অষ্টম বেতন কমিশনের অনুমোদন দিয়েছে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা। ফলে চওড়া হয়েছে কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মচারীদের মুখের হাসি। বলা বাহুল্য, এ বার বাড়বে তাঁদের বেতন। এর সুবিধা পাবেন পেনশনভোগী অবসরপ্রাপ্ত কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মচারীরাও। কিন্তু অষ্টম বেতন কমিশন চালু হলে তাঁদের সঙ্গে বেসরকারি সংস্থার কর্মীদের বেতনের পার্থক্য কতটা হবে? এই নিয়ে ইতিমধ্যেই শুরু হয়ে গিয়েছে জল্পনা।
বিশ্লেষকদের একাংশের দাবি, অষ্টম বেতন কমিশন চালু হলে চাকরিজীবনের শুরুতেই কেন্দ্রীয় সরকারি পিয়ন, নামী তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থার কর্মীর থেকে বেশি বেতন পাবেন। শুধু তা-ই নয়, কেন্দ্রীয় সরকারি চাকরির ন্যূনতম মূল বেতন (বেসিক পে) ৫০ হাজার টাকা ছাড়িয়ে যেতে পারে।
অষ্টম বেতন কমিশনে কেন্দ্রীয় কর্মচারীরা আর্থিক দিক থেকে কতটা লাভবান হবেন, গত বছরের (পড়ুন ২০২৪) নভেম্বরে তার ইঙ্গিত দেন ন্যাশনাল কাউন্সিল অফ জয়েন্ট কনসালটেটিভ মেশিনারির সচিব শিবগোপাল মিশ্র। এ ব্যাপারে বেতন নির্ধারণের ভিত্তি বা ফিটমেন্ট ফ্যাক্টর বৃদ্ধির কথা বলেছেন তিনি।
সপ্তম বেতন কমিশনের পর কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মচারীদের বেতনের ফিটমেন্ট ফ্যাক্টর ২.৫৭ স্থির করা হয়। মিশ্র জানিয়েছেন, অষ্টম বেতন কমিশনে এটিকে বাড়িয়ে ২.৮৬ করার চিন্তাভাবনা চলছে। তাঁর অনুমান মিলে গেলে সব মিলিয়ে ২৯ বেসিস পয়েন্ট বৃদ্ধি পাবে ফিটমেন্ট ফ্যাক্টর।
বিশেষজ্ঞদের দাবি, সে ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মচারীদের প্রতি মাসের ন্যূনতম মূল বেতন বেড়ে দাঁড়াবে ৫১ হাজার ৪৮০ টাকা। এর সঙ্গে যুক্ত হবে মহার্ঘ ভাতা (ডিয়ারনেস অ্যালাউন্স বা ডিএ) এবং বাড়িভাড়া ভাতা (হাউস রেন্ট অ্যালাউন্স বা এইচআরএ)-সহ আনুষাঙ্গিক আরও কিছু আর্থিক সুযোগ-সুবিধা। ফলে এক জন চতুর্থ শ্রেণির (গ্রুপ ডি) কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মচারির ন্যূনতম বেতন ৬০ হাজার টাকা ছাড়াতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে।
বিশ্লেষকদের অনুমান, অষ্টম বেতন কমিশন কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মচারীদের মূল বেতন ১৮৬ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে। বেতনের পাশাপাশি পাল্লা দিয়ে বাড়বে অবসরপ্রাপ্তদের পেনশনও। বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মচারীদের ন্যূনতম পেনশন ধার্য রয়েছে ন’হাজার টাকা। সেটা বেড়ে ন্যূনতম পেনশন ২৫ হাজার ৭৪০ টাকায় গিয়ে পৌঁছবে বলে মনে করা হচ্ছে।
২০১৬ সালের জানুয়ারি মাসে সপ্তম বেতন কমিশন চালু করে কেন্দ্র। সেখানে সরকারি কর্মচারীদের ন্যূনতম মূল বেতন মাসে ১৮ হাজার টাকা ধার্য করা হয়েছিল। ষষ্ঠ বেতন কমিশনে মাসে সাত হাজার টাকা ছিল কেন্দ্রীয় কর্মচারীদের মূল বেতন।
অন্য দিকে, বর্তমানে ভারতের তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থাগুলিতে চাকরি জীবনের শুরুতে এক জন ইঞ্জিনিয়ার পান ৩০ থেকে ৪০ হাজার টাকা। গত কয়েক বছরে এই টাকার অঙ্কে তেমন কোনও বদল হয়নি। এ আবহে অষ্টম বেতন কমিশন বসার খবর প্রকাশ্যে আসতেই সমাজমাধ্যমে বেতন পার্থক্যকে কেন্দ্র করে জোর চর্চা চলছে।
গত বছরের (পড়ুন ২০২৪) জুলাই মাসে টাটা গোষ্ঠীর বহুজাতিক তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থা টাটা কনসালটেন্সি সার্ভিসেস বা টিসিএসের এক কর্মীর সমাজমাধ্যমে করা একটি পোস্টকে কেন্দ্র করে রীতিমতো হইচই পড়ে গিয়েছিল। এক্স হ্যান্ডলে (সাবেক টুইটার) তিনি লেখেন, ‘‘মাসে ২১ হাজার টাকা বেতন পেতাম আমি। কিন্তু আমার খরচ ছিল ৩০ হাজার টাকা।’’ টিসিএসের ওই কর্মী অবশ্য ২০১৯ সালের পরিস্থিতির কথা লিখেছিলেন।
আর্থিক বিশেষজ্ঞদের কথায়, বেতন কমিশন চালু হওয়ার পর সরকারি ও বেসরকারি কর্মচারীদের আয়ের পার্থক্য এতটা বেড়ে গেলে সামাজিক ভাবে অন্য সমস্যা দেখা দেবে। এতে আগামী দিনে কেন্দ্রীয় সরকারি চাকরির ঝোঁক বৃদ্ধির সম্ভাবনা রয়েছে। পাশাপাশি বেতন পার্থক্য মুদ্রাস্ফীতির হারে প্রভাব ফেলতে পারে।
সরকারি তথ্যে চোখ রাখলে দেখা যাবে, সাম্প্রতিক অতীতে কর্মচারীর সংখ্যা কমিয়েছে কেন্দ্র। ২০১৯-’২০ আর্থিক বছরে ১.১৯ লক্ষ স্থায়ী কর্মচারী নিয়োগ করেছিল সরকার। কিন্তু তার পরের আর্থিক বছরেই (পড়ুন ২০২০-’২১) সেই সংখ্যা কমে দাঁড়ায় ৮৭ হাজার ৪২৩। এই সূচক এখনও নিম্নমুখী রয়েছে। ফলে কেন্দ্রীয় সরকারি চাকরির ঝোঁক বৃদ্ধি পেলে সেখানে প্রবল প্রতিযোগিতার মুখে পড়তে হবে দেশের যুব সমাজকে।
কিছু দিন আগে ভারতীয়দের বার্ষিক গড় আয় সংক্রান্ত তথ্য প্রকাশ করে কেন্দ্রীয় পরিসংখ্যান মন্ত্রক। সেখানে বলা হয়েছে, এ দেশের নাগরিকেরা বছরে গড়ে ১.৮ লক্ষ টাকা করে আয় করেন। তাঁদের মাসিক গড় বেতন ১৫ হাজার থেকে ২০ হাজার টাকার মধ্যে ঘোরাফেরা করে। আর্থিক দিক থেকে উন্নত দেশগুলির তুলনায় এই পরিমাণ অনেকটাই কম।
অষ্টম বেতন কমিশন চালু হওয়ার পর কেন্দ্রীয় সরকারি এবং বেসরকারি কর্মচারীদের মধ্যে বেতনের ফারাক অনেকটা হলে, তার সরাসরি প্রভাব পড়বে ঘরোয়া বাজারে। সে ক্ষেত্রে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দামে হেরফের দেখা যেতে পারে। পাশাপাশি বেশি বেতনের আশায় বিদেশে গিয়ে চাকরির প্রবণতা বাড়তে পারে। ফলে ‘মস্তিষ্কের নির্গমন’ (ব্রেন ড্রেন) সমস্যার মুখে পড়তে পারে ভারত, বলছেন বিশেষজ্ঞেরা।
এই পরিস্থিতিতে বেসরকারি সংস্থার কর্মীদের আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্য দিতে আয়করে আরও বেশি করে ছাড় দেওয়ার দাবি উঠেছে। চলতি বছরের (পড়ুন ২০২৫) ফেব্রুয়ারিতে সংসদে বাজেট পেশ করবেন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারমন। সেখানে তিনি আয়করের ঊর্ধ্বসীমা বৃদ্ধি করতে পারেন বলে মনে করা হচ্ছে।
সূত্রের খবর, কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মচারীদের পেনশন, অবসরকালীন সুযোগ-সুবিধা, প্রভিডেন্ট ফান্ড এবং গ্র্যাচুইটির নিয়মে কিছু বদলের সুপারিশ করবে অষ্টম বেতন কমিশন। পাশাপাশি, কাজের দক্ষতার উপর ভিত্তি করে বেতনবৃদ্ধির বিষয়টি নিয়ে কমিশনের সদস্যেরা আলোচনা করতে পারেন। যদিও সরকারি ভাবে এই নিয়ে কোনও প্রতিক্রিয়া মেলেনি।
কেন্দ্রীয় মন্ত্রী অশ্বিনী বৈষ্ণব জানিয়েছেন, অষ্টম বেতন কমিশনের চেয়ারম্যান এবং দু’জন সদস্যের নাম খুব দ্রুত ঘোষণা করা হবে। যদিও কবে এই কমিশন গঠিত হবে, সে বিষয়ে এখনও পর্যন্ত কিছু জানানো হয়নি।
কেন্দ্র জানিয়েছে, কর্মচারীদের বেতনবৃদ্ধির ব্যাপারে বিভিন্ন রাজ্য সরকার এবং অন্য সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলির সঙ্গেও আলোচনা করবেন অষ্টম বেতন কমিশনের সদস্যেরা। কারণ কেন্দ্রীয় কর্মচারীদের একাংশকে রাজ্য সরকারের হয়ে কাজ করতে হয়।
আগামী বছর (পড়ুন ২০২৬ সাল) শেষ হবে সপ্তম বেতন কমিশনের মেয়াদ। কেন্দ্রীয় মন্ত্রী অশ্বিনী জানিয়েছেন, অষ্টম বেতন কমিশন যাতে সময়ের মধ্যে সুপারিশ করতে পারে এবং ২০২৬ সাল থেকে তা কার্যকর করা যায়, সেই লক্ষ্যে অনুমোদন দেওয়া হয়েছে।