ময়দানের ফুটবলারদের স্মৃতিতে চুনী গোস্বামী। গ্রাফিক: তিয়াসা দাস।
চুনী গোস্বামীর প্রয়াণে ময়দানে শোকের ছায়া। পিকে বন্দ্যোপাধ্যায়ের পর ময়দান হারাল আরও এক ফুটবল-নক্ষত্রকে। আর সেটাও এমন একটা সময়, যখন লকডাউনের ফলে সকলেই ঘরবন্দি। ফলে ফুটবলপ্রেমীদের পক্ষে প্রকাশ্যে জড়ো হয়ে শ্রদ্ধা জানানোর উপায়ও নেই। তবে স্মৃতিতে বার বার উঠে আসছে চুনী গোস্বামীর নানা মুহূর্ত।
সুরজিৎ সেনগুপ্ত
চুনীদার মৃত্যু খুবই দুঃখজনক। তিনি তো শুধু ফুটবলার নন। তিনি ক্রিকেট খেলেছেন বাংলার হয়ে। টেনিসও খেলেছেন জয়দীপ মুখোপাধ্য়ায়ের সঙ্গে সমানতালে। চুনীদা ছিলেন বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী। এক দিকে যেমন এশিয়ান গেমসে চ্যাম্পিয়ন হচ্ছেন। অন্য দিকে আবার বাংলার হয়ে রঞ্জি ফাইনালও খেলছেন। শুধু বাংলাতেই নয়, গোটা বিশ্বেই এমন উদাহরণ বিরল।
চুনীদা আমাকে খুব ভালবাসতেন। ১৯৭৬ সালে সন্তোষ ট্রফিতে চুনীদার জন্যই আমি ক্যাপ্টেন হয়েছিলাম বাংলার। কোচ অরুণ ঘোষের কাছে শুনেছি, আইএফএ সচিব অশোক ঘোষ নির্বাচনী সভার পর চুনীদার কাছে জানতে চেয়েছিলেন, কে অধিনায়ক হবে? চুনীদা বলে দেন, “সুরজিৎই ক্যাপ্টেনসি করবে।”
আরও পড়ুন: হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে প্রয়াত চুনী গোস্বামী
আমাদের কাছে ছিলেন আইডলের মতো চুনীদা। দীর্ঘ দিন রাজত্ব করেছেন ফুটবল মাঠে। এক বার পাটনায় ছিল সন্তোষ ট্রফি টুর্নামেন্ট। চুনীদা ছিলেন নির্বাচক মণ্ডলীর চেয়ারম্যান। সে সময় চুনী গোস্বামী মানে চুনী গোস্বামী! যা বলবেন তার অন্যথা হবে না। আর চুনীদার এমনই একটা উচ্চতা ছিল যে, তিনি যা বলতেন, তা সকলে মেনে নিতেন। তাঁর কথা কেউ অগ্রাহ্য করতে পারতেন না।
চুনীদার মধ্যে একটা গ্ল্যামার ছিল। আমি বিশ্বাস করি, চুনীদা মৃত্যুর পর যেখানে গিয়েছেন, সেখানেও এই গ্ল্যামার তাঁর সঙ্গী হবে।
সত্যজিৎ চট্টোপাধ্যায়
চুনীদা মানেই আমাদের হৃদয়ের কাছের মানুষ। প্রাণের ব্যাপার। ভাবতেই পারছি না, চুনীদা নেই। ছোট থেকেই চুনীদাকে দেখেছি। আমাকে খুব পছন্দ করতেন। তাঁকে নিয়ে অজস্র স্মৃতি রয়েছে আমার। তিনি ড্রিবলিং ভালবাসতেন। বলতেন, “ফুটবলে এটাই সবচেয়ে কঠিন স্কিল।” ফুটবলারদের মধ্যে লিওনেল মেসিকে খুব পছন্দ করতেন চুনীদা।
আমি কোচিং করতাম বলে আমাকে পরামর্শ দিতেন, যদি কেউ ড্রিবল করতে পারে, তাকে যেন আলাদা করে গুরুত্ব দিই। চুনীদা নিজেও তো ড্রিবলিং করতেন দুর্দান্ত! তিনি নিজেকে বলতেন, ‘ভারতীয় ফুটবলের গ্রেটেস্ট’। সত্যিই তাই! চুনীদার মতো কেউ হতে পারবেন না। ভারতীয় ফুটবলে (শৈলেন) মান্নাদা, চুনীদা, প্রদীপদা (পিকে বন্দ্যোপাধ্যায়)— সকলেই অমর।
কিছু দিন আগেই প্রদীপদা চলে গেলেন। তার পর আরও এক ধাক্কা! ভাবতেই পারছি না, চুনীদা নেই। চিরকাল মোহনবাগানের হয়ে খেলেছেন। ফলে মোহনবাগানিদের যেন সহজেই চিনে নিতে পারতেন। অনেকের মাঝে থেকেও ঠিক টের পেয়ে যেতেন, কাদের সঙ্গে সবুজ-মেরুনের আত্মিক যোগ রয়েছে। আর তাঁদেরকে একটু বেশি পছন্দ করতেন। সেই তালিকায় আমিও ছিলাম। তা ছাড়া, পারিবারিক একটা যোগও ছিল। আমার ঠাকুরদা কার্তিকচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় হাওড়া ইউনিয়নে খেলতেন। কিন্তু, মোহনবাগান তাঁবুতে এসে আড্ডা দিতেন। সেই সূত্রেই গোষ্ঠ পাল, বলাইদাস চট্টোপাধ্যায়দের চিনতেন। এটা চুনীদা জানতেন। মোহনবাগানি পরিবার বলেও আমাকে ভালবাসতেন। আমার সঙ্গে সেই সূত্রেও একটা অন্য রকমের সম্পর্ক ছিল।
আরও পড়ুন: আজন্ম প্রেমিক নায়ক ছিলেন ঋষি, আরও বিবর্ণ হল বলিউড
চুনীদা যখন মোহনবাগানের ম্যানেজার ছিলেন, তখন প্রায়শই খেলার সময় রিজার্ভ বেঞ্চে এসে বসতেন। তখন সেখানে বসার ক্ষেত্রে এখনকার মতো এতটা কড়াকড়ি ছিল না। ফলে খেলাটা কী ভাবে এগোচ্ছে, কী করা দরকার— নানা বিষয়েই পরামর্শ দিতেন চুনীদা। বুঝতাম, খেলাটা তিনি কতটা ভাল বোঝেন।
কয়েক বছর আগে চুনীদা অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। আমি দেখতে গিয়ে অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। অনেক কষ্টের মধ্যে এ রকম ঠাট্টার মেজাজে রয়েছেন চুনীদা!
আসলে চুনীদাকে কখনই মনমরা দেখিনি। মানুষের জীবনে তো নানা পরিস্থিতিই আসে। কিন্তু চুনীদাকে সব সময় প্রাণচঞ্চল দেখেছি। অসম্ভব ভাল রসবোধ ছিল। মাঝেমধ্যে ভাবতাম, চুনীদার মতো মানুষ চলে গেলে, সেই শোক নিতে পারব তো? চাইতাম, এমন দিন যেন কখনও না আসে। আজ সেই দিনটাই এল। কিন্তু, সারা জীবন একটাই কষ্ট তাড়িয়ে বেড়াবে। সেটা হল, তাঁকে শেষ বারের মতো দেখতে না পাওয়াটা। তবে অমর হয়েই থাকবেন চুনীদা।
প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায়
খুবই খারাপ লাগছে। গত মার্চেই দাদার মৃত্যুর পর এই করোনা-আবহেই আরও এক কিংবদন্তির মৃত্যু। ভারতীয় ফুটবলে পিকে-চুনী-বলরাম তো ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বরের মতোই। দাদা এবং চুনীদা চলে গেলেন। একমাত্র রইলেন বলরাম। আমার একটা সৌভাগ্য হল, ছোট থেকেই এঁদের খেলা দেখেছি। দাদার হাত ধরে চলে আসতাম মাঠে। দেখতাম, ফুটবল পায়ে শিল্পের ফুল ফোটাতেন চুনীদা। দেখতাম, কী ভাবে চার-পাঁচ জনকে ড্রিবল করতেন অনায়াসে। দুর্দান্ত পাস বাড়াতেন, গোল করতেন। দেশ-বিদেশে চুনীদার খেলার বহু প্রশংসা শুনেছি।
আমি বরাবরই মোহনবাগানি। তবে আমার আইডল হল দাদা। আর চুনীদা ছিলেন আমার কাছে হিরো। প্রত্যেক রবিবারে আমাদের বাড়িতে আড্ডা বসত। তাতে সপরিবার আসতেন চুনীদা। আসতেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, শ্যামল মিত্র। চুনীদা আমাকে বলতেন, “কি গোপালবাবু, তুমি খেলবে তো?” সেই দিনগুলো এখনও চোখের সামনে জীবন্ত দেখতে পাই।
যখন খেলতাম, তখনও নানা ভাবে পাশে পেয়েছি চুনীদাকে। অনেক পরামর্শ পেয়েছি। খারাপ লাগছে যে, দাদার মতো চুনীদাকেও শেষ দেখা দেখতে পেলেন না ফুটবলপ্রেমীরা। আজ বিকেলে যখন ফোনে খবর পেলাম, বিশ্বাস করতে পারিনি। দাদার পর চুনীদা, কী হচ্ছে?
চুনীদা যে মাপের ফুটবলার ছিলেন, সেটা এখানকার দিনে পুরোপুরি বোঝা মুশকিল। তবে যাঁরা তাঁর খেলা দেখেছেন, বা তাঁর সঙ্গে মিশেছেন, তাঁদের স্মৃতিতে উজ্জ্বল থেকে থাকবেন চুনীদা।
(অভূতপূর্ব পরিস্থিতি। স্বভাবতই আপনি নানান ঘটনার সাক্ষী। শেয়ার করুন আমাদের। ঘটনার বিবরণ, ছবি, ভিডিয়ো আমাদের ইমেলে পাঠিয়ে দিন, feedback@abpdigital.in ঠিকানায়। কোন এলাকা, কোন দিন, কোন সময়ের ঘটনা তা জানাতে ভুলবেন না। আপনার নাম এবং ফোন নম্বর অবশ্যই দেবেন। আপনার পাঠানো খবরটি বিবেচিত হলে তা প্রকাশ করা হবে আমাদের ওয়েবসাইটে।)