Death

প্রদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় (১৯৩৬-২০২০)

ছেলের স্বপ্ন আর সংসারের আর্থিক অনটনের মধ্যে কোনটাকে বেছে নিতে হবে,  ত নিয়ে সে দিন দ্বিধায় ভোগেননি প্রভাতবাবু।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২১ মার্চ ২০২০ ০৩:৪৫
Share:

উইং ধরে বিদ্যুৎগতিতে উঠে গিয়ে ত্রাস সৃষ্টি করতেন প্রতিপক্ষ রক্ষণে। বজ্রপাতের মতো বিপক্ষ গোলে আছড়ে পড়ত শট। পরবর্তীকালে টাচলাইনে দাঁড়িয়েই আবার ছাত্রদের চাঙ্গা করেছেন বিখ্যাত ‘ভোকাল টনিক’ দিয়ে। বাংলা তথা ভারতীয় ফুটবলের এমন আশ্চর্য প্রদীপ নিভে গেল শুক্রবার।

Advertisement

১৯৩৬-এর ২৩ জুন জলপাইগুড়িতে জন্ম। সন্তোষ ট্রফি প্রথম খেলেন বিহারের হয়ে। সেই প্রতিযোগিতা হয়েছিল কলকাতাতেই। প্রদীপ কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের সেই ছিল আগমন। পাশের রাজ্যের প্রতিশ্রুতিমান হিসেবে। তার পর কলকাতাই হয়ে গেল পাকাপাকি ঠিকানা। ছোটবেলা থেকেই পি কে-কে (কলকাতা, বাংলা-সহ ভারতীয় ফুটবল মহলে তিনি এ নামেই জনপ্রিয়) লড়াই করতে হয় দারিদ্রের সঙ্গে। তবে শুরুর দিকে সেই লড়াইয়ে প্রবল ভাবে পাশে পেয়েছেন বাবা প্রভাত বন্দ্যোপাধ্যায়কে। না হলে যাত্রা শুরু করাই কঠিন হয়ে যেত।

১৯৫২ সালে তাঁর বয়স তখন মাত্র ১৬। বিহারের হয়ে প্রথম সন্তোয ট্রফি খেলার সুযোগ এল। ওদিকে সদ্য ঢুকেছেন অল্প টাকার চাকরিতে। পরিবারে প্রবল আর্থিক অনটনে সেই ক’টি টাকা খুবই জরুরি। চাকরি থেকে ছুটি পাওয়া কঠিন। হতাশ কিশোর বাবাকে জানাল। বাবা নিজে গিয়ে অফিস কর্তাদের অনুরোধ করলেন। তাতেও বরফ গলল না। কর্তারা মুখের উপর বলে দিলেন, ‘‘ছুটি হবে না। খেলতে গেলে চাকরি ছেড়ে দিয়ে যাক।’’

Advertisement

ছেলের স্বপ্ন আর সংসারের আর্থিক অনটনের মধ্যে কোনটাকে বেছে নিতে হবে, ত নিয়ে সে দিন দ্বিধায় ভোগেননি প্রভাতবাবু। পরিবারের অনেকের বিরুদ্ধে গিয়ে নিজে হাতে পদত্যাগপত্র লিখে ছেলের হাতে তুলে দিয়ে বলেন, ‘‘সই করে দে।’’ বাবার আপসহীন, কঠোর মনোভাবই জ্বালিয়ে দিল এক ফুটবল-প্রদীপ। যার শিখা এর পর বাড়তেই থাকবে। ১৬ বছর বয়সে সন্তোষ ট্রফি, ১৯ বছরে প্রথম আন্তর্জাতিক ম্যাচ। মাত্র ২০ বছর বয়সে অলিম্পিয়ান। এত অল্প বয়সে এমন দুর্গম সব গিরিশৃঙ্গ পার করার নজির ভারতীয় ফুটবল আর দেখেছে কি না সন্দেহ। ১৯৬০ রোম অলিম্পিক্সে ভারতের অধিনায়ক। ১৯৬২-তে দক্ষিণ কোরিয়ার বিরুদ্ধে ঐতিহাসিক এশিয়ান গেমস ফাইনালে গোলদাতা। এশিয়ার সেরা উইঙ্গারের শিরোপা জয়। দশ বছরের উপরে ছিলেন দেশের এক নম্বর রাইট উইঙ্গার। ২০০৪-এ ফিফার ‘অর্ডার অফ মেরিট’ জেতেন।

বর্ণময় অভিযান

• ১৫ বছর আট মাস বয়সে সন্তোষ ট্রফিতে বিহারের হয়ে নজরকাড়া ফুটবল উপহার দিয়ে আত্মপ্রকাশ
• ১৯৫৪ সালে কলকাতায় আগমন রাজস্থান ক্লাবে। পরের বছরেই ইস্টার্ন রেলে। ১৯৫৫-১৯৬৮, টানা ১৪ বছর ইস্টার্ন রেলের হয়ে কলকাতা লিগে ১১১ গোল। ১৯৫৮তে লিগ চ্যাম্পিয়ন
• ১৯৫৫ সালে ভারতের জার্সিতে ঢাকায় চারদেশীয় প্রতিযোগিতায় আত্মপ্রকাশ। গোল করেছিলেন পাঁচটি
• ১৯৫৬ সালে ভারতের হয়ে মেলবোর্ন অলিম্পিক্সে যাত্রা। ভারত চতুর্থ হয়। ১৯৬০ রোম অলিম্পিক্সে ভারতীয় ফুটবল দলের অধিনায়ক।
• ১৯৬২ জাকার্তা এশিয়ান গেমসে সোনা জয়। গোল ছিল চারটি। তিনটি এশিয়ান গেমস মিলিয়ে মোট ছ’ গোল
• বাংলার হয়ে সন্তোষ ট্রফি জয় ১৯৫৫ সালে। তিন বার রেলওয়েজের হয়ে (১৯৬১, ১৯৬৪, ১৯৬৬)
• ইস্টবেঙ্গল (২৮) এবং মোহনবাগানের (২৫) কোচ হিসেবে মোট ৫৩টি ট্রফি জিতেছিলেন তিনি
• ইস্টবেঙ্গল (১৯৭২) এবং মোহনবাগানের (১৯৭৭) কোচ হিসেবে ত্রিমুকুট (শিল্ড, ডুরান্ড, রোভার্স কাপ) জয়

কে বড় রাইট উইঙ্গার, তিনি না বেঙ্কটেশ, তা নিয়ে আজও তর্ক চলে। বেঙ্কটেশের ফুটবল বোধ ছিল প্রখর। বল ছাড়াও সজাগ থাকতেন সব সময়। সেই সময়কার অনেক ডিফেন্ডারই মনে করতেন, বেঙ্কটেশের মতো ধূর্ত উইঙ্গার কেউ ছিলেন না। কিন্তু পিকের ছিল দুরন্ত গতির সঙ্গে শক্তিশালী শট। নিখুঁত নিশানায় হেডিং করার দক্ষতা। এক বার এই প্রশ্নটি করা হয়েছিল শৈলেন মান্নাকে। জবাব ছিল, ‘‘প্রদীপকেই আমার বেশি ভয়ঙ্কর মনে হত।’’ বিহারের হয়ে খেলতে এসে সেই সন্তোষ ট্রফিতেই পিকে চোখে পড়ে যান কলকাতার ফুটবল কর্তাদের। সেই সময়ে ভারতীয় ফুটবল নিয়ন্ত্রণ করত দেশের চারটি শহর। কলকাতা, হায়দরাবাদ, বেঙ্গালুরু (তখন ব্যাঙ্গালোর) এবং মুম্বই। বিহার থেকে এসে চোখে পড়া এবং কলকাতার তিন প্রধানে না-খেলেও এক দশকের উপর দেশের এক নম্বর রাইট উইঙ্গার হিসেবে রাজ করে যাওয়া তাই আশ্চর্য প্রদীপেরই সমান।

যদিও কলকাতায় প্রথম আসার অভিজ্ঞতা ভাল নয়। দুই প্রধান থেকে শুরুর দিকে উপেক্ষাই জুটেছিল। বিস্মিত হতে পারেন অনেকে, কিন্তু ঘটনা হচ্ছে, সেই কঠিন সময়ে কিশোর পিকে-র কাঁধে যিনি হাত রেখেছিলেন, তাঁর নাম অমল দত্ত। পরবর্তীকালে যাঁরা হয়ে ওঠেন যুযুধান চাণক্য। এক দিন ময়দান থেকে ফেরার সময়ে অমল দত্ত দেখেন, ধর্মতলায় রাস্তায় দাঁড়িয়ে কাঁদছেন পিকে। তখন তাঁকে কাছে টেনে নিয়ে বোঝান ময়দানের পরিবেশে কী ভাবে লড়তে হবে। দুই প্রধানে উপেক্ষিত পিকে প্রথমে যান এরিয়ান্স ক্লাবে। প্রতিশ্রুতি পেয়েছিলেন কীসের? না, দু’বেলার অন্ন এবং কোলে মার্কেটের উপরে মেসে মাথা গোঁজার ঠাঁই। পরের বছরেই আসে ইস্টার্ন রেলের চাকরির প্রস্তাব এবং সেখান থেকেই তাঁর আসল উত্থান। চল্লিশ বছর ধরে তিনি রেলের চাকরি করেন এবং কখনও কলকাতার তিন প্রধানে খেলেননি। না-খেলেও ১৯৫৫-১৯৬৬— টানা ১২ বছর ভারতীয় দলের প্রথম একাদশে তাঁর উপস্থিতি নিয়ে কেউ প্রশ্ন তুলতে পারেনি।

ফুটবলার পিকে আরও একটি প্রাচীর উপড়ে ফেলেছিলেন। সেই সময়ে কলকাতার তিন প্রধানের বাইরে কেউ ভারতীয় দলের অধিনায়ক হওয়ার কথা ভাবতে পারতেন না। ১৯৬০ রোম অলিম্পিক্সে পিকে-ই প্রথম তিন প্রধানের বাইরে থেকে আসা ভারত অধিনায়ক। ফুটবলার হিসেবে পিকের সেরা মুহূর্ত ১৯৬২ জাকার্তা এশিয়ান গেমসের ফাইনাল। ঐতিহাসিক সোনা জয়ের ম্যাচে ভারত ২-১ হারায় দক্ষিণ কোরিয়াকে। ভারতের প্রথম গোলটি করেন তিনি।

১৯৬৭ সালে অবসর নিলেও কোচ হিসেবে দ্বিতীয় ইনিংসে ফিরে আসেন পিকে। সত্তর দশক ছিল কোচ পিকের দশক। প্রবাদই তৈরি হয়ে গিয়েছিল, পিকে যেখানে ট্রফি সেখানে। রহিম সাহেবই প্রথম লক্ষ্য করেছিলেন পিকের মধ্যে কোচ হওয়ার মশলা। খেলার দিন থেকেই অসাধারণ ‘গেম রিডিং’ ক্ষমতা ছিল তাঁর। পরে একাধিক কোচিং কোর্স করে পেশাদারি ভঙ্গিতে নিজেকে উন্নত করেছিলেন। ইস্টবেঙ্গলের কোচ হিসেবে ১৯৭৩-এ উত্তর কোরিয়ার ডক রো গ্যাং দলকে হারিয়ে ডিসিএম জয়, মোহনবাগানের হয়ে ১৯৭৮ আইএফএ শিল্ড ফাইনালে রাশিয়ার বিখ্যাত দল আরারাতের বিরুদ্ধে ২-২ ড্র ফুটবলের রূপকথায় স্থান করে নিয়েছে। অক্লান্ত ভাবে কথা বলে যেতে পারতেন। ‘পিকে ভোকাল টনিক’ চিরবিখ্যাত হয়ে থাকবে। তেমনই ঘরোয়া আড্ডা জমানোর জন্য সকলে খুঁজতেন তাঁকে। ১৯৭৫-এ ডিসিএম ফাইনালে দক্ষিণ কোরিয়ার হ্যানইয়াং ইউনিভার্সিটির বিরুদ্ধে হাফ টাইমে ০-১ পিছিয়ে ইস্টবেঙ্গল। দ্বিতীয়ার্ধের খেলা শুরু হওয়ার আগে সব ফুটবলারকে গোল করে দাঁড় করিয়ে আবেগতাড়িত পিকে সকলকে লাল-হলুদ পতাকা ছুঁইয়ে প্রতিজ্ঞা করান, শেষ বিন্দু দিয়ে লড়ে ম্যাচ জিতে আসব। কোচ হিসেবে অনেক বার তিনি এমন ‘ভোকাল টনিক’ দিয়ে খেলোয়াড়দের তাতিয়ে তুলেছেন। দুই উইঙ্গার সুভাষ ভৌমিক এবং স্বপন সেনগুপ্তকে তিনি বারবার তাতিয়েছেন এই বলে যে, তোমরা জোরে শট নিতে পারো না। ১৯৯৭-এর সেই বিখ্যাত ফেডারেশন কাপ ফাইনালেও ‘ডায়মন্ড’ অমল দত্তের মোহনবাগানের বিরুদ্ধে ভাইচুং ভুটিয়াদের তাতিয়ে দেন। ফল? ফেভারিট মোহনবাগানের দর্প চূর্ণ করে চ্যাম্পিয়ন হয় ইস্টবেঙ্গল।

যাঁর স্পর্শে আন্ডারডগ উপড়ে ফেলত ফেভারিটকে, সেই আশ্চর্য প্রদীপ শুক্রবার নিভে গেল। এর পরে হয়তো জ্বলবে স্বর্গ্যোদানে। উল্টো দিকে থাকবেন হয়তো ‘ডায়মন্ড কোচ’ অমল দত্ত। ময়দানের সেই আলেক্স ফার্গুসন বনাম আর্সেন ওয়েঙ্গার দ্বৈরথ!

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement