দ্রাবিড় এবং পেন্ধরকর। দুই পরিবারের সখ্য বহু দিনের। পরিবারের কর্তা উইং কম্যান্ডার এস পি পেন্ধরকরের কর্মোপলক্ষে তাঁর পরিবার ১৯৬৮ থেকে ১৯৭১ অবধি ছিল বেঙ্গালুরুতে। সেখানেই দুই পরিবারের মধ্যে বন্ধুত্ব শুরু।
পরে পেন্ধরকর পরিবার চলে যায় নাগপুরে। সেখানেই সময় পেলেই পৌঁছে যেতেন দ্রাবিড় পরিবারের বড় ছেলে রাহুলও। উদ্দেশ্য ছিল, বিজেতা পেন্ধরকরের সঙ্গে দেখা করা। সে কথা বিজেতা নিজে স্বীকার না করলেও বন্ধুরা ঠাট্টা করতে ছাড়ত না।
বন্ধুদের পরে টের পেলেন অভিভাবকরাও। বুঝতে পারলেন যে রাহুল এবং বিজেতা একে অন্যকে পছন্দ করছেন। এর পর বিয়ের সম্বন্ধ ঠিক করতে দেরি করেননি তাঁরা।
২০০২ সালেই সাতপাকে বাঁধা পড়তেন রাহুল দ্রাবিড় এবং বিজেতা পেন্ধরকর। কিন্তু বাধ সাধল বিশ্বকাপের সূচি। ২০০৩ বিশ্বকাপের জন্য দ্রাবিড় সে সময় প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। বিজেতারও ডাক্তারির পোস্ট গ্র্যাজুয়েশন পরীক্ষা ছিল সামনেই।
ফলে বাগদান হল কিন্তু বিয়ে পিছিয়ে গেল পরের বছর। শোনা যায়, বিশ্বকাপে হবু স্বামীর খেলা দেখতে বিজেতা পাড়ি দিয়েছিলেন দক্ষিণ আফ্রিকাতেও। কিন্তু তাঁদের সম্পর্কের কথা প্রকাশ্যে আসেনি।
২০০৩ সালের ৪ মে খাঁটি মরাঠি রীতিনীতি মেনে রাহুল-বিজেতার বিয়ে হয় বেঙ্গালুরুর শহরতলিতে। সকাল সাড়ে ৯টা থেকে দুপুর ৩টে পর্যন্ত বিয়ের অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন ঘনিষ্ঠ আত্মীয়স্বজনই।
পরে শহরের পাঁচতারা হোটেলে রাজকীয় পার্টির আয়োজন করা হয়েছিল। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা অতিথিদের জন্য হোটেলের ৭০টি ঘর বুক করেছিল দুই পরিবার। ক্রিকেটারদের মধ্যে হাজির ছিলেন অনিল কুম্বলে এবং ভেঙ্কটেশ প্রসাদ।
রাহুল ও বিজেতা দ্রাবিড়ের বিয়ের অনুষ্ঠান ছিল শুধুমাত্র আমন্ত্রিত অতিথিদের জন্যই। বিয়ে নিয়ে সংবাদ মাধ্যমে খুব বেশি প্রচার হোক, চায়নি দুই পরিবারই।
রাহুল দ্রাবিড়ের পরিবার আদতে মরাঠি। রাহুলের জন্ম অবশ্য মধ্যপ্রদেশের ইনদওরে। পরে তাঁর বাবার কর্মসূত্রে পরিবার চলে যায় বেঙ্গালুরুতে। বিখ্যাত জ্যাম জেলির প্রস্তুতকারী সংস্থায় কাজ করতেন রাহুলের বাবা শরদ যাদব। তাই সহযোদ্ধাদের কাছে রাহুল ছিলেন ‘জ্যামি’।
কেরিয়ার এবং ব্যক্তিগত জীবন, দু’টি দিকেই রাহুল প্রচারবিমুখ। স্ত্রী বিজেতাও অযথা প্রচারের আলোয় আসতে পছন্দ করেন না। দু’জনেই তাঁদের পরিবারে তারকাসুলভ গ্ল্যামারের তুলনায় মধ্যবিত্ত মূল্যবোধকেই বেশি গুরুত্ব দিয়ে এসেছেন।
২০০৫ সালে জন্ম হয় রাহুল এবং বিজেতার প্রথম সন্তান সমিতের। ৪ বছর পরে দ্রাবিড় পরিবারে আগমন আরও এক নতুন অতিথির। জন্ম হয় সমিতের ভাই অন্বয়ের। দুই ভাইয়ের মধ্যে সমিত ক্রিকেট খেলছেন বাবার মতো।
সার্জেন বিজেতার অবশ্য কোনও দিনই ক্রিকেটে কোনও আগ্রহ ছিল না। এর ফলে তাঁদের সম্পর্ক অনেক বেশি সহজ হয়েছে। দাবি, রাহুলের। কারণ তাঁদের একান্ত পরিসর থেকে ক্রিকেট দূরেই থাকে।
বিজেতার মতো রাহুলও পড়াশোনায় মেধাবী ছিলেন। সেন্ট জোসেফ বয়েজ হাই স্কুল এবং সেন্ট জোসেফস কলেজ অব কমার্সের প্রাক্তন ছাত্র রাহুল বাণিজ্যে স্নাতক। লেখাপড়ার পাশাপাশি ১২ বছর বয়স থেকে সমানতালে চালিয়ে গিয়েছেন ক্রিকেটও।
১৯৯৬ সালে ইংল্যান্ড সফরে যখন টেস্ট দলে প্রথম সুযোগ পান, সে সময় রাহুল এমবিএ করছিলেন। কিন্তু জাতীয় দলে ডাক পাওয়ার পরে বেছে নেন ক্রিকেটকেই। সে বছরই শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে ওয়ান ডে দলেও তাঁর অভিষেক ঘটে।
দীর্ঘ কেরিয়ারে ১৬৪ টেস্টে রাহুলের মোট সংগ্রহ ১৩,২৮৮ রান। সর্বোচ্চ ২৭০। উইকেট পেয়েছেন ১টি। ৩৪৪ ওয়ানডেতে মোট রান ১০, ৮৮৯। সর্বোচ্চ ১৫৩।
ওঠানামা এবং টানাপড়েন পেরিয়ে জাতীয় দলে চিরকাল সুরক্ষার দুর্ভেদ্য প্রাচীর হয়ে থেকেছেন রাহুল দ্রাবিড়। তাঁর নামই হয়ে গিয়েছিল ‘দ্য ওয়াল’। আর তাঁর মানসিক শক্তিকে অন্য সব আঘাত থেকে বাঁচিয়ে রেখেছেন, অর্ধাঙ্গিনী বিজেতা।
অবসরের পরে প্রাক্তন ভারত অধিনায়ক বেছে নিয়েছেন তরুণ প্রজন্মকে তৈরি করার দায়িত্ব। ভারত এ দল এবং অনূর্ধ্ব ১৯ দলের দেখভালের দায়িত্ব এখন তাঁর উপরেই। এর আগে ২০১৬ থেকে ২০১৯ তিনি এই দু’টি দলের প্রধান প্রশিক্ষকের দায়িত্বেও ছিলেন।
তাঁর প্রশিক্ষণেই ২০১৮ সালে অনূর্ধ্ব ১৯ ক্রিকেট বিশ্বকাপে ভারত জয়ী হয়। বিশ্বের সর্বকালের সেরা ব্যাটসম্যানদের তালিকায় থাকা মিস্টার ডিপেন্ডেবল এখন নিজের হাতে তৈরি করছেন দেশের উত্তর প্রজন্মের ক্রিকেটারদের।
ক্রিকেট ছাড়া রাহুল দ্রাবিড়ের জীবন আবর্তিত হয় তাঁর পরিবার ঘিরে। সঙ্গে থাকে প্রিয় বন্ধু বই। প্রচারের আলো থেকে দূরে নিজের ভাল লাগার মধ্যে ডুবে আছেন টিম ইন্ডিয়ার অতীতের ‘মিস্টার ডিপেন্ডেবল’।