অতীত ও বর্তমান। সদানন্দ বিশ্বনাথ।
ভারতীয় ক্রিকেটের ভাগ্যবিড়ম্বিত মুখ তিনি। অসামান্য প্রতিভা। যার ঝলকানিতেই চমৎকৃত হয়েছিল বিশ্বক্রিকেট। কিন্তু তা বিকশিত হল না। পারিবারিক ট্র্যাজেডির ধাক্কা সামলাতে না সামলাতে টান পড়ল পারফরম্যান্সে। এল চোট। সঙ্গে অন্য উপসর্গ। হতাশা গ্রাস করল ক্রমশ। দাঁড়ি টেনে দিল সদানন্দ বিশ্বনাথের কেরিয়ারে।
কর্নাটকি অবশ্য এখনও ক্রিকেটকে জড়িয়েই রয়েছেন প্রাণপণে। কিন্তু, তাতেও হার্ডলগুলো ঠিকই থেকে গিয়েছে। নিজের অ্যাকাডেমি খুলেছিলেন। কয়েক বছর পর সেটাও বন্ধ করতে হয়েছে জায়গার অভাবে। বাইশ বছর আম্পায়ারিং করেছেন। কিন্তু ভারতীয় ক্রিকেট কন্ট্রোল বোর্ডের নীতিতে ৫৫ বছর বয়সে সেখান থেকেও অবসর নিতে হয়েছে। তরুণ আম্পায়ারদের সুযোগ দেওয়ার জন্য বসিয়ে দেওয়া হয়েছে সিনিয়রদের। গত বছর তাই সুপ্রিম কোর্ট নিযুক্ত প্রশাসকদের কমিটির কাছে ম্যাচ রেফারি হিসেবে কাজ করার আবেদন জানিয়েছিলেন। কারণ, ম্যাচ রেফারিরা ৬০ বছর পর্যন্ত কাজ করতে পারেন। কিন্তু এখনও পর্যন্ত কোনও সাড়া পাননি সিওএ-র তরফে। ফলে জীবন চলছে বটে, কিন্তু ৫৬ বছর বয়সির সঙ্গী আর্থিক অনিশ্চয়তা।
সুনীল গাওস্করের ১৯৮৫ সালে ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়নশিপ জয়ী দলের তিনি ছিলেন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য। নিজের বইতে লিটল মাস্টার লিখেওছিলেন যে ভারতের চ্যাম্পিয়ন হওয়ার নেপথ্যে বড় অবদান ছিল বিশ্বনাথের। কিন্তু মুছে যাওয়া দিনগুলো যতই পিছু ডাক দিক, সোনালি অতীতে ফেরা যায় না।
আরও পড়ুন: ঝুঁকি নিয়েও দল তৈরি করতে চান নেতা কোহালি
আরও পড়ুন: অদ্ভুত অ্যাকশন, তাই ভয়ঙ্কর বুমরা, বললেন জাহির
আর তাই চোখ থাকছে বর্তমানে। দেখেছেন দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে টি-টোয়েন্টি সিরিজ। দেখেছেন ঋষভ পন্থকে। আর তাই দ্বিধাহীন ভাবেই ২ অক্টোবর থেকে টেস্ট সিরিজে উইকেটের পিছনে ঋদ্ধিমান সাহাকে দেখার অপেক্ষায়। আনন্দবাজার ডিজিটালকে ফোনে বললেন, “দেখুন, জাতীয় নির্বাচকরা আগে জানিয়ে দিয়েছিলেন যে কোনও সিনিয়র ক্রিকেটার চোট সারিয়ে ফিরে এলে তাঁকে দলে আনা হবে। আমার তাই মনে হয় ঋদ্ধিমানের আর একটা সুযোগ প্রাপ্য। জানি না কেন বা কবে এই নীতিতে বদল এসেছে। ওয়েস্ট ইন্ডিজে দেখলাম টেস্টে ঋষভ কিপিং করছে আর ঋদ্ধিমান বাইরে বসে রয়েছে। এটাতে আমি রীতিমতো অবাক। কারণ, অজিঙ্ক রাহানে কিন্তু চোট সারিয়ে ফিরে এসে ঢুকে পড়েছিল টেস্ট দলে। ঋদ্ধির বেলায় কোন সেটা হল না, আমার জানা নেই।”
তিনি নিজেও ভাগ্যবিড়ম্বিত। সেজন্যই ‘সুপারম্যান সাহা’ পাচ্ছেন সমবেদনা। ঋদ্ধির যে সুযোগ প্রাপ্য, এই বিশ্বাস জ্বলন্ত। বলছেনও বারবার। তাছাড়া ঘরের মাঠের মন্থর ও নিচু বাউন্সের উইকেটে উইকেটকিপারের যে বাড়তি স্কিল প্রয়োজন, সেটাও মাথায় রাখতে বলেছেন। বিশ্বনাথের যুক্তি, “উপমহাদেশে কিপিং সবসময়ই চ্যালেঞ্জের। কিপারকে টেকনিক্যালি দক্ষ থাকতেই হবে। মারাত্মক ফিট, তৎপরও হতে হবে। ঋদ্ধিমান টেকনিক্যালি ঋষভ পন্থের থেকে বেশি দক্ষ।” টেস্ট ক্রিকেটে যে বিশেষজ্ঞ কিপারেই বেশি গুরুত্ব দেওয়া উচিত, মনে করিয়ে দিয়েছেন তিনি। সাফ বলেছেন, “আমার মতে একজন কিপারের ব্যাটিং বরাবরই বোনাস। অন্তত টেস্টে তো বটেই। টেস্টে স্পেশ্যালিস্ট লাগবেই, স্টপগ্যাপ কিপার দিয়ে চলবে না। অনেক দল অবশ্য সে ভাবেই চালায়। আর তার জন্য চড়া মূল্যও দেয়। এখন তাই সমস্ত আন্তর্জাতিক দলই বিশেষজ্ঞ কিপার খেলাচ্ছে। আবার এটাও ঠিক যে ব্যাটিং বেটার হলে একটা সুবিধা থেকেই যায়। ঋদ্ধিমান কিন্তু ব্যাটসম্যান হিসেবে লড়াকু। ও ওপেনও করতে পারে। সাত বা আট নম্বরে তাই দ্বিতীয় নতুন বল খেলার ক্ষমতাও ধরে।”
উইকেটকিপিংয়ের দক্ষতা বেশি বলেই দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে টেস্ট সিরিজে ঋদ্ধিকে চাইছেন বিশ্বনাথ। ছবি: পিটিআই।
টেস্ট ক্রিকেটে ৪৪.৩৫ গড়ে ৭৫৪ রান রয়েছে ঋষভ পন্থের। রয়েছে ইংল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়ায় টেস্ট সেঞ্চুরি। ঋদ্ধিমান সাহার রেকর্ড কিন্তু একেবারেই খারাপ নয়। ৩০.৬৩ গড়ে ১১৬৪ রানে রয়েছে তিনটি শতরান। ‘বেটার কিপার’ তো বটেই, ব্যাটসম্যান ঋদ্ধির উপরও ভরসা রাখছেন বিশ্বনাথ। দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে ঋদ্ধিকে টেস্ট দলে দেখতে চাওয়ার যুক্তি হিসেবে বলছেন কলকাতা ময়দানের ‘পাপালি’র ব্যাটিংয়ের কথাও। বললেন, “ওয়েস্ট ইন্ডিজে রবিচন্দ্রন অশ্বিনের সঙ্গে জুটি, সেই শতরানের ইনিংসের কথা ভুলে যাইনি কিন্তু।” অর্থাৎ, ঋষভ যতই মহেন্দ্র সিংহ ধোনির উত্তরসূরি হিসেবে চিহ্নিত হন, টেস্টের আসরে তাঁর ভোট থাকছে বঙ্গসন্তানেই।
কিন্তু ঋষভকে কেমন লেগেছে কিপার হিসেবে? বিশ্বনাথের মূল্যায়ন, “নিঃসন্দেহ আকর্ষণীয় ট্যালেন্ট। ও ক্রমশ উন্নতি করবে। বয়স কম, খুব ফিট। প্রচুর সুযোগ পাবে ও। অভিজ্ঞতা যত বাড়বে, তত উন্নতির রাস্তায় থাকবে।” প্রোটিয়াদের বিরুদ্ধে সদ্যসমাপ্ত টি-টোয়েন্টি সিরিজে যদিও ঋষভের শট-বাছাই নিয়ে উঠছে প্রশ্ন। তার আগে ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরেও চাপের মুখে জঘন্য শটে দলকে বিপদে ফেলে দেওয়ার অভিযোগও রয়েছে। বিশ্বনাথ অবশ্য ওভারের ক্রিকেটে ভরসা রাখতে চাইছেন। তাঁর মতে, “ও শিখবে। একটু সময় দেওয়া হোক না। ভুল থেকেই মানুষ শেখে। আর ভুল সবাই করে। ভুল করলেই তা ইমপ্রুভ করা যায়। তাই উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই। কোথায় সমস্যা, কোথায় দুর্বলতা সেগুলো জানতে পারছে এ ভাবে। আমি নিশ্চিত, আগামী দিনে ওর শট বাছাইয়ে উন্নতি ঘটবে।”
আরও পড়ুন: আজ শুরু অভিযান, গুজরাতের বিরুদ্ধে গতিই অস্ত্র বাংলার
আরও পড়ুন: শ্রীনিদের ‘দুরভিসন্ধি’ নিয়ে ফের আদালতে সিওএ
জাতীয় নির্বাচকরা যে ওভারের ফরম্যাটে সঞ্জু স্যামসন, ঈশান কিশানকে বিকল্প হিসেবে তৈরি রাখতে চাইছেন অজানা নয় বিশ্বনাথের। আবার পাঁচদিনের ফরম্যাটে ঋদ্ধি-ঋষভ ছাড়া নতুনদের মধ্যে কেএস ভরতের নামও মাথায় রয়েছে নির্বাচকদের। যিনিই সুযোগ পাবেন, তাঁকে যে সুযোগ হাতছাড়া করলে চলবে না তা নিয়ে দ্বিধাহীন বিশ্বনাথ। বলেই দিলেন, “এখন প্রচুর কম্পিটিশন কিপারের জায়গায়। তাই সুযোগ নষ্ট করলে চলবে না। যখন যেই সুযোগ পাক, তা দু’হাতে আঁকড়ে ধরতে হবে।”
সুযোগ অবশ্য তিনি নিজেও আঁকড়ে ধরতে পারেননি। তিন টেস্ট ও ২২ ওয়ানডে খেলে ছিটকে যেতে হয়েছে। জীবনও থমকে গিয়েছে বার বার। পারিবারিক জীবন সুখের হয়নি। কিছু বদভ্যাসও বাড়িয়েছে সমস্যা। বাড়ি না থাকায় কখনও থাকতে হয়েছে হোটেলে অন্যের সঙ্গে রুম ভাগাভাগি করে। কখনও জীবিকার সন্ধানে চলে যেতে হয়েছে বিদেশে। সেখানে মন না টেঁকায় ফের ফিরে আসা। এখন ভাবছেন জাতীয় ক্রিকেট অ্যাকাডেমির চেয়ারম্যান রাহুল দ্রাবিড়ের সঙ্গে দেখা করবেন। লেভেল থ্রি কোচিং নেওয়া আছে তাঁর। আম্পায়ারিং আর হবে না, কিন্তু কোচিং তো সম্ভব। সেটাই বোঝাবেন দ্রাবিড়কে।
এখন প্রমোটারের সঙ্গে জয়েন্ট ভেঞ্চারে বানিয়েছেন বাড়ি। পেয়েছেন দুটো লাক্সারি ফ্ল্যাট। তার একটা বিক্রি করতে চাইছেন জলদি। না হলে যে ধার-দেনা শোধ করা মুশকিল হয়ে পড়ছে।
যা দাঁড়াচ্ছে, বিশ্বনাথের জীবন মোটেই সদা আনন্দের নয়। তা সে যতই নামের সঙ্গে সারাজীবন ‘সদানন্দ’ বইতে হোক না কেন!