধোনি, কোহলিরা নামলে বোধ হয় একমাত্র শোনা যায়। তার পরে তিনি হাত নাড়তে নাড়তে বেরিয়ে এলেন। রোলঁ গ্যারোজ়ের নাম অনেকে পাল্টে দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। বলেছেন, নাম দেওয়া হোক রাফা গ্যারোজ়। এত একপেশে সমর্থন আর কোথাও কেউ পান না। প্রতিপক্ষে যে-ই থাকুক না কেন, জনতা শুধু রাফার জন্য চেঁচায়।
শনিবার অলিম্পিক্সের জিমন্যাস্টিক্স যেখানে হচ্ছে, সেই বার্সি এরিনায় গিয়ে মনে হল, রোলঁ গ্যারোজ়ের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নামতে পারে। ওখানে যেমন রাফা, এখানে তেমন সিমোন বাইলস। এমন চিৎকার কোনও ফরাসি প্রতিযোগীর জন্যও কি অপেক্ষা করছে এ বারের অলিম্পিক্সে? আমেরিকার এক সাংবাদিক বলছিলেন, অলিম্পিক্সের প্রায় সব কেন্দ্র ঘুরে ফেলেছেন। কিন্তু এমন চিৎকার কারও জন্য শোনেননি। একমাত্র তুলনা হতে পারে রোলঁ
গ্যারোজ়ে নোভাক জোকোভিচের বিরুদ্ধে রাফায়েল নাদাল। ওটা যদি রাফা গ্যারোজ়, এটা তা হলে বার্সি নয়, বাইলস এরিনা। এবং, সেই জনগর্জনকে আরও সপ্তমে চড়িয়ে দিলেন জিমন্যাস্টিক্স ইতিহাসে সর্বকালের অন্যতম সেরা বাইলস। আচ্ছা, নাদাল বলায় মনে পড়ল, এ দিন বাইলসকে দেখতে হাজির থাকা বিশেষ অতিথিদের মধ্যে ছিলেন অ্যান্ডি মারে। সঙ্গে টেনিসের কিংবদন্তি বিলি জিন কিং।
প্যারিসে ইতিমধ্যেই টিম ইভেন্ট ও অল-অ্যারাউন্ড বিভাগে সোনা জিতেছেন আমেরিকান তারকা। শনিবার জিতলেন ভল্টে, যেখানে তিনি অবিসংবাদী রানি। কিন্তু অন্য ইভেন্ট জেতা আর এটা জেতার মধ্যে তফাত আছে। রিয়ো অলিম্পিক্সে, যেখানে দীপা কর্মকার চতুর্থ হন, সেখানে ভল্টে সোনা জিতেছিলেন বাইলস। কিন্তু টোকিয়োয় মানসিক রোগে আক্রান্ত হয়ে প্রিয় ইভেন্ট থেকে নিজেকে সরিয়ে নেন। জিমন্যাস্টিক্সের ভাষায় একটা নাম আছে বাইলসের এই মনের অসুখের। ‘টুইস্টিজ়’। হঠাৎ মাথাটাই পুরো কাজ করা বন্ধ করে দিতে পারে। তখন সামনে শুধুই শূন্যতা ছাড়া আর কিছু থাকে না। এই অবস্থায় কেউ যদি বাতাসে ভেসে হেলিকপ্টারের মতো পাক খায়, তাঁকে কী বলা হবে? জীবনযুদ্ধে জিতে ফিরে আসা বাইলস সেই অকল্পনীয় কাণ্ডই করে দেখালেন শনিবার। সামান্য এদিক ওদিক হলে বা পুরনো রোগ ফিরে এলে শূন্যে ভাসমান অবস্থায় কী ভয়ঙ্কর ব্যাপার ঘটে যেতে পারে, তা ভাবতে গিয়েই শিউরে উঠতে হয়। কিন্তু শনিবার যাঁকে দেখা গেল, তিনি পুরনো বাইলস। আত্মবিশ্বাসী বাইলস। হেলিকপ্টার হয়ে আকাশে ওড়া বাইলস।
লাইন-আপে চতুর্থ ছিলেন তিনি। প্রথমেই সকলকে চমকে দিলেন ‘ইয়ুরচেঙ্কো ডাবল পাইক’ ভল্ট দিয়ে। যার নামকরণই অনেকে করে ফেলেছেন ‘বাইলস ভল্ট’ হিসেবে। কতটা ঝুঁকিপূর্ণ এই ভল্ট? শূন্যে ভেসে দু’বার পাক খেতে হবে। ডাবল পাইক যে কারণে বলে। তার পরে ল্যান্ডিং ঠিক করতে হবে। না হলে পয়েন্ট
কাটা যাবে।
অনেকের মনে সংশয় ছিল, এত বড় একটা মানসিক সমস্যা কাটিয়ে ফিরছেন। এই মারণ ভল্ট তিনি দিতে পারবেন তো? কিন্তু বাইলস মানসিক অন্ধকারের কাছে হারতে আসেননি, হারাতে এসেছেন। প্রথম চেষ্টাতেই এমন দুর্ধর্ষ ফিনিশ করলেন যে, বার্সি এরিনা ফেটে পড়ল। ওহ্, ভুল লিখলাম বাইলস এরিনা ফেটে পড়ল। রানওয়ে ধরে ফিরতে ফিরতেই স্কোরবোর্ড ঝলসে উঠল। ১৫.৭। এর পরে তিনি দিলেন শেং ভল্ট। তাতে ১৪.৯। ‘ইয়ুরচেঙ্কো ডাবল পাইক’ ভল্টে ঝুঁকি বেশি থাকে বলে পয়েন্টও বেশি পাওয়া যায়।
ভল্টে বাইলসের নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী বলে যদি কেউ থাকে, তিনি হলেন ব্রাজিলের রেবেকা আন্দ্রাদে। তিনিও কঠিন, কঠিন সব ভল্ট দিতে পারেন। এ দিন আন্দ্রাদে দিলেন শেন এবং আমানার ভল্ট। কিন্তু বাইলসকে হারানোর টোটকা তাঁর জানা ছিল না। রুপো নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হল নেমারের দেশের জিমন্যাস্টকে।
মানসিক অন্ধকার কাটিয়ে ফিরে আসার পরে প্যারিসে তিনটি সোনা হয়ে গেল। ১০টি অলিম্পিক পদক হয়ে গেল তাঁর। সোমবার আরও দুটি ফাইনাল আছে। ফ্লোর ও বিমের। জিমন্যাস্টিক্সে সব চেয়ে বেশি পদকের রেকর্ড সোভিয়েত ইউনিয়নের লারিসা লাতিনিনার দখলে। ১৮টি পদক জিতেছিলেন তিনি। সেই সংখ্যা অনেক দূরে। কিন্তু দুই নম্বরে থাকা চেকোস্লোভাকিয়ার ভেরা কাসলাভস্কার ১১টি পদকের রেকর্ড ধরে ফেলতেই পারেন তিনি। সঙ্গে বার্সি এরিনার গর্জন তো থাকছেই।
ধুস, আবার ভুল লিখলাম। বার্সি কোথায়, ওটা তো বাইলস এরিনা!