প্রজাতন্ত্র দিবসের আগে ভারতীয় নৌসেনাকে বড় উপহার দিল নরেন্দ্র মোদী সরকার। জলযোদ্ধাদের হাতে তিনটে রণতরী তুলে দিলেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী। তার মধ্যে একটি আবার ডুবোজাহাজ। অন্য দিকে, সেনাদিবসের কুচকাওয়াজে ‘রোবট কুকুর’ নামিয়ে গোটা দুনিয়াকে চমকে দিয়েছে ভারতের স্থলবাহিনী। এ হেন অত্যাধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার বাহিনীর শক্তিকে যে কয়েক গুণ বাড়িয়ে দিতে সাহায্য করবে, তা বলাই বাহুল্য।
প্রতি বছর ১৫ জানুয়ারি দিল্লির রাজপথে সেনাদিবসের কুচকাওয়াজের আয়োজন করে স্থলবাহিনী। কিন্তু, এ বার পুণেয় সেই অনুষ্ঠান রেখেছিল ভারতীয় সেনা। সেখানে সকলের নজর কাড়ে ‘রোবট কুকুর’। লাদাখ থেকে অরুণাচল বা জম্মু-কাশ্মীরের উঁচু পাহাড়ি এলাকায় সেগুলিকে ব্যবহার করা হচ্ছে বলে জানিয়েছে ফৌজ।
সেনার ব্যবহার করা রোবট কুকুরের পোশাকি নাম ‘মাল্টি ইউটিলিটি লেগ্ড ইকুইপমেন্ট’ (মিউল)। সম্পূর্ণ দেশীয় প্রযুক্তিতে এগুলিকে তৈরি করেছে এরোএআরসি প্রাইভেট লিমিটেড নামের দিল্লির একটি বেসরকারি সংস্থা। একাধিক কাজে এগুলির ব্যবহার শুরু করেছে বাহিনী।
সেনা সূত্রে খবর, এক একটি মিউলের ওজন ৫১ কেজি। এগুলি সর্বোচ্চ তিন মিটার/সেকেন্ড বেগে ছুটতে পারে। রিমোট কন্ট্রোলের সাহায্যে এগুলিকে নিয়ন্ত্রণ করে ফৌজ। আবার নিজের থেকে সিদ্ধান্ত নিয়ে কিছু কাজ করার ক্ষমতাও রয়েছে এগুলির। একাধিক সেন্সর, গতিশীল পা, উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন কম্পিউটার এবং ব্যাটারির সাহায্যে তৈরি করা হয়েছে এই রোবট কুকুরদের।
সেনা অফিসারেরা জানিয়েছেন, মূলত নিরাপত্তা, সম্পদের সুরক্ষা, বিপজ্জনক উপকরণ পরিচালনা, বোমা নিষ্ক্রিয় এবং গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহের জন্য এই মিউলগুলি ব্যবহার করা হচ্ছে। এরা ১২ কিলো পর্যন্ত ওজন বহনে সক্ষম। ফলে দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় রসদ এবং গোলাবারুদ পৌঁছে দিতেও এগুলিকে কাজে লাগানো হচ্ছে। আগে এই কাজে ঘোড়া বা খচ্চর ব্যবহার করত ফৌজ।
সূত্রের খবর, পিঠে মাল নিয়ে খাড়াই পাহাড় বেয়ে দিব্যি উপরে উঠতে পারে ‘রোবট কুকুর’। একটি মিউলকে কাজের জন্য তৈরি করতে সৈনিকদের সময় লাগছে মাত্র ১৫ মিনিট। এক বার চার্জ দিলে এগুলির ব্যাটারি ২০ ঘণ্টা পর্যন্ত কাজ করতে পারে। শুধু তা-ই নয়, হিমাঙ্কের নীচে ৪০ ডিগ্রি থেকে শুরু করে মরুভূমির ৫৫ ডিগ্রি তাপমাত্রায় কাজ করতে সক্ষম দিল্লির সংস্থার তৈরি ওই যন্ত্র-সারমেয়।
২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে জরুরি ভিত্তিতে ১০০টি ‘রোবট কুকুর’ কেনে ভারতীয় সেনা। এর জন্য ৩০০ কোটি টাকা খরচ করেছে প্রতিরক্ষা মন্ত্রক। যন্ত্র-সারমেয়তে রয়েছে থার্মাল ক্যামেরা। আগ্নেয়াস্ত্র জুড়ে এগুলিকে যুদ্ধের সময়ে বা জঙ্গি দমন অভিযানেও ব্যবহার করতে পারবে স্থলবাহিনী।
কুচকাওয়াজ শেষে এক সেনা অফিসার জানান, কমপক্ষে ১০০ কিলোমিটার দূরে বসে যন্ত্র-সারমেয়কে নিয়ন্ত্রণ করা যাবে। শত্রুপক্ষের ছোট আকারের বাঙ্কার ওড়াতেও এটি সক্ষম। ভবিষ্যতে এই ধরনের রোবটিক যান আরও বেশি করে ফৌজে শামিল হবে বলে ইঙ্গিত দিয়েছেন তিনি। সেগুলিতে কৃত্রিম মেধা (আর্টিফিশিয়াল ইনটেলিজেন্স বা এআই) প্রযুক্তি ব্যবহারের দিকে জোর দেওয়া হচ্ছে।
অন্য দিকে চলতি বছরের (পড়ুন ২০২৫) ১৫ জানুয়ারি নৌসেনার অস্ত্রাগারে একসঙ্গে শামিল হয়েছে তিনটি যুদ্ধজাহাজ। তালিকায় একটি ডুবোজাহাজ ছাড়াও রয়েছে ডেস্ট্রয়ার এবং ফ্রিগেট শ্রেণির রণতরী। এগুলির নাম আইএনএস নীলগিরি, আইএনএস সুরত এবং আইএনএস ভাগশির।
আইএনএস নীলগিরির কম্যান্ডিং অফিসার ক্যাপ্টেন নিতিন কপূর জানিয়েছেন, এটি প্রকৃতপক্ষে একটি স্টেলথ ফ্রিগেট। ভারতীয় নৌবাহিনীতে শিবালিক শ্রেণির একাধিক রণতরী রয়েছে। সদ্য বাহিনীতে যোগ দেওয়া যুদ্ধজাহাজটি তার মধ্যে অন্যতম। এটির নির্মাণখরচ চার হাজার কোটি টাকা বলে জানা গিয়েছে।
ক্যাপ্টেন কপূরের কথায়, ‘‘আইএনএস নীলগিরিতে রয়েছে ‘মুরিং ডেক’। সেখানে নোঙরের মতো প্রচলিত উপাদানগুলিকে লুকিয়ে রাখার সুবন্দোবস্ত রয়েছে। রণতরীটিকে এমন ভাবে তৈরি করা হয়েছে, যার জেরে সহজে একে চিহ্নিত করতে পারবে না কোনও রাডার।’’ মুম্বইয়ের মাজ়গাঁও ডক লিমিটেড যুদ্ধজাহাজটির নির্মাণকারী সংস্থা। এর নকশা তৈরির নেপথ্যে রয়েছে ভারতীয় নৌসেনার ওয়ারশিপ ডিজ়াইন ব্যুরোর হাত।
প্রতিরক্ষা মন্ত্রক জানিয়েছে, নৌবাহিনীকে সরবরাহ করা হবে নীলগিরির মতো মোট সাতটি ফ্রিগেট। ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় সক্ষম এই রণতরীগুলি নির্মাণে ‘প্রজেক্ট ১৭এ’ শুরু করেছে কেন্দ্র। সব ক’টি যুদ্ধজাহাজই সম্পূর্ণ দেশীয় প্রযুক্তিতে তৈরি করবে মোদী সরকার। এর মধ্যে প্রথমটি হাতে পেলেন ভারতের জলযোদ্ধারা।
তালিকায় দ্বিতীয় নাম রয়েছে আইএনএস সুরতের। আট হাজার টন ওজনের এই ক্ষেপণাস্ত্র বহণকারী ডেস্ট্রয়ার রণতরীটির নির্মাণকারী সংস্থাও মুম্বইয়ের মাজ়গাঁও ডক লিমিটেড। ভারতীয় নৌবাহিনীর বিশাখাপত্তনম শ্রেণির যুদ্ধজাহাজগুলির মধ্যে এটি সর্বশেষ বলে জানা গিয়েছে। প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের ‘প্রজেক্ট ১৫-বি’র আওতায় এর নির্মাণকাজ সম্পন্ন হয়েছে বলে জানিয়েছেন সমুদ্র প্রহরীরা।
আইএনএস সুরতে রয়েছে ভূমি থেকে ভূমি ‘ব্রহ্মস’ সুপারসনিক ক্রুজ় ক্ষেপণাস্ত্র, মাঝারি পাল্লার ‘বারাক-৪’ ভূমি থেকে আকাশ ক্ষেপণাস্ত্র এবং একাধিক ক্যালিবারের কামান। এতে রাশিয়া, ইজ়রায়েল এবং ইউক্রেনীয় যুদ্ধজাহাজের প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (আর্টিফিশিয়াল ইনটেলিজেন্স বা এআই) প্রযুক্তিতে সমৃদ্ধ প্রথম রণতরী হল আইএনএস সুরত। এটির নির্মাণে ৮,৯৫০ কোটি টাকা খরচ করেছে কেন্দ্র।
এ ছাড়া ডিজ়েল-ইলেকট্রিক চালিত হামলাকারী ডুবোজাহাজ আইএনএস ভাগশিরকেও হাতে পেয়েছে ভারতীয় নৌসেনা। কালভেরি ও স্করপিয়ন শ্রেণির এই ডুবোজাহাজের নকশা তৈরি করেছে ফরাসি সংস্থা নেভাল গ্রুপ। সম্পূর্ণ দেশীয় প্রযুক্তিটিতে এটি তৈরি করেছে মুম্বইয়ের মাজ়গাঁও ডক লিমিটেড। ডুবোজাহাজটির কোডনেম ‘এস-২৬’।
আইএনএস ভাগশিরের রণসাজে রয়েছে ১৮টি টর্পেডো। এ ছাড়া জাহাজ বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র, বেলাভূমিতে আক্রমণের ক্ষেপণাস্ত্র এবং ওয়াটার মাইনের মতো হাতিয়ার রয়েছে এই ডুবোজাহাজে। নিঃশব্দে গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহেও ভাগশিরকে কাজে লাগানো যাবে বলে জানিয়েছে ভারতীয় নৌসেনা।
অত্যাধুনিক ডুবোজাহাজটিকে স্টেলথ ক্ষমতাসম্পন্ন ভাবে তৈরি করা হয়েছে। অর্থাৎ, এক বার সমুদ্রে ডুব দিলে একে খুঁজে পাওয়া এক রকম অসম্ভব। এর জন্য এতে ‘অ্যাকুস্টিক অ্যাবজর্বশন প্রযুক্তি’ এবং ‘এয়ার ইন্ডিপেন্ডেন্ট প্রপালশান সিস্টেম’ ব্যবহার করা হয়েছে। আনুমানিক ৩,৯৪২ কোটি টাকা ব্যয়ে এই ডুবোজাহাজটি নির্মাণ করেছে কেন্দ্র।
প্রসঙ্গত, গত ১০ বছরে ভারতীয় নৌবাহিনীতে সামিল হয়েছে মোট ৩৩টি নতুন রণতরী। অন্য দিকে এই সময়ের মধ্যে চিনের পিপল্স লিবারেশন আর্মির (পিএলএ) নৌসেনা পেয়েছে ১৪৮টি যুদ্ধজাহাজ। ফলে ভারত মহাসাগর এবং ইন্দো-প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকায় শক্তি বাড়াতে ক্রমাগত জলযোদ্ধাদের বহর বৃদ্ধির দিকে নজর দিয়েছে নয়াদিল্লি।
এ প্রসঙ্গে ভারতীয় নৌসেনা প্রধান অ্যাডমিরাল দীনেশ কে ত্রিপাঠী জানিয়েছেন, নতুন যুদ্ধজাহাজগুলি বাহিনীর শক্তি বৃদ্ধিতে যথেষ্ট সহায়ক হবে। বর্তমানে ৬২টি রণতরী এবং একটি ডুবোজাহাজের নির্মাণকাজ চলছে বলে স্পষ্ট করেছেন তিনি।