অভিষেক টেস্টে ব্যাট করেছিলেন ১০ নম্বরে। দেড় বছরের মধ্যে উঠে এসেছিলেন ওপেনারের জায়গায়। ভারতীয় দলে এক থেকে ১০ নম্বর, সব পজিশনে ব্যাট করেছেন তিনি। নিয়মশৃঙ্খলার তুলনায় বরাবর রবিশঙ্কর জয়দ্রথ শাস্ত্রী বেশি পরিচিত হয়েছেন রঙিন এবং বিতর্কিত জীবনের জন্যই।
স্কুলজীবন থেকেই রবি শাস্ত্রী ছিলেন দলের নির্ভরযোগ্য ক্রিকেটার। আন্তঃস্কুল প্রতিযোগিতায় তাঁর দৌলতে বহু বার শিরোপা পেয়েছে তখনকার বম্বের (আজকের মুম্বইয়ের) ডন বস্কো হাই স্কুল। ১৭ বছর ২৯২ দিনে বম্বের রনজি দলে সুযোগ পেয়েছিলেন শাস্ত্রী। অনেক দিন অবধি সর্বকনিষ্ঠ ক্রিকেটার হিসেবে এই রেকর্ড ছিল তাঁর অধীনে।
ক্রিকেট বিশেষজ্ঞদের মতে, শাস্ত্রী ভারতের সর্বকালের সেরা অলরাউন্ডারদের মধ্যে অন্যতম। ব্যাটিং-বোলিংয়ের পাশে তাঁর ক্ষিপ্র ফিল্ডিং ছিল দলের বড় ভরসা। জাতীয় দলের দরজা তাঁর জন্য খুলে যায় ১৯৮১ সালে। সে বছর ফেব্রুয়ারি মাসে নিউজিল্যান্ডের বিরুদ্ধে প্রথম টেস্ট খেলেন তিনি। ওয়ান ডে ম্যাচে আত্মপ্রকাশও সে বছরই। প্রথম প্রতিপক্ষ ছিল দক্ষিণ আফ্রিকা।
কেরিয়ারের শুরুতে তিনি ছিলেন শুধুমাত্র বাঁ হাতি স্পিনার। তার পর ক্রমাগত খেলার ধরন পাল্টে নিজেকে তুলে ধরেন অলরাউন্ডার হিসেবে। তাঁর আস্তিনে লুকিয়ে রাখা বিভিন্ন শটের মধ্যে সবথেকে অভিনব ছিল ‘চাপাটি শট’। তবে স্পিনারদের বিরুদ্ধে মারকুটে শাস্ত্রীই আবার কিছুটা গুটিয়ে যেতেন ফাস্ট বোলারদের মুখোমুখি হয়ে।
হাঁটুতে চোটের জন্য অবসর নিতে বাধ্য হন মাত্র ৩১ বছর বয়সে। এক দশক পেরিয়ে যাওয়া কেরিয়ারে ৮০ টেস্টে তাঁর মোট রান ৩,৮৩০। সর্বোচ্চ ২০৬। ১৫০টি ওয়ান ডে-তে রান করেছেন ৩১০৮। সর্বোচ্চ ১০৯। মোট উইকেট শিকার ১২৯।
অবসরের পরে শাস্ত্রী যেন আরও বেশি ক্রিকেটের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। কার্যত নতুন ইনিংস তৈরি হয় তাঁর জীবনে। ধারাভাষ্যকার হিসেবে দীর্ঘ দিন তাঁকে পেয়েছেন ক্রিকেটপ্রেমীরা। এর পর ধারাভাষ্য থেকে সরে এসে সম্পূর্ণ দায়িত্ব। ২০১৪ সালে তিনি ডিরেক্টর হিসেবে জাতীয় দলের দায়িত্ব পান।
০১৫ সালের ক্রিকেট বিশ্বকাপ অবধি তিনি ছিলেন ডিরেক্টরের দায়িত্বে। ২০১৭ সালের জুলাই মাসে তিনি নিযুক্ত হন জাতীয় দলের প্রধান কোচ হিসেবে। সঞ্জয় বাঙ্গার এবং অনিল কুম্বলের সংক্ষিপ্ত মেয়াদের পরে ২০১৯ সালে শাস্ত্রী আবার নতুন করে এই পদ পান। আপাতত ২০২১ সালের টি-২০ বিশ্বকাপ অবধি তিনি এই দায়িত্বে রয়েছেন।
কোচের দায়িত্বে শাস্ত্রীর আসা-যাওয়ার সঙ্গে জড়িয়ে আছে সাম্প্রতিক বিতর্ক। বিভিন্ন মহলের ধারণা, বোর্ড প্রেসিডেন্ট সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে রবি শাস্ত্রীর শীতল সম্পর্কের সঙ্গে এই বিতর্ক জড়িয়ে আছে।
মনে করা হয়, সৌরভের অপছন্দের কারণেই কোচের পদ থেকে খারিজ হয়ে গিয়েছিলেন রবি শাস্ত্রী। দায়িত্ব পেয়েছিলেন অনিল কুম্বলে। কিন্তু অধিনায়ক বিরাট কোহালির সঙ্গে ঝামেলায় জড়িয়ে পড়েন কুম্বলে। কোহালির বিরাগভাজন হয়ে ইস্তফা দিতে হয় কুম্বলেকে। আবার দায়িত্বে আসেন রবি শাস্ত্রী।
তবে পরে শাস্ত্রী জানিয়েছিলেন, তিনি কোনরকম তিক্ততা মনে রাখতে চান না। তাঁর সাম্প্রতিক টুইটবার্তা অবশ্য সে কথা বলছে না। চলতি বছর অতিমারির আবহে আইপিএল প্রথম থেকেই ছিল অনিশ্চিত। শেষ অবধি মরুশহরে চোখ ধাঁধাঁনো আইপিএল সুসম্পন্ন হয়। এর নেপথ্য কারিগর হিসেবে বিসিসিআই-এর সেক্রেটারি জয় শাহ এবং অন্তর্বর্তীকালীন সিইও হেমাঙ্গ আমিনকে ধন্যবাদ জানান।
কিন্তু এক বারের জন্যেও শাস্ত্রী উল্লেখ করেননি বোর্ড প্রেসিডেন্ট সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের নাম। এই নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় যথেষ্ট ট্রোলডও হয়েছেন জাতীয় দলের কোচ। নেটাগরিকদের একাংশের মত, যাঁকে ছাড়া মসৃণ আইপিএল ছিল কার্যত অসম্ভব, সেই সৌরভের নাম ইচ্ছে করেই উল্লেখ করেননি শাস্ত্রী।
ব্যক্তিগত পরিসেরও বার বার বিতর্ক সঙ্গী হয়েছে তাঁর। আটের দশকে অভিনেত্রী অমৃতা সিংহ এবং রবি শাস্ত্রীর জুটি ছিল গুঞ্জনের শীর্ষে। নিউ ইয়র্কের রেস্তরাঁতেও দু’জনকে দেখা গিয়েছিল নিভৃত মুহূর্তে। শোনা গিয়েছিল, বিয়ে করতে চলেছেন দুই তারকা।
গুঞ্জন আরও তীব্র হয়েছিল বিখ্যাত সিনে পত্রিকার প্রচ্ছদের দু’জনের অন্তরঙ্গ ফোটোশ্যুটে। কিন্তু সব জল্পনা কল্পনার ফানুস চুপসে যায় দ্রুত। ভেঙে যায় তাঁদের প্রেম। এক সাক্ষাৎকারে রবি শাস্ত্রী জানান, তিনি বলিউডের কোনও নায়িকাকে বিয়ে করতে চান না। তাঁর স্ত্রী হবেন গৃহবধূ।
অন্য দিকে কেরিয়ারের শুরুতেই গৃহবধূ হতে রাজি ছিলেন না অমৃতা। বলেছিলেন, আরও বছর দু’য়েক পরে হয়তো অভিনয় ছাড়ার কথা ভাবতে পারেন। কিন্তু সে সময় কেরিয়ার ছাড়ার জন্য তিনি প্রস্তুত ছিলেন না।
রবি শাস্ত্রীর সঙ্গে বিচ্ছেদের পরে ১৯৯১ সালে সইফ আলি খানকে বিয়ে করেন অমৃতা। তাঁদের ১৩ বছরের দাম্পত্য ভেঙে যায় ২০০৪ সালে। অমৃতার বিয়ের আগের বছর সাতপাকে বাঁধা পড়েছিলেন শাস্ত্রীও। বিয়ে করেছিলেন ঋতুকে।
শাস্ত্রীর বিতর্কিত দাম্পত্য বার বার শিরানোমে এসেছে। বেশ কিছু সংবাদ মাধ্যমে এও প্রকাশিত হয়েছে যে রবি এবং তাঁর স্ত্রী ঋতু আলাদা থাকছেন। পরে তাঁদের ডিভোর্স নিয়েও গুঞ্জন শোনা গিয়েছিল।
বিচ্ছেদের কারণ হিসেবে শোনা গিয়েছিল আর এক অভিনেত্রী নিমরত কউরের সঙ্গে রবি শাস্ত্রীর সম্পর্কের কথা। ২০১৮ সালে তাঁদের গোপন প্রেম নিয়ে খবর প্রকাশিত হয়েছিল বেশ কিছু জায়গায়।
রবি শাস্ত্রী সঙ্গে নিমরতের আলাপ হয়েছিল একটি গাড়ির প্রকাশ উপলক্ষে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে। নিমরত পরে শাস্ত্রীর সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের কথা সম্পূর্ণ অস্বীকার করেন। সোশ্যাল মিডিয়ায় এই প্রসঙ্গে তিনি তীব্র অসন্তোষও প্রকাশ করেন।
ডিভোর্সের কথা অস্বীকার করেন শাস্ত্রীও। তাঁর অভিযোগ, সংবাদ মাধ্যমে সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন খবর প্রচার করা হয়েছে।
শাস্ত্রী এ কথাও জানান, তাঁর স্ত্রীও বিরক্ত এই রটনায়। তাঁকেও নানা রকম প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়েছে।