বল-বিকৃতিকে আইনসিদ্ধ করা নিয়ে একমত নন রণদেব, ঈশান, শিবশঙ্কর।
করোনাভাইরাসের জেরে ক্রিকেটে বল-বিকৃতিকে আইনসিদ্ধ করার বিষয়ে ভাবনাচিন্তা করছে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট কাউন্সিল। এক ক্রিকেট ওয়েবসাইটে প্রকাশিত রিপোর্ট অনুসারে, আম্পায়ারদের তত্ত্বাবধানে বৈধ কোনও পদার্থ দিয়ে বল পালিশ করাকে মান্যতা দেওয়ার কথা ভাবছে আইসিসি। কিন্তু, এখনও পর্যন্ত এ ভাবে বল পালিশ করা নিষিদ্ধ। বছর দু’য়েক আগে শিরিষ কাগজ দিয়ে বল-বিকৃতির জন্য ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়ার নির্বাসনের মুখে পড়েছিলেন স্টিভ স্মিথ, ডেভিড ওয়ার্নাররা। অথচ, এখন সেই বল-বিকৃতিকেই মেনে নেওয়ার কথা ভাবা হচ্ছে। যদি সত্যিই তা মেনে নেওয়া হয়, তবে তার সুবিধা-অসুবিধা কী, আনন্দবাজার ডিজিটালকে জানালেন প্রাক্তন ও বর্তমান ক্রিকেটাররা।
সম্বরণ বন্দ্যোপাধ্যায়: ক্রিকেটকে চিরকালই বলা হয় ব্যাটসম্যানের খেলা। ডন ব্র্যাডম্যান থেকে বিরাট কোহালি, সবাইকে ধরেই এটা বলা হয়। আমি যদিও তা মানি না। আমার কাছে, ক্রিকেট বোলার-ফিল্ডারদেরও খেলা।
করোনাভাইরাসের পরে থুতু বা ঘাম ব্যবহার করা থেকে বের হতেই হবে। আমি যবে থেকে খেলছি, তবে থেকেই দেখছি যে বোলাররা থুতু বা ঘাম ব্যবহার করে বল তৈরি করে। যাকে বলে ‘বল বানানো’। ৩০ ওভারের পর তিন-চার দিনের ম্যাচে যাতে বল সুইং করে, তার জন্যই একটা দিক পালিশ রাখা হয়। রিভার্স সুইং করার জন্যই এই প্রচেষ্টা। এ বার যদি থুতু বা ঘাম কোনওটাই ব্যবহার না করা যায়, তবে বোলারের হাতে অস্ত্র কিছু রইল না। বল না হবে সুইং, না হবে অন্য কিছু। ৮০ ওভার পর্যন্ত ব্যাটসম্যান আউটই হবে না।
আইসিসি তাই এ ভাবে বোলারদের ম্যাচে ফেরানোর চেষ্টা করছে। লিকুইড কোনও মলম, ভেসলিন বা জেলি ব্যবহার করা যেতে পারে। ১৯৭৩ বা ’৭৫ সালে ইংল্যান্ডের জনি লিভার বলে একটা বোলার ভেসলিন ব্যবহার করত। ব্যাপারটা যদিও বেআইনি ছিল। তবে ও করত। আমি খেলেওছিলাম ওর বিরুদ্ধে। যাই হোক, ব্যাপারটা হল, বোলারকে একটা সুযোগ দিতেই হবে। এটা আইসিসি নিশ্চয়ই ভাবছে। তবে বললেই হল না, এর জন্য প্রস্তুতি দরকার। এতদিন ঘাম-থুতু দিয়ে যা করছিলে, মিড-অন বা মিড-অফ যাতে সাহায্য করছিল, সেটা থেকে হুট করে বেরিয়ে আসা সহজ নয়। ঘরোয়া ক্রিকেটে এটা শুরু করতে হবে। আমার এটাতে পুরো সমর্থন রয়েছে। ক্রিকেট যতই ‘ব্যাটসম্যানস গেম’ হোক, বোলারকে তুমি মেরে ফেলো না। এমনিতেই তো টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের জোয়ারে বোলারদের পরিত্রাহি দশা। তাই, আর মেরো না বোলারকে। খেলাটা ব্যাটসম্যান ও বোলার, দুই পক্ষেরই থাক।
আরও পড়ুন: আইপিএল নেই আরসিবি-র, বিরাটকে কটাক্ষ ওয়ার্নারের
রণদেব বসু: আমি একেবারেই মানতে পারছি না এই ভাবনা। বলে থুতু না লাগাতে দিলেই কি করোনাকে আটকানো যাবে? দুই দলের ক্রিকেটার থেকে শুরু করে আম্পায়াররা, ম্যাচ রেফারি, সাপোর্ট স্টাফরা, বাস-চালক— ম্যাচ আয়োজনের সঙ্গে জড়িত যে কারও যদি করোনা থাকে, তা হলেই তো ঝুঁকি থাকছে। না হলে তো হাতে গ্লাভস আর মুখে মাস্ক পরেই খেলতে নামা যেত! আর আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ক্যামেরা থাকলেও কি সবদিকে লক্ষ্য রাখা সম্ভব? ডিপ ফাইন লেগে দাঁড়ানো ফিল্ডারের যদি হাঁচি পায় আর তার পরই বল ধরে ফেরত পাঠাতে হয়, তখন কী হবে? তা ছাড়া বলে থুতু লাগানো বাদ দিন, ক্যাচ ধরার জন্যও তো হাতে থুতু লাগায় ফিল্ডাররা। অস্ট্রেলিয়ায় স্লিপ কর্ডনে যেমন এর চল খুব। বিরাট কোহালিও এটা করে। এতে বল ধরতে সুবিধা হয়। ক্যামেরা কি সব সময় সেটা ধরে ফেলতে পারবে? যদি পারেও, ঘরোয়া ক্রিকেট, ক্লাব ক্রিকেটে কী ভাবে করোনাকে আটকানো যাবে? সেখানে তো ক্যামেরা নেই। কলকাতা ময়দানে দ্বিতীয় ডিভিশনে খেলা ক্লাবগুলোর ক্রিকেটাররা তো ছোট একটা টেন্টে সবাই গাদাগাদি করে পোশাক বদলায়। বড়জোর একটা বেসিন থাকে ব্যবহারের জন্য। যদি সবাই সেখানে লাইন দিয়ে ভাল ভাবে হাত ধুতেই দাঁড়িয়ে থাকে, তা হলেই তো লাঞ্চের ৪০ মিনিট চলে যাবে।
অন্য একটা দিকও আছে। বল-বিকৃতি করা হয় সুইংয়ের জন্য। আর তা করার অজস্র উপায় বা পদ্ধতি আছে। বলের কন্ডিশনের উপর নির্ভর করে কোন ভাবে তা করা হবে। যদি বল খুব খারাপ অবস্থায় না থাকে, তা হলে এক রকম ভাবে করা হয়। আর বল যদি একেবারেই খারাপ অবস্থায় থাকে, তবে আর এক ভাবে তা করা হয়। আবার কী ধরনের সুইং করাতে চাইছি, সেটাও মাথায় রাখতে হয়। এটা তো অন্তত ১০ ভাবে করা যায়, আইসিসি কোন পদ্ধতিকে আইনসিদ্ধ করবে, সেটা বড় প্রশ্ন।
বল-বিকৃতি কেলেঙ্কারিতে নির্বাসিত হয়েছিলেন অস্ট্রেলিয়ার ব্যানক্রফট। —ফাইল চিত্র।
আমি যখন খেলতাম, তখন প্রথাগত সুইংয়ে জোর দিতাম। ম্যাকো (শিবশঙ্কর পাল) জোর দিত রিভার্স সুইংয়ে। আমরা নিজেদের মধ্যে একটা বোঝাপড়া করে নিতাম বলের পালিশ নিয়ে। এখন যদি বল-বিকৃতি আইনসিদ্ধ করা হয়, তা হলে তো এই দুই ধরনের বোলারের কোনও এক জনকে ভুগতে হবে। সেটা তো উচিত নয়। তা হলে বলা হোক, তুমি বল নিয়ে যা খুশি করতে পারো। তখন আবার ব্যাটসম্যানদের কাজটা কঠিন হবে।
এখন আইসিসি যদি বলে ছয়টা ছয় নয়, বারো, তবে তা মেনে নিতেই হবে। আইসিসি যা করবে, তা মেনে নিতেই হবে। তবে নিয়ম করার আগে দ্বিতীয় ডিভিশনের ক্রিকেটারদের কথাও ভাবতে হবে। সব কিছু ১০০ শতাংশ নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত বা ভ্যাকসিন না বেরনো পর্যন্ত আন্তর্জাতিক ক্রিকেট শুরু করা উচিত নয়। দু’শো বছর ধরে খেলাটা যে ভাবে চলেছে, তাতে পরিবর্তন আনা উচিত নয়। তাতে খেলার মজাটাই চলে যাবে।
শিবশঙ্কর পাল: না, এ ভাবে করোনা আটকানো যায় না। ড্রেসিংরুমে তো সবাই একসঙ্গে বসবে। খাওয়া-দাওয়া একসঙ্গে হবে। তা হলে তো প্রত্যেককে প্যাকেট দিতে হয় খাওয়ার সময়। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে তো আর প্যাকেট লাঞ্চ হতে পারে না। দেখুন, বলে থুতু না লাগালে সবারই অসুবিধা হবে প্রথম প্রথম। তবে সবাই এখন জেলি ব্যবহার করছে। অলিখিত ভাবে সবাই কিছু না কিছু ব্যবহার করে। বলের পালিশ ধরে রাখাকে বলা হয় ‘বল বানানো’। সেটা সব দলই নিজের মতো করে করেই থাকে। এ বার সেটাই যদি আইনসিদ্ধ করা হয়, যদি বলে কেমিক্যাল লাগানোর নিয়ম করে দেয়, তবে আমার মনে হয় বলের পালিশ আরও ভাল হবে। নতুন বলে সুইং তো এমনিতে হয়। এটা হচ্ছে পুরনো বলকে কাজে লাগানোর জন্য। যদি আইসিসি এ ভাবে বলের পালিশ করতে বলে, তবে তা কিন্তু চুরি করতে বলারই সামিল। তখন বল আরও ভাল হবে। আরও সুইং হবে। তখন তো আর আম্পায়ারের পরীক্ষা করার ভয় থাকবে না। কারণ, আম্পায়ারের সামনেই এটা করা হচ্ছে। স্টিভ স্মিথরা যে ধরা পড়ল, এটা হলে সেগুলো অর্থহীন হয়ে পড়বে।
তবে আবার বলছি, একটা প্রশ্ন থাকছেই। যে, এটা করলে কি করোনা আটকানো যাবে? যতই প্রস্তুতি নাও না কেন, ভয় থেকেই যাচ্ছে। না হলে গ্লাভস পরে বল ধরতে হয়। সেটা কি সম্ভব?
আরও পড়ুন: বল-বিকৃতিকে স্বীকৃতি দিতে পারে আইসিসি
ঈশান পোড়েল: আইসিসি যা করবে, সেটাই হবে। ওরাই ক্রিকেট খেলাটার নিয়ন্ত্রক। তাই যা ঠিক করবে, নিশ্চয়ই ভালর কথা ভেবেই করবে। আমরা সাধারণত, থুতু লাগিয়ে পালিশ করে অভ্যস্ত। এখন আবার থুতু লাগানো নিরাপদ নয়। করোনার ভয় থাকছে। তাই আইসিসি যদি নতুন নিয়ম করে, তবে তার সঙ্গে ধাতস্থ হয়ে উঠতে হবে।
আইসিসি কী ব্যবহারের অনুমতি দেবে, তা জানা নেই। ফলে, তা লাগানোর পর আগের সুইং কতটা পাবো, তা জানি না। বল কেমন আচরণ করবে, সেটা একটা ধোঁয়াশা। ব্যবহার না করলে বুঝতে পারব না। তাই একটু অসুবিধা তো হবেই। তবে আইসিসি যা বলবে, সেটাই তো মানতে হবে। নিশ্চয়ই ওরা অনেক কিছু ভেবে-চিন্তে সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। এক জন ক্রিকেটার হিসেবে তাই এটা নিয়ে আমার বলার কিছু থাকতে পারে না।
আর সবচেয়ে বড় কথা হল মানুষ বিভিন্ন রকম পরিস্থিতিতে মানিয়ে নিতে পারে। এই লকডাউন পরিস্থিতিকে যেমন একসময় অসহ্য লাগছিল। এখন কিন্তু তা অনেকটাই সহ্য হয়ে গিয়েছে। একই ভাবে বল-বিকৃতি যদি নিয়মে পরিণত হয়, তবে সেই ভাবে বল করাটাও অভ্যাসে এসে যাবে।
কারসন ঘাউড়ি: বলে থুতু লাগানোর ব্যাপারটা অনেক বছর ধরে হয়ে আসছে। এটাই প্রথায় পরিণত হয়েছে। বলে অন্য কিছু লাগানো এখনও পর্যন্ত অনৈতিক ও অনুচিত। কিন্তু, তা বলে কি বল-বিকৃতি ঘটে না? এটাও ঘটে আসছে অনেক বছর ধরে। নানা ভাবে বলের পালিশ করা হয় দীর্ঘ দিন ধরে। কিন্তু আইসিসির ভাবনাকে সমর্থন করতে পারছি না একেবারেই। ক্রিকেট খেলা উচিত চিরাচরিত ভাবেই। এবং অতি অবশ্যই তা হতে হবে সততার সঙ্গে। ক্রিকেট হল ভদ্রলোকের খেলা। যদিও এখন ক্রিকেটকে আর কোনও ভাবেই ‘জেন্টলম্যানস গেম’ বলা যায় না। কোনও না কোনও ভাবে অধিকাংশ দলই বল-বিকৃতি করে। আমার সাফ কথা, বল-বিকৃতিও ক্যানসার বা করোনার মতোই একটা মারাত্মক রোগ। সেটাকে আটকানোর চেষ্টা করা উচিত। আইনসিদ্ধ করার কথা তো ভাবাই উচিত নয়।