ত্রিমূর্তি: আকাশ (বাঁ দিকে) এবং শাহবাজের সঙ্গে মনোজ। নিজস্ব চিত্র
সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের কোর্স শেষ করে তাঁর মনে হয়েছিল, ক্রিকেট নিয়েই এগোবেন। ছোটবেলায় গুরুগ্রামে মনসুর আলির কাছে ক্রিকেটে হাতেখড়ি। কিন্তু ক্রিকেটার হওয়ার স্বপ্ন তখনও দেখা শুরু করেননি শাহবাজ আহমেদ। ২০১৪-এ ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে তাঁর মনে হয়, ক্রিকেট নিয়েই এগোলে কেমন হয়! বাঁ-হাতে ব্যাট করতেন। বাঁ-হাতি স্পিনও খারাপ করতেন না।
হঠাৎই তাঁর ফোন বেজে ওঠে এক দিন। ফোন করেন তপন মেমোরিয়াল ক্লাবের এক কর্তা। তৎকালীন বাংলার হয়ে খেলা প্রমোদ চাণ্ডিলাকে একজন বাঁ-হাতি স্পিনার অলরাউন্ডার খুঁজে দিতে বলেছিলেন ক্লাবকর্তারা। শাহবাজের নম্বর দেন প্রমোদ। ২০১৫ সালে প্রথম বার কলকাতায় আসেন শাহবাজ। শুরু হয় তাঁর ক্রিকেটজীবন।
২০১৮ সালে প্রথম ডিভিশনে পশ্চিমবঙ্গ পুলিশের বিরুদ্ধে দুরন্ত পারফর্ম করেন শাহবাজ। কিন্তু প্রশ্ন ওঠে, তিনি আদৌ বাংলার ক্রিকেটার কি না। নিয়ম অনুযায়ী প্রথম ডিভিশনে তিনজন ভিন রাজ্যের ক্রিকেটার খেলানো যায়। কিন্তু পুলিশ দলের অভিযোগ ছিল, শাহবাজ চতুর্থ ভিন রাজ্যের ক্রিকেটার। অভিযোগের ভিত্তিতে পরের ম্যাচে বড়িশা স্পোর্টিং ক্লাবের বিরুদ্ধে তাঁকে খেলতে দেওয়া হয়নি। সিএবি জানিয়েছিল, যত দিন না তদন্ত শেষ হচ্ছে, খেলতে দেওয়া যাবে না তাঁকে। মনে হয়েছিল, বাংলায় ক্রিকেটজীবনই হয়তো তাঁর শেষ। এমনকি বাড়ি ফেরার পরিকল্পনাও করেছিলেন। কিন্তু অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় তাঁকে ফিরিয়ে আনতে বাধ্য হয় সিএবি। এক সময় বাংলার হয়ে খেলাই যাঁর কাছে দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়েছিল, মঙ্গলবার কল্যাণীতে ২৬ বছরের অলরাউন্ডারের হাত থেকেই বেরলো মরসুমের প্রথম হ্যাটট্রিক। শাহবাজ যদিও অতীত নিয়ে ভাবতে পছন্দ করেন না। ম্যাচ শেষে দিনের নায়ক বলছিলেন, ‘‘সেই ঘটনা আর মনে করতে চাই না। যা হওয়ার হয়ে গিয়েছে। বাংলার হয়ে খেলার স্বপ্ন ছিল। এখানকার ক্রিকেট সংস্কৃতি অসাধারণ। বাংলার হয়ে হ্যাটট্রিক করতে পেরে দারুণ লাগছে।’’ যোগ করেন, ‘‘ম্যাচটি বোনাস পয়েন্ট-সহ জিতে আরও ভাল লাগছে। এখন থেকেই কোয়ার্টার ফাইনাল খেলার স্বপ্ন দেখা শুরু হয়ে গিয়েছে।’’
এক সময় ক্যালকুলাস ছিল তাঁর প্রিয় বিষয়। সারা দিন অঙ্ক নিয়েই পড়ে থাকতেন। এখন তাঁর অস্ত্র বল। কঠিন অঙ্কের উত্তর পাওয়ার মতোই তাঁর পছন্দ ব্যাটসম্যানের খুঁত খুঁজে বার করা। তাই কল্যাণীর মতো ব্যাটসম্যান-সহায়ক পিচেও তিনি সফল। প্রথম ইনিংসে ৮.৩ ওভার বল করে ২৬ রানে হ্যাটট্রিক-সহ চার উইকেট নেন। দ্বিতীয় ইনিংসে তাঁর সংগ্রহ দুই উইকেট। ম্যাচে ছয় উইকেট পেয়ে যাত্রা শেষ করলেন শাহবাজ।
রাজ্যের সপ্তম বোলার হিসেবে রঞ্জিতে হ্যাটট্রিক পূরণ হল তাঁর। টি সি লংফিল্ড, প্রবীর সেন, বরুণ বর্মণ, শরদিন্দু মুখোপাধ্যায়, সাগরময় সেনশর্মা ও মহম্মদ শামির উত্তরসূরি তিনিই। ১৯৮৯-৯০ বাংলার রঞ্জি জয়ের মরসুমে হায়দরাবাদের বিরুদ্ধে সেমিফাইনালে হ্যাটট্রিক করেছিলেন শরদিন্দু। এ দিন উত্তরসূরির সাফল্যে তিনি মুগ্ধ। বলছিলেন, ‘‘যে কোনও ফর্ম্যাটেই বিশেষ জায়গা করে নেয় হ্যাটট্রিক। আমি চাইব এ ভাবেই উন্নতি করুক ও। আরও ম্যাচ জেতাক বাংলাকে।’’ বর্তমানে বাংলার নির্বাচক সাগরময় সেনশর্মাও খুশি। তাঁর কথায়, ‘‘নির্বাচক হিসেবে শাহবাজকে দলে নিয়ে গর্বিত। নিজের হ্যাটট্রিকের কথা মনে পড়ে গিয়েছিল। ‘৯৩-এ দিল্লির বিরুদ্ধে ইডেনে হ্যাটট্রিক করেছিলাম। সে বার ফাইনালও খেলেছিলাম আমরা। আমি চাইব বাংলাও এ ভাবেই এগোতে থাকুক।’’
শাহবাজকে উন্নত স্পিনার করে তোলার নেপথ্যে বড় অবদান উৎপল চট্টোপাধ্যায়ের। বর্তমানে তিনিই শাহবাজদের স্পিন বোলিং উপদেষ্টা। মরসুমের শুরু থেকেই বাংলার স্পিনারদের নিয়ে বিশেষ ট্রেনিং করিয়েছেন। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা দিয়ে বুঝিয়েছেন কোন মুহূর্তে কী করা উচিত। উৎপলের উপলব্ধি, ‘‘শাহবাজ খুব ভাল বোলার। কিন্তু শুরুর দিকে খুব চাপে পড়ে যায়। খেলা যত গড়ায়, ততই আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠে ও। শুরু থেকেই কী করে আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বল করতে হয়, এ বার সেটাই ওকে বোঝাব।’’ টেকনিক্যাল কোনও পরিবর্তন করতে হয়েছে? উৎপলের উত্তর, ‘‘টেকনিকে সমস্যা নেই। কাজ করতে হবে মানসিকতা নিয়ে।’’
শাহবাজও খুশি অভিজ্ঞ বাঁ-হাতি স্পিনারের মূল্যবান পরামর্শ পেয়ে। বলছিলেন, ‘‘ডেভিডদা (উৎপল) খুবই সাহায্য করেন। বিপক্ষ ব্যাটসম্যানদের ভিডিয়ো দেখিয়ে বলে দেন, কাকে কী বল করলে সমস্যায় ফেলা যাবে। তাঁর নির্দেশ মেনে চলেই সাফল্য পাচ্ছি।’’
খোঁজ নিয়ে জানা গেল, কলকাতায় থাকলে প্রত্যেক দিন বিকেলে ফুচকা খেতে বেরিয়ে পড়েন। স্থানীয় অভিভাবকের নির্দেশ অমান্য করেই তা করেন শাহবাজ। যে স্বভাব এক সময় ছিল ছোটবেলার সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের। কিন্তু শাহবাজ বলে দেন, ‘‘বেশি ফুচকা খাই না। যতটা খাই তাতে ক্রিকেটের ক্ষতি হবে না।’’ কিন্তু এ বার আইপিএলে বিরাট কোহালির রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স ব্যাঙ্গালোরের হয়ে খেলবেন। বিরাট যদি জানতে পারেন ফুচকা খাওয়ার ঘটনা? শাহবাজ হেসে বললেন, ‘‘চিন্তা নেই। বেঙ্গালুরুতে ভাল ফুচকা পাওয়া যায় না।’’