মা মারা গিয়েছিলেন বেশ কিছু বছর আগে। ভাইয়ের বিয়ে ঠিক করার দায়িত্ব পড়েছিল দিদির উপরে। ভাই তাঁর পছন্দসই কোনও পাত্রীর কথা জানাচ্ছেন না দেখে দিদি নিজেই সম্বন্ধ ঠিক করলেন এক পরিচিত পরিবারে। সেই তরুণীর সঙ্গে প্রথম আলাপেই ক্লিন বোল্ড রবীন্দ্র জাডেজা। যিনি ঠিক করেছিলেন বিয়েই করবেন না, রীবা সোলাঙ্কির সঙ্গে আলাপের কয়েক মাসের মধ্যেই সেই জাডেজাকে দেখা গেল ছাদনাতলায়।
মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার রীবার বাবা রাজকোটের প্রথম সারির ব্যবসায়ী। দু’টি স্কুল রয়েছে তাঁর। রীবার মা রেলকর্মী। ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে রবীন্দ্র জাডেজার সঙ্গে প্রথম আলাপ হয় রীবার। তার ২ মাস পরেই এনগেজমেন্ট। রাজকোটে জাডেজার রেস্তরাঁ ‘জাড্ডুস ফুড ফিল্ড’-এ বসেছিল তাঁদের বাগদানের জমকালো আসর।
রাজকোটেরই এক অভিজাত হোটেলে ২০১৬ সালের ১৭ এপ্রিল ২৫ বছরের রীবাকে বিয়ে করেন ২৭ বছর বয়সি জাডেজা। রাজপুত পরিবারের সাবেক রীতি-রেওয়াজ মেনেই বিয়ে করেছিলেন তাঁরা। তাঁদের বিয়ে ঘিরে দেখা দিয়েছিল বিচ্ছন্ন বিতর্কও।
সাতপাকে বাঁধা পড়ার আগে সঙ্গীত, হলদি-র মতো অনুষ্ঠানগুলি দুই পরিবারে ছিল একান্তই ঘরোয়া। ‘সঙ্গীত’ অনুষ্ঠানে তলোয়ার চালানোর ছবি পোস্ট করে সমালোচিত হয়েছিলেন জাড্ডু। তবে অনেক নেটাগরিক মুগ্ধও হয়েছিলেন ক্রিকেটারের তলোয়ারবাজিতে।
শ্বশুরবাড়ির তরফে উপহার পাওয়া মহার্ঘ্য অডি কিউ সেভেন করে বিয়ে করতে গিয়েছিলেন জাডেজা। হোটেলের কিছু দূরে গাড়ি থেকে নেমে বাকি পথ গিয়েছিলেন ঘোড়ায়। বরযাত্রীদের শোভাযাত্রায় বন্দুক থেকে শূন্যে গুলি ছোঁড়া নিয়েও বিতর্ক দেখা দিয়েছিল।
গুলির শব্দে বিভ্রান্ত ঘোড়া কিছুটা অশান্ত হয়ে পড়ে। তবে বরবেশী জাডেজা দ্রুত নিয়ন্ত্রণে আনতে পেরেছিলেন তাঁর বাহনকে। রাজকীয় এই বিয়ের অনুষ্ঠানে অন্যান্য অতিথি অভ্যাগতর সঙ্গে আমন্ত্রিত ছিলেন জাড্ডুর চেন্নাই সুপার কিংস-এর সহযোদ্ধারাও। রঙিন গরবা নাচে অংশ নিয়েছিলেন সুরেশ রায়না এবং ব্রাভো। রাজকোটে বিয়ের পরে জামনগরে জাডেজার পরিবারের তরফে রাজসিক পার্টি আয়োজিত হয়েছিল।
বিয়ে উপলক্ষে জাডেজার পরিবারের সঙ্গে ঝামেলা হয়েছিল ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট সংস্থারও। জাডেজার দিদি নয়নার অভিযোগ ছিল, আমদাবাদের এক নামী সংস্থাকে তাঁরা সম্পূর্ণ বিয়ের অনুষ্ঠানের দায়িত্ব দিয়েছিলেন। সংস্থাকে মোট ১১ লক্ষ টাকা পারিশ্রমিক দেওয়ার কথা ছিল। ৬ লক্ষ টাকা আগাম দেওয়া হয়েছিল।
কিন্তু প্রি-ওয়েডিং অনুষ্ঠান থেকে জাডেজা পরিবারের মনে হয়েছিল সংস্থার পরিষেবা ভাল নয়। এরপর টাকা ফেরত দেওয়া নিয়ে সংস্থার সঙ্গে ভারতীয় স্পিনারের পরিবারের বিবাদ উঠে এসেছিল সংবাদমাধ্যমেও। শেষ পর্যন্ত স্থানীয় এক ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট সংস্থাকে দায়িত্ব দেয় জাড্ডুর পরিবার।
বিতর্ক ধাওয়া করেছিল বিয়ের পরও। গুজরাতের গির অরণ্যে সস্ত্রীক বেড়াতে গিয়েছিলেন জাডেজা। সেখানে গিয়ে তিনি এবং রীবা সেলফি তুলেছিলেন। পিছনে দেখা যাচ্ছিল অভয়ারণ্যের সিংহদের। জঙ্গল সাফারিতে গাড়ি থেকে নেমে নিয়ম ভঙ্গ করার দায়ে অভিযুক্ত হন পর্যটক জাডেজা এবং রীবা।
বিয়ে ঘিরে বিতর্ক থাকলেও জাডেজার দাম্পত্য অবশ্য মসৃণ। তাঁর খেলা দেখতে গ্যালারিতে প্রায়ই দেখা যায় রীবাকে। তবে তিনি নিজেই জানিয়েছেন, বিয়ের আগে ক্রিকেটে কোনও আকর্ষণ ছিল না। মাঠে স্বামীর পারফরম্যান্স দেখতে দেখতে তিনিও ভালবেসে ফেলেছেন ক্রিকেটকে। ২০১৭ সালে জাডেজা ও রীবার সংসারে এসেছে নতুন অতিথি। মেয়ের নাম তাঁরা রেখেছেন ‘নিধ্যানা’।
বিয়ে হওয়ার আগে থেকেই সামাজিক কাজকর্মে যুক্ত ছিলেন রীবা। পরবর্তী সময়ে রাজনীতিতেও যোগ দেন। ‘পদ্মাবত’-এর বিরুদ্ধে নজিরবিহীন ভাবে বিক্ষোভ দেখিয়ে বিতর্কে জড়িয়েছিল করণী সেনা। সে সময়েই করণী সেনায় যোগ দিয়েছিলেন রবীন্দ্র জাদেজার স্ত্রী। তার ৬ মাসের মধ্যে বিজেপিতে যোগ দেন রীবা।
তাঁর রাজনীতিতে যোগদান নিয়ে অনেক দিন ধরেই গুঞ্জন চলছিল। এর আগেও স্বামীর সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে দেখা করেন। তাঁকে পুষ্পস্তবক দিয়ে শুভেচ্ছাও জানিয়ে এসেছিলেন। তখনই অনেকে বলেছিলেন রাজনীতিতে পা রাখতে চলেছেন এই ক্রিকেট তারকার স্ত্রী।
তবে জাডেজার বাড়িতে রাজনৈতিক বিভাজন স্পষ্ট। গত বছর ৩ মার্চ বিজেপি-তে যোগ দেন রীবা। তারপর থেকে বিজেপির সমর্থনে বেশ কয়েকটি মিছিলে দেখা গিয়েছিল তাঁকে। এর ঠিক এক মাস পরে জাডেজার বাবা ও দিদি যোগ দেন কংগ্রেসে।
স্ত্রী বিজেপি, বাবা-বোন কংগ্রেসে। তাহলে অলরাউন্ডারের সমর্থন কোন দলকে? গত বছর এই প্রশ্নটি নিয়ে তুমুল আলোচনা শুরু হয়েছিল সমাজের বিভিন্ন মহলে। সোমবার সকালে টুইট করে সেই জল্পনার অবসান ঘটালেন জাডেজা স্বয়ং। টুইটে বিজেপির পতাকা পোস্ট করে তিনি লেখেন,‘আমি বিজেপিকে সমর্থন করি।’
বিপরীত রাজনৈতিক মতাদর্শ প্রভাব ফেলেনি জাডেজার ব্যক্তিগত সম্পর্কে। বাবা ও দিদির সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক রয়েছে আগের মতোই। দিদি নয়নার প্রভাব জাডেজার জীবনে অনেকটাই।
২০০৫ সালে এক দুর্ঘটনায় মারা যান জাডেজার মা লতা। এর পর মানসিক ভাবে চরম বিধ্বস্ত রায়না প্রায় ঠিকই করেছিলেন তিনি ক্রিকেট ছেড়ে দেবেন। সে সময় ভাইয়ের পাশে ছিলেন নয়না। পারিবারিক সমর্থনে আবার ধীরে ধীরে ক্রিকেটে মন দেন জাডেজা।
জামনগরের গুজরাতি রাজপুত পরিবারের ছেলে জাডেজা ক্রিকেটার হওয়ার স্বপ্ন দেখতেন আশৈশব। তবে তাঁর বাবার ইচ্ছে ছিল ছেলে সেনা অফিসার হবে। বাবার ইচ্ছের বিরুদ্ধে গিয়েই ক্রিকেট অনুশীলন চালিয়ে যান জাডেজা। পরে অবশ্য তাঁর স্বপ্নের শরিক হয়েছিলেন বাবা অনিরুদ্ধ সিংহ জাডেজাও।
বাঁ হাতি স্পিনার জাডেজার দুরন্ত ফিল্ডিংও ভারতীয় দলের অন্যতম সম্পদ। টেস্টে তাঁর অভিষেক ২০১২ সালের ডিসেম্বরে, ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে। প্রথম ওয়ান ডে খেলেছিলেন তারও ৩ বছর আগে। ২০০৯ সালে নিউজিল্যান্ডের বিরুদ্ধে।
এখনও অবধি ৪৯ টেস্টে তাঁর সংগ্রহ ১৮৬৯ রান। সর্বোচ্চ অপরাজিত ১০০। উইকেট পেয়েছেন ২১৩ টি। ১৬৫ টি ওয়ানডেতে জাডেজার মোট রান ২২৯৬। সর্বোচ্চ ৮৭। উইকেট শিকার ১৮৭ টি।
আইপিএল-এ তিনি খেলেছেন রাজস্থান রয়্যালস, কেরল কোচি টাস্কার্স এবং চেন্নাই সুপার কিংসের হয়ে। চলতি আইপিএল-এও ভাল ফর্মে ছিলেন তিনি। ১৪ টি ম্যাচে তাঁর মোট সংগ্রহ ২৩২ রান। সর্বোচ্চ ৫০।
বাইশ গজের তারকা জাডেজা অবশ্য ঘরোয়া ঘেরাটোপে আদ্যন্ত ফ্যামিলিম্যান। কেরিয়ার এবং জীবনের ওঠাপড়ার মুখোমুখি হতে তাঁকে শক্তি যোগায় পারিবারিক বন্ধনই। স্বীকারোক্তি অলরাউন্ডারের।