ক্রিকেট এবং বিজ্ঞানকে এক বিন্দুতে মিলিয়েছেন অনুরাধা দোড্ডবল্লপুর। কর্নাটকের প্রাক্তন এই ক্রিকেটার এখন জার্মানির জাতীয় মহিলা ক্রিকেট দলের অধিনায়ক। ক্রিকেটারের পাশাপাশি তাঁর আর এক পরিচয় তিনি কার্ডিয়ো ভাসকুলার বিজ্ঞানী।
৩৩ বছর বয়সি অনুরাধা স্বীকার করেন ক্রিকেট ও বিজ্ঞান একসঙ্গে চালিয়ে নিয়ে যাওয়া কঠিন। কিন্তু তাঁর কখনও মনে হয়নি একটার জন্য অন্যটাকে বাদ দিয়ে কোনওরকম আপস করতে হবে।
সম্প্রতি অস্ট্রিয়ার বিরুদ্ধে টি-২০ ম্যাচে তাঁর এক রানে পাঁচ উইকেট শিরোনামে উঠে এসেছে। বিশ্বের প্রথম মহিলা ক্রিকেটার হিসেবে তিনি চার বলে চার উইকেট পেয়েছেন টি-২০ ম্যাচে।
আদতে মিডিয়াম পেসার অনুরাধা অবশ্য রেকর্ডের অংশীদার হতে পেরেছেন স্পিন বোলিং করে। ইনিংসের পনেরোতম ওভারে তিনি হঠাৎ সিদ্ধান্ত নেন স্পিন করবেন। তাতেই বাজিমাত। বিশ্ব ক্রিকেটে অনুরাধা ছাড়া টি-২০ তে চার বলে চার উইকেট শিকারের কৃতিত্ব আছে শুধু লসিথ মালিঙ্গা ও রশিদ খানের।
আদতে বেঙ্গালুরুর বসনাভনানগুডির ভূমিকন্যা অনুরাধা ক্রিকেটপ্রেম পেয়েছিলন তাঁর বাবার কাছ থেকে। টেস্ট ক্রিকেটের ভক্ত ছিলেন তাঁর বাবা। বাবার সঙ্গে টিভির সামনে বসে অনুরাধাও অনুরাগী হয়ে পড়লেন সচিন তেন্ডুলকরের।
নাকে জিঙ্ক অক্সাইডের সাদা প্রলেপ দেওয়া বিধ্বংসী অ্যালান ডোনাল্ডও তাঁর খুব প্রিয়। তেন্ডুলকর-ডোনাল্ড দ্বৈরথই ক্রিকেটকে তাঁর কাছে রোমান্টিক করে তুলেছিল। বলছেন, অনুরাধা। ১৯৯৮ সালে ১২ বছর বয়সে শুরু হয় তাঁর ক্রিকেট প্রশিক্ষণ। সে সময় অবশ্য ভারতে মেয়েদের ক্রিকেট বর্তমান অবস্থার তুলনায় পিছিয়ে অনেকটাই।
অনূর্ধ্ব ১৬ ও অনূর্ধ্ব ১৯ স্তরে তিনি দীর্ঘদিন কর্নাটকের প্রতিনিধিত্ব করেছেন। পড়াশোনা আর ক্রিকেট চলছিল হাত ধরাধরি করেই। কিন্তু একটা সময় পড়াশোনার জন্য কিছুটা থমকে গেল ক্রিকেট-যাত্রা।
বেঙ্গালুরু থেকে বায়োটেকনলজিতে ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করার পরে উচ্চশিক্ষার জন্য লন্ডন পাড়ি দিলেন তিনি। নিউক্যাসল ইউনিভার্সিটি থেকে মেডিক্যাল জেনেটিক্সে স্নাতকোত্তর সম্পূর্ণ করেন। তবে ক্রিকেট কিন্তু পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেল না।
ইংল্যান্ডে গিয়েও কাউন্টি ও ক্লাব ক্রিকেট খেললেন অনুরাধা। বিশ্ববিদ্যালয়ের হয়েও প্রতিনিধিত্ব করেছেন তিনি। ২০১১ সালে পিএইচডি করার সুযোগ পেলেন জার্মানির গ্যেয়েঠে ইউনিভার্সিটি থেকে। এক বছর লাগল নতুন শহর ফ্রাঙ্কফুর্টের জীবনযাত্রার সঙ্গে মানিয়ে নিতে।
অনুরাধা জানতেন তিনি ত্রিকেট ছাড়া বাঁচতে পারবনে না। কার্ডিয়োভাসকুলার বায়োলজি নিয়ে গবেষণার ফাঁকে তিনি খুঁজতে লাগলেন স্থানীয় ক্রিকেটক্লাব। সন্ধান পেলেন ফ্রাঙ্কফুর্ট ক্রিকেট ক্লাবের। কিন্তু তাদের তখনও মহিলা ক্রিকেট দল ছিল না।
তাতে থেমে থাকলেন না অনুরাধা। মহিলা দল নেই, তো কী হয়েছে? ২০১৩-১৪ মরসুমে তিনি খেললেন ফ্রাঙ্কফুর্টের পুরুষ দলের হয়েই। এর পর দু’বছর কোলন শহরের মহিলা ক্রিকেট দলের হয়ে খেলেন জার্মানির ঘরোয়া ক্রিকেট টুর্নামেন্ট বুন্দেশলিগায়। এর পর ফ্রাঙ্কফুর্টে মহিলা ক্রিকেট দল তৈরির পিছনেও উদ্যোগ নেন তিনি।
জার্মানিতে জনপ্রিয়তার নিরিখে অন্যান্য খেলার তুলনায় বহু পিছিয়ে ক্রিকেট। অনুরাধা ঠিক করলেন দেশ জুড়ে জনপ্রিয় করতে হবে বাইশ গজের খেলাকে। বিভিন্ন ক্লাব ও বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘুরে ঘুরে তিনি প্রচার করতে লাগলেন। বিলি করলেন পুস্তিকা।
মহিলাদের জন্য তাঁর বক্তব্য ছিল, ‘‘আমরা মহিলাদের নিয়ে একটি দল শুরু করতে চাই। ক্রিকেট না জানলেও চলবে। উৎসাহ থাকলে যোগ দিন। এক বার অন্তত চেষ্টা করুন।’’
২০১৩ সালে অনুরাধা প্রথম জার্মানির হয়ে প্রতিনিধিত্ব করেন ইউরোপিয়ান টি-২০ টুর্নামেন্টে। চার বছর পরেই জাতীয় দলের অধিনায়কত্বের দায়িত্ব।
ক্রিকেটার হিসেবে নিজের কেরিয়ারের পাশাপাশি অনুরাধা চেষ্টা করে চলেছেন নতুন প্রজন্মের মধ্যে ক্রিকেটকে আরও জনপ্রিয় করে তুলতে। তিনি নিয়মিত প্রশিক্ষণও দেন। কিশোরীদের তিনি বেশি করে আকৃষ্ট করতে চান ক্রিকেটের প্রতি। খেলাটার প্রতি তাদের জনপ্রিয়তা ধরে রাখতে নিত্যনতুন উপায়ও বার করেন তিনি।
সম্প্রতি সোশ্যাল মিডিয়ায় জার্মানি-অস্ট্রিয়া ক্রিকেট ম্যাচ লাইভ স্ট্রিমিং হয়েছে। সেখানে নেটাগরিকদের ফিডব্যাক দেখে উৎসাহিত অনুরাধা। তাঁর আশা, ভবিষ্যতে জার্মানিতে ক্রিকেটও উঠে আসবে জনপ্রিয়তার প্রথম সারিতে।
জীবনের শেষ শক্তিবিন্দু অবধি বিজ্ঞান ও ক্রিকেট নিয়ে কাজ করে যেতে চান কার্ডিয়ো ভাসকুলার বিজ্ঞানী তথা জার্মানির মহিলা ক্রিকেটের জাতীয় দলের অধিনায়ক অনুরাধা দোড্ডবল্লপুর।