ইলিশে কামড় দিয়ে মহানায়ক বললেন, এই না-হলে বাঙাল!

উত্তমকুমারের সঙ্গে সেটে ডার্বির লড়াই। সবুজ-মেরুন ভক্ত মহানায়ক, লাল-হলুদের তিনি ও তাঁর ভানুদা। লিখছেন সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়... ছোটবেলা থেকেই বাড়িতে দেখে এসেছি আমার বাবা শশধর চট্টোপাধ্যায় ও জামাইবাবুরা সব ইস্টবেঙ্গলের কট্টর সমর্থক।

Advertisement
শেষ আপডেট: ৩০ জুলাই ২০১৯ ১৯:৫০
Share:

সমর্থক: দুই বড় দলের দ্বৈরথে সাবিত্রী ও উত্তম ছিলেন দু’দিকে। ফাইল চিত্র

কুমিল্লায় জন্ম। ঢাকায় বড় হওয়া। তাই নিজেকে আমি একজন গর্বিত বাঙাল বলতেই ভালবাসি। পাশাপাশি ফুটবলে কোনও দিন লাথি না মারলেও আমি ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের একজন বড় ভক্ত। দেশভাগের পরে আমরা যারা ও-পার বাংলা থেকে এ-পার বাংলায় এসেছি, তাঁদের কাছে ইস্টবেঙ্গল ক্লাব ছিল একটা আত্মসম্মানের প্রতীক। আমার কাছে শতবর্ষে ছুঁতে যাওয়া ইস্টবেঙ্গল সে রকমই একটা প্রতিষ্ঠান।

Advertisement

ছোটবেলা থেকেই বাড়িতে দেখে এসেছি আমার বাবা শশধর চট্টোপাধ্যায় ও জামাইবাবুরা সব ইস্টবেঙ্গলের কট্টর সমর্থক। এ রকম পরিবেশে বড় হয়ে ওঠায় আমিও যে কবে লাল-হলুদের সমর্থক হয়ে গিয়েছিলাম, তা বলতে পারি না। তবে এটা মনে আছে, দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে যখন আমাদের গোটা পরিবার কলকাতায় চলে এল, তখন ইস্টবেঙ্গল হেরে গেলে বাড়ি শোকে পাথর হয়ে যেত। আর মোহনবাগানের বিরুদ্ধে হেরে গেলে বাবা যে কত বার রেডিয়ো মাটিতে আছড়ে ভেঙেছেন, তার ইয়ত্তা নেই। বাঙাল বলেই হয়তো এ রকম নিয়ন্ত্রণহীন আবেগ প্রিয় দলের জন্য!

কলকাতায় আসার আগে আমি ইস্টবেঙ্গল নামটার সঙ্গে পরিচিত থাকলেও সেই দলের কোনও ফুটবলারকে চিনতাম না। কিন্তু কলকাতায় এসেই প্রথম জানতে পারলাম, ইস্টবেঙ্গলের সব চেয়ে বড় খেলোয়াড় হলেন আমেদ খান। আর তাঁর নেতৃত্বে ‘পঞ্চপাণ্ডব’ দাপিয়ে বেড়ায় ভারতের সারা মাঠ। তত দিনে আমি অভিনয় জগতের সঙ্গে জড়িয়ে গিয়েছি। আর অভিনয় জীবনে প্রথম দিন থেকেই আমার পথপ্রদর্শক ছিলেন ভানুদা (বন্দ্যোপাধ্যায়)। আমার মতো ভানুদাও ছিলেন ঢাকার বাঙাল। একদিন ভানুদা এসে বললেন, ‘‘সাবিত্রী, তোরে পঞ্চপাণ্ডবের খেলা দেখাইতে লইয়া যামু।’’

Advertisement

এ ভাবেই কলকাতা ময়দানে আমার ইস্টবেঙ্গলের খেলা দেখতে যাওয়ার সূচনা। আর প্রথম দিন আমেদ খানের খেলা দেখেই আমি তাঁর ভক্ত হয়ে গিয়েছিলাম।

তার পরেও চার-পাঁচ বার পরিবারের সঙ্গে ইস্টবেঙ্গলের খেলা দেখতে মাঠে গিয়েছি। কিন্তু ছ’য়ের দশকের শুরু থেকে মাঠে যাওয়া বন্ধ করে দিতে হল। কারণ, মাঠে আমাদের দেখলে দর্শকরা ঘিরে ধরে অটোগ্রাফ চাইতেন। খুব অস্বস্তি হত। তাই যাওয়া বন্ধ করে দিলাম। কিন্তু প্রিয় দলের সব খবর রাখতাম। ততদিনে স্টুডিয়ো পাড়ায় আমাদের দু’টো দল হয়ে গিয়েছে। উত্তমবাবুরা মোহনবাগান। চুনীদা (চুনী গোস্বামী), মান্নাদার (শৈলেন মান্না) খেলার গল্প শুনিয়ে আমাদের আওয়াজ দেন। আর আমরা ইস্টবেঙ্গল। তুলসীদাস বলরাম, কিট্টু, রামবাহাদুর-রা গোল করলে আমরাও হইহই করে ঝাঁপিয়ে পড়তাম স্টুডিয়ো পাড়ার মোহনবাগান সমর্থকদের উপরে। নিশানা অবশ্যই উত্তমবাবু। আমাদের ইস্টবেঙ্গল সমর্থকদের নেতৃত্ব দিতেন ভানুদা।

ছয়ের দশকের মাঝামাঝি ইস্টবেঙ্গলে খেলতে এলেন পিটার থঙ্গরাজ। লম্বা, সুদর্শন গোলকিপার। আর খেলতেনও সে রকম দুর্দান্ত। খুব অল্প সময়েই আমি ভক্ত হয়ে গিয়েছিলাম তাঁর।

সে সময়ে মোহনবাগান বনাম ইস্টবেঙ্গল ম্যাচ থাকলেই আবহাওয়া গরম হয়ে উঠত স্টুডিয়ো পাড়ার। আর সেই কাজটা করার প্রধান কারিগর ছিলেন উত্তমবাবু। ম্যাচের দু’তিন আগে থেকেই আমাদের মধ্যে যাঁরা ইস্টবেঙ্গল সমর্থক, তাঁদের সঙ্গে রসিকতা শুরু করে দিতেন। আমার কাছে এসে মজা করে বলতেন, ‘‘আচ্ছা সাবু, ইস্টবেঙ্গল হেরে গেলে সে দিন একটা খাওয়াদাওয়ার আয়োজন হবে, তুই চিংড়ি খাবি তো?’’ এ রকম রসিকতা উনি বেশি করে করতেন আমার ও ভানুদার সঙ্গে।

তবে এতেই আমাদের স্টুডিয়ো পাড়ার মোহন-ইস্ট দ্বৈরথ শেষ হত না। ইস্টবেঙ্গল ম্যাচ হারলে শুরু হত তুমুল ঝগড়া। উত্তমবাবুদের সঙ্গে আমাদের। এই ঝগড়ায় নেতৃত্ব দিতাম আমি। কখনও কখনও এই ঝগড়া খুব বাজে জায়গায় চলে যেত। শিল্পীদের মধ্যে হাতাহাতি না হলেও ছ’-সাতদিন কথা বন্ধ হয়ে যেত। মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গল ম্যাচের পরে উত্তমবাবুর সঙ্গে আমার এ রকম পাঁচ-সাতবার কথা বন্ধ হয়েছে। তবে কখনও এই বাক্যালাপের বিরতি ১০ দিন অতিক্রম করেনি।

খুব সম্ভবত সেটা ১৯৬৭ সাল। ইডেনে প্রথম মোহনবাগানের বিরুদ্ধে দ্বৈরথে জিতল ইস্টবেঙ্গল। সেই ম্যাচের আগে আমি ও ভানুদা একটা দুর্দান্ত পরিকল্পনা সাজালাম। তা হল, ইস্টবেঙ্গল হারলে তো উত্তমবাবুদের টিপ্পনি সহ্য করতেই হবে। কিন্তু যদি ইস্টবেঙ্গল জিতে যায়, তা হলে আমরা স্টুডিয়ো পাড়ায় কোনও আনন্দ উৎসব করব না। যা মজা সব রাতে হবে। ম্যাচে ইস্টবেঙ্গল জিতে গিয়েছে খবর পাওয়ার পরেই, আমি সোজা চলে গেলাম লেক মার্কেটে। সেখান থেকে দু’টো বড়সড় ইলিশ মাছ নিয়ে বাড়ি ফিরলাম। বাড়ি ফিরেই শুরু করে দিলাম রান্না। রাত সাড়ে ন’টা নাগাদ উত্তমবাবু-সহ দু’-তিনজন মোহনবাগান বন্ধুকে ফোন করলাম। উত্তমবাবুকে ফোনে বললাম, ‘‘বাড়িতে একটা বড় ব্যাপার ঘটেছে। ভানুদা এসেছেন। তোমাকে আসতেই হবে। জলদি এসো।’’

এই ফোন পেয়ে ঘাবড়ে গিয়ে উত্তমবাবু পনেরো মিনিটের মধ্যেই হাজির। আমি, ভানুদা-সহ আমাদের ইস্টবেঙ্গল সমর্থকদের কয়েকজনকে দেখে অবাক হয়ে বললেন, ‘‘কী হয়েছে রে?’’ আমিও কম যাই না। বললাম, ‘‘বসো। বলছি।’’ ততক্ষণে উত্তমবাবুর মোহনবাগান সমর্থক বন্ধুরাও হাজির। আর দেরি নয়। উত্তমবাবু-সহ বাকি অতিথিদের ডাইনিং টেবিলে নিয়ে গেলাম। উত্তমবাবু ফের বললেন, ‘‘ব্যাপারটা কী বল তো?’’ এ বার আমি আর ভানুদা হাসতে শুরু করেছি। প্রত্যেকের খাওয়ার প্লেটে তত ক্ষণে ইলিশ মাছ ভাজা চলে এসেছে। এ বার আমি উত্তমবাবু যে ভাবে বলতেন, সে ভাবেই বললাম, ‘‘আজ তো মোহনবাগান হেরে গিয়েছে, তুমি ইলিশ খাবে তো।’’ এতক্ষণে বুঝলেন কী পরিকল্পনা আমরা সাজিয়েছি। মহানায়ক হো হো করে হাসতে শুরু করে দিলেন। ভাজা ইলিশে কামড় দিয়ে বললেন, ‘‘এই না হলে বাঙাল। ঘা খেলে বদলা নিয়েই ছাড়বে।’’

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement