—প্রতীকী চিত্র।
চকোলেট খেয়ে তার মোড়কটা প্লাস্টিকে মুড়ে টেবিলে রেখে বাড়ি থেকে বেরিয়েছিল ১৪ বছরের কিশোর। তাড়াহুড়োয় ফেলা হয়নি তার। সেই চকোলেটের মোড়ক আর প্লাস্টিকটা এখনও ফেলা হয়নি। সে ভাবেই পড়ে রয়েছে টেবিলে।
এমন অনেক কিছুই বাড়ির এ দিকে-সে দিকে ছড়িয়ে রয়েছে। যেমন ছিল, তেমনই আছে। দু’বছর ধরে হাত দেয়নি কেউ। পূষন সাধুখাঁর সব কিছু রয়েছে একই ভাবে। বইখাতা, জামা, খেলার জিনিস— আর যা যা থাকে একটা ১৪ বছরের ছেলের। আছে, সব আছে। না থেকেও পূষনও আছে ওর বাবা-মার সঙ্গে। আছে আরও দুই একরত্তি। মাস চারেক আগে আইভিএফ পদ্ধতিতে যমজ সন্তান হয়েছে পূষনের বাবা-মায়ের। একটি পুত্র, একটি কন্যা।
জীবন বড্ড কঠিন। বাস্তব। নিষ্ঠুর। থামার আগে থামতে চায় না। সেকেন্ড, মিনিট, ঘণ্টা, দিন, মাস, বছরের হিসাব বেড়েই চলে। পূষনকে কি মনে রয়েছে কলকাতার? সাউথ পয়েন্ট স্কুলের ছাত্র এবং তার পরিবারের জীবন লন্ডভন্ড করে দিয়েছিল এক কালবৈশাখী ঝড়। কাল-ই বটে। পূষন এবং সৌরদীপ চট্টোপাধ্যায় একটি রোয়িং প্রতিযোগিতায় আরও পাঁচ সহপাঠীর সঙ্গে নেমেছিল রবীন্দ্র সরোবরের জলে। ৯০ কিলোমিটার প্রতি ঘণ্টার দমকা হাওয়ায় উল্টে গিয়েছিল ওদের বোট। তিন জন সাঁতরে পারে চলে এসেছিল। পূষন আর সৌরদীপের নিথর দেহ মিলেছিল সাড়ে তিন ঘণ্টা পর।
২০২২ সালের ২১ মের সেই দুর্ঘটনার পর বড় পরিবর্তন হয়ে গিয়েছে সাধুখাঁ এবং চট্টোপাধ্যায়দের জীবনে। দিন শেষে দুই ছেলে আর ঘরে ফেরে না। জীবনের কঠিনতম সময়ে সাধুখাঁ পরিবারের বন্ধু হয়ে উঠেছে চট্টোপাধ্যায় পরিবার। সন্তানহীন সাধুখাঁ দম্পতিকে নতুন করে ভাবার পরামর্শ দিয়েছিলেন সৌরদীপের বাবা সৌভিক চট্টোপাধ্যায়। তিনি বলেছেন, ‘‘আমরা দুই ছেলের এক জনকে হারিয়েছি। কিন্তু ওঁরা একমাত্র সন্তানকে হারিয়েছেন। তাই সন্তান নেওয়ার কথা বলেছিলাম আমরা। জীবনে কিছু একটা প্রয়োজন বাঁচার জন্য।’’
নতুন করে বাঁচার চেষ্টা করছে সাধুখাঁ পরিবার। যমজ সন্তানেরা যদি না-দেখা দাদার মতো রোয়িং করতে চায়, অনুমতি দেবেন? পীযূষবাবু কিছুটা চুপ থেকে বললেন, ‘‘এখনই বলা সম্ভব নয়। মন সায় দেবে না নিশ্চিত। উৎসাহ দেওয়াও সম্ভব হবে না। ওদের ইচ্ছাকে হয়তো গুরুত্ব দেব। জানি না তখন কী করব। এ সব নিয়ে এখন ভাবছি না আমরা।’’
পীযূষবাবু এবং তাঁর স্ত্রী এখন জীবনকে নতুন ভাবে সাজানোর চেষ্টা করছেন। পীযূষবাবু নিজের মোবাইল ফোন দেখিয়ে বললেন, ‘‘এই দেখুন এখনও আমার ফোনের ওয়ালপেপারে ছেলের সঙ্গে আমাদের ছবি। ওর সব কিছু আগলে রেখেছি আমরা। আমার এবং স্ত্রীর যৌথ সিদ্ধান্ত এটা। আমার ‘সার্ভিস বুক’-এ যমজ সন্তানদের নাম যোগ করেছি। কিন্তু পূষনের নামও রেখে দিয়েছি। ওর একটা ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট করে দিয়েছিলাম। সেটাও আছে। ওর কোনও কিছুই নষ্ট করিনি আমরা। মুছেও ফেলিনি। একই রকম ভাবে আমাদের ছেলে সঙ্গে আছে। আমরা মনে করি, আমাদের ছেলেই আবার ফিরে এসেছে।’’
সরোবরের দুর্ঘটনার তদন্ত শুরু করেছিল কলকাতা পুলিশের হোমিসাইড শাখা। দু’বছর পর তদন্তের ফল কী? পীযূষবাবু কলকাতা পুলিশের পদস্থ কর্মী হয়েও জানেন না। তাঁর বক্তব্য, ‘‘চাইলে বিষয়টা নিয়ে আরও কিছু দূর যেতে পারতাম। আমরা আসলে চাইনি। ওই বিষয়টা নিয়ে নাড়াচাড়া করতে চাই না। তা হলেই বার বার যন্ত্রণাটা টাটকা হয়ে যায়। জীবনের ওই অধ্যায়টা আমরা সম্পূর্ণ ভুলে থাকতে চাই। ওই দিনটা জীবনে কখনও এসেছিল, মনে রাখতে চাই না।’’
তবে চেষ্টা করেছিলেন সৌরদীপের বাবা। নানা রকম বাধা কাটিয়ে এফআইআর করেছিলেন। কত দূর এগোল তদন্ত? সৌভিকবাবুর বক্তব্য, ‘‘মাস চারেক আগে শেষ বার কথা হয়েছিল তদন্তকারী অফিসারের সঙ্গে। ক্লাব এবং স্কুল কর্তৃপক্ষের যা যা গাফিলতি ছিল, প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা ব্যবস্থার যেগুলো ছিল না, সব লিখিত ভাবে জানিয়েছিলাম তদন্তকারী অফিসারকে। জানিয়েছিলাম সংশ্লিষ্ট সব জায়গায়। কিন্তু কোনও এক অজ্ঞাত কারণে তদন্ত এগোচ্ছে না। হয়তো বড় কোনও হাত রয়েছে। দুটো বাচ্চার জীবন চলে গেল। অথচ দু’বছরেও চার্জশিট হল না! আর কী বলব।’’ সৌভিকবাবুর হোয়াট্সঅ্যাপের প্রোফাইল পিকচারেও উজ্জ্বল সৌরদীপ। তাঁদের জীবনে নতুন কিছু নেই।
ছোট্ট দুই সন্তানের সঙ্গে পূষনকে নিয়েই বাঁচছেন পীযূষবাবু এবং তাঁর স্ত্রী। নতুন আশা তৈরি হলেও তাঁরা আগলে রেখেছেন সবটা। পূষনের ফেলে যাওয়া চকোলেটের মোড়কটাও।