১৯৮৫ সালের বেনসন অ্যান্ড হেজেস ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়নশিপে সেরা হওয়া গাওস্করের ভারত। —ফাইল চিত্র।
কট সদানন্দ বিশ্বনাথ, বোল্ড রবি শাস্ত্রী। ৩৫ বছর আগের কোনও এক স্কোরবোর্ডে চোখ রাখলে যা নজরে পড়বে। কে জানত, সেই যুগলবন্দি জারি এখনও!
সদ্য ১৯৮৫ সালে অস্ট্রেলিয়ায় বেনসন অ্যান্ড হেজেস ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়নশিপ অফ ক্রিকেট জয়ী ভারতীয় দলের প্রশংসায় মুখর হয়েছেন শাস্ত্রী। সেই টুর্নামেন্টের সেরা ক্রিকেটারের ঘোষণা, বিরাট কোহালির এখনকার দলকে হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ে ফেলে দিতে পারত সুনীল গাওস্করের সেই দল। চ্যাম্পিয়ন দলের অন্যতম সদস্য অবশ্য আরও একধাপ এগিয়ে দাবি করলেন, লড়াই-ফড়াই নয়, তাঁদের সেই দল এখনকার ভারতীয় দলকে ৫০ ওভারের ম্যাচে অবশ্যই হারিয়ে দিত।
আরও পড়ুন: দুশ্চিন্তা মাথায় নিয়েই ঘরবন্দি ময়দান মজেছে আঁকা-গান-রান্নায়
বৃহস্পতিবার সকালে আনন্দবাজার ডিজিটালকে বেঙ্গালুরু থেকে প্রাক্তন উইকেটকিপার-ব্যাটসম্যান বললেন, “দুটো আলাদা সময়, দুটো আলাদা দল। তুলনা করা সহজ নয়। তবে উইজডেন কিন্তু আমাদের সেই দলের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছিল। শাস্ত্রী দারুণ কথা বলেছে। একদম ঠিকঠাক প্রশংসা করেছে আমাদের সেই দলের। আমারও মনে হয়, এই ভারতীয় দলের মহড়া নেওয়ার ক্ষমতা আমাদের ছিল। আর আমরা হয়তো হারিয়েও দিতাম বিরাট কোহালিদের। আমাদের দলের শক্তি ছিল অলরাউন্ডাররা। অলরাউন্ডারে ভর্তি ছিল দল। কপিল দেব, মোহিন্দর অমরনাথ, রজার বিনি, মদনলাল, স্বয়ং শাস্ত্রী। ফলে, দেশে-বিদেশে, যে কোনও পরিবেশে আমাদের সেই দল নিজেদের প্রয়োগ করতে পারত। পেসার-স্পিনার, সব বিভাগই ছিল তীক্ষ্ণ। ব্যাটিংয়েও ছিল গভীরতা। শুরুতে কৃষ্ণমাচারি শ্রীকান্ত-রবি শাস্ত্রী। মহম্মদ আজহারউদ্দিন, মোহিন্দর অমরনাথ, দিলীপ বেঙ্গসরকর, সুনীল গাওস্কর মিডল অর্ডারে। তার পর ছিল কপিল দেব। যদি এখনকার দলের সঙ্গে খেলা হত, উপভোগ্য ম্যাচ হত। তবে জিততাম আমরাই।”
১৯৮৫ সালে শারজায় রথম্যানস কাপের ফাঁকে ঋষি কপূর ও অফস্পিনার অশোক প্যাটেলের সঙ্গে বাঁ দিকে সদানন্দ বিশ্বনাথ। —নিজস্ব চিত্র।
অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে তেরঙা ওড়ানো সেই দলের বিশেষত্ব কী ছিল? সদানন্দ বিশ্বনাথের বিশ্লেষণ, “শাস্ত্রী বলেইছে যে আমাদের সেই দলে অভিজ্ঞতা ও তারুণ্যের দুর্দান্ত মিশ্রণ ছিল। কী সব দুর্দান্ত ক্রিকেটার ছিল সেই দলে। ওই সব গ্রেটদের সঙ্গে একই দলে খেলাই একটা গর্বের ব্যাপার। ওই সময়টা রীতিমতো উপভোগ করেছিলাম। সেই দলে আমি ছাড়াও নতুনদের মধ্যে ছিল লক্ষ্মণ শিবরামকৃষ্ণণ ও মহম্মদ আজহারউদ্দিন। আরও এক জন ছিল দলে। মনোজ প্রভাকর। তবে ও কোনও ম্যাচে খেলেনি। চেতন শর্মা ছিল দলে। ও ফাইনালেও খেলেছিল। কারণ, রজার বিনির ফ্লু হয়েছিল। বিনির জায়গায় এগারোয় এসেছিল চেতন। ফাইনালে পাকিস্তানকে হারিয়েছিলাম আমরা।”
আরও পড়ুন: সিডনি টেস্টের ওই ঘটনা ধোনিকে পাল্টে দিয়েছিল, বললেন হরভজন
সেই বছরই আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেক হয়েছিল সদানন্দের। বেনসন হেজেস কাপেই নিজের প্রতিভা মেলে ধরেন তিনি। প্রশংসিত হন ক্রিকেটমহলে। প্রতিযোগিতা শুরুর আগেই শিবরামকৃষ্ণণকে বিশ্বনাথ বলেছিলেন যে, ভারতই চ্যাম্পিয়ন হবে। তাঁর কথায়, “আমরা ছিলাম আন্ডারডগ। অস্ট্রেলিয়ায় যখন পৌঁছেছিলাম তখন কেউই আমাদের গুরুত্ব দেয়নি। তার আগে দেশের মাঠে ডেভিড গাওয়ারের দলের কাছে হেরে গিয়েছিলাম। ফলে কোনও প্রত্যাশা ছিল না আমাদের উপর। ভারত যে জিততে পারে, সেটা বেশির ভাগ মানুষেরই মনে হয়নি। আমরা সবাইকেই ভুল প্রমাণ করেছিলাম। আমি কিন্তু প্রতিযোগিতা শুরুর আগেই শিবরামকৃষ্ণণকে বলেছিলাম যে চ্যাম্পিয়ন হবই।”
টাইম মেশিনের সওয়ারি হয়ে বিশ্বনাথ যেন ফিরে গেলেন সোনালি সেই সব দিনে। বললেন, “চ্যাম্পিয়ন হওয়ার নেপথ্যে ছিল সুনীল গাওস্করের অসাধারণ নেতৃত্ব। আর অবশ্যই ক্রিকেটারদের অলরাউন্ড পারফরম্যান্স। আমাদের নতুন বলের বোলাররা শুরুতে নিয়মিত উইকেট নিয়েছিল। যখন স্পিনাররা আক্রমণে আসত, তার আগেই বিপক্ষের কয়েকটা উইকেট পড়ে যেত। কপিল দেব দুরন্ত ফর্মে ছিল। নতুন বলে রজার বিনি সুইং করাত। মদন লাল নিয়মিত উইকেট নিত। অমরনাথও নিজের ভূমিকা পালন করত। এর পর স্পিনাররা এসে চাপ বজায় রাখত। দুই স্পিনার শিবরামকৃষ্ণণ ও শাস্ত্রী পরিকল্পনা ঠিকঠাক মেলে ধরত। টাইট লাইন-লেংথে বল করত। অস্ট্রেলিয়ার উইকেট তো বাউন্সি। কিন্তু ওরা বাতাসে বল ভাসিয়ে দিত। ফ্লাইটে বিভ্রান্ত করত ব্যাটসম্যানদের। প্রত্যেক ম্যাচেই বিপক্ষের সব উইকেট ফেলে দিয়েছিলাম আমরা। ব্যতিক্রম একমাত্র ফাইনাল। তবে সেই ম্যাচেও পাকিস্তান নয় উইকেট খুইয়েছিল।”
১৯৮৫সালেই মুম্বইয়ে এক নৈশভোজের পার্টিতে সদানন্দ বিশ্বনাথ। —নিজস্ব চিত্র।
পেসার-স্পিনাররা তো বটেই, স্টাম্পের পিছনে চকিত রিফ্লেক্সে মুগ্ধ করেছিলেন বিশ্বনাথ। বললেন, “১২টা শিকার ছিল গোটা টুর্নামেন্টে। স্বপ্নের মতো লাগছিল সব কিছু। রিচার্ড হ্যাডলি, ইমরান খানের মতো কিংবদন্তিদের বিরুদ্ধে খেলেছিলাম।” সেই সিরিজের ব্লেজার, ট্র্যাভেল ব্যাগ এখনও রেখে দিয়েছেন সযত্নে। নাড়াচাড়া করলেও যে ভিড় করে আসে সেই দিনগুলো।
স্মৃতিতে উজ্জ্বল তার কয়েক দিন পরেই শারজায় রথম্যানস কাপের সাফল্য। সেমিফাইনালে সামনে পাকিস্তান। এবং মাত্র ১২৫ রানে শেষ হয়ে গিয়েছিল ভারত। বোলিংয়ের আগে অধিনায়ক কপিল দেব যে ভাবে উদ্দীপ্ত করেছিলেন, সেটাও স্মৃতিতে টাটকা। বিশ্বনাথের কথায়, “১০ মার্চ আমরা মেলবোর্নে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলাম। তার দুই সপ্তাহের মধ্যেই শারজায় সামনে পাকিস্তান। গাওস্কর নেতৃত্ব ছেড়ে দিয়েছিল মেলবোর্নে চ্যাম্পিয়ন হয়েই। রথম্যানস কাপে আমাদের ক্যাপ্টেন ছিল কপিল। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে কম রানের পুঁজি নিয়েও আমাদের উদ্দীপ্ত করেছিল ও। আমিও ড্রেসিংরুমে বলেছিলাম, জিতব। মনে আছে, গাওস্কর আমাকে সমর্থন করে ঝাঁপিয়ে পড়তে বলেছিল। আমরা জিতেওছিলাম। চ্যাম্পিয়নও হই ফাইনালে অস্ট্রেলিয়াকে হারিয়ে। ওই মার্চ মাসেই।”
আরও পড়ুন: অভিষেকের আগের দিন লর্ডসে... ২৪ বছর আগের ছবি পোস্ট করলেন সৌরভ
গাওস্কর আর কপিল, একই মাসে দুই ক্যাপ্টেনের নেতৃত্বে দুই দেশে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল ভারত। কে কেমন অধিনায়ক? বিশ্বনাথের ব্যাখ্যা, “কপিল সামনে দাঁড়িয়ে নেতৃত্ব দিয়েছিল। গ্রেট অলরাউন্ডার। ব্যাটে রান করেছিল। বলে উইকেট নিয়েছিল। লড়াইয়ের মন্ত্র শুনিয়েছিল দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া অবস্থায়। গাওস্করও গ্রেট লিডার। আর দু’জনেরই নিজস্ব স্টাইল ছিল নেতৃত্বের। রেকর্ডই ওদের হয়ে কথা বলবে। কৃতিত্ব প্রাপ্য দু’জনেরই। ভারতীয় ক্রিকেটে ওদের অবদান চিরস্মরণীয়।”
এর পরই বিশ্বনাথ যেন স্বগতোক্তি করলেন, “দেখুন, সাফল্যের কোনও বিকল্প হয় না। কেউই পরাজিতদের মনে রাখে না। সাফল্য পেলেই তবে তা স্মৃতিতে থেকে যায়। সোনা জেতা সেই কারণেই জরুরি।”
বিরাট কোহালির দল এখনও সেই ‘সোনা’ জিততে পারেনি। গত বছর বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে হারতে হয়েছে। অন্য দিকে, ১৯৮৫-র ভারতীয় দল একই মাসে জিতেছিল মেলবোর্ন-শারজায়, উড়িয়েছিল তেরঙা। বিশ্বনাথ সেটাই মনে করিয়ে দিলেন!