স্মরণীয়: পঁচাত্তরের সেই আইএফএ শিল্ডে ঐতিহাসিক পাঁচ গোলে জয়ের পরে ভক্তদের কোলে পিকে। ফাইল চিত্র
লাল-হলুদ জার্সি গায়ে খেলার স্বপ্ন আমার কখনও পূরণ হয়নি। ইস্টার্ন রেলের চাকরি ছাড়ার মতো মনের জোর বা পরিস্থিতি কোনওটাই ছিল না সেই সময়। চাকরি ছেড়ে দিলে খাব কী? তা ছাড়া ইস্টার্ন রেলের সঙ্গে একটা সম্পর্ক তৈরি হয়ে গিয়েছিল। কেউ কাউকে ছেড়ে থাকতে পারতাম না। তাই বহু বার ইস্টবেঙ্গলে খেলার প্রস্তাব পেয়েও রাজি হইনি।
অবসরের পরে কোচিং করাব ঠিক করলাম। আমার পরিচিতরা ধরেই নিয়েছিল, বড় ক্লাবে কোচিং করালে আমি মোহনবাগানেই যাব। কারণ, সেই সময় ইস্টবেঙ্গলের কর্তাদের সঙ্গে আমার সম্পর্ক খুব একটা মধুর ছিল না। কিন্তু আশ্চর্যজনক ভাবে সেই ইস্টবেঙ্গলেই আমার ক্লাব কোচিংয়ের সূচনা।
১৯৭২ সাল। মোহনবাগানের কোচ হওয়ার প্রস্তাব নিয়ে করুণা ভট্টাচার্যের আসার কথা ছিল আমার কাছে। কিন্তু তিনি আসার আগেই কিংবদন্তি ইস্টবেঙ্গল কর্তা জ্যোতিষ গুহ তার বিশ্বস্ত অনুচরদের পাঠালেন আমার কাছে। তারা এসে বলল, ‘‘জ্যোতিষদা আপনাকে ডেকেছেন।’’ আমি অবাকই হয়েছিলাম শুনে। দেখা করতে গেলাম লাল-হলুদ কর্তার সঙ্গে। ওঁর প্রথম কথাই ছিল, ‘‘তোমাকে কোচিং করাতে হবে।’’ সঙ্গে সঙ্গে আমার মুখ থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল, আমাকে কোচিং করতে ডেকেছেন? আপনারা খুশি হবেন আমি কোচিং করালে? জ্যোতিষবাবুর জবাব ছিল, ‘‘হ্যাঁ, সেই কারণেই তোমাকে ডেকেছি।’’ বললাম, মানসিক ভাবে আমি এখনও তৈরি নই। একটু সময় দিতে হবে।
ইস্টবেঙ্গলের প্রবাদপ্রতিম কর্তা মনে হয় ঠিকই করে ফেলেছিলেন, আমার হাতেই দলের দায়িত্ব তুলে দেবেন। বলে দিলেন, ‘‘ঠিক আছে, তুমি তৈরি হও। কবে দায়িত্ব নেবে বলো।’’ আমি তো পড়লাম মহা সমস্যায়। জিজ্ঞেস করলাম, কাল-পরশুর মধ্যে জানালে হবে? উনি রাজি হলেন। বাড়িতে ফিরে সবার সঙ্গে আলোচনা করলাম। পরের দিনই ইস্টবেঙ্গল ক্লাবে চলে গেলাম। শুরু হয়ে গেল কোচিং। ইস্টবেঙ্গল সম্পর্ক যে ধারণা ছিল, প্রথম দিনই তা দূর হয়ে গেল। কর্তা থেকে সমর্থক, সকলের ভালবাসা মুগ্ধ করল। তখন মনে হল, ইস্টবেঙ্গলের দায়িত্ব না নিলে বড় ভুল করতাম। অভিষেকের বছরেই ত্রিমুকুট জিতলাম।
ইস্টবেঙ্গলে প্রথম বার কোচিংয়ের আরও একটা ঘটনা মনে পড়ছে। প্রাতরাশ করে অনুশীলনে নামার কথা ফুটবলারদের। কিন্তু সে দিন কোনও কারণে তখনও ডিম সিদ্ধ হয়নি। ফুটবলারদের মধ্যে অসন্তোষ বাড়ছে। আমি ওদের বললাম, চলো প্র্যাক্টিস করতে চাই। এসে সবাই মিলে খাওয়া-দাওয়া করব। প্র্যাক্টিসের পরে ওরা ক্লাব তাঁবুতে ফিরে দেখল খাবার-দাবার সব তৈরি। তখন আর কারও মধ্যে ক্ষোভ নেই। ১৯৭২ থেকে ’৭৫ টানা কোচিং করিয়েছি ইস্টবেঙ্গলে। প্রথম পর্বের কোচিংয়ে আমার সেরা প্রাপ্তি আইএফএ শিল্ডের ফাইনালে মোহনবাগানকে পাঁচ গোলে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হওয়া।
ফাইনালের কয়েক দিন আগে থেকেই ওয়ার্ম আপের সময়ে কথা বলতে শুরু করেছিলাম ফুটবলারদের সঙ্গে। ওদের বোঝালাম, আমি কী চাই। কী ভাবে খেলা উচিত। ম্যাচটা শুরু হওয়ার আগে ওদের বলেছিলাম, মরসুমের শেষ ম্যাচ খেলতে নামছ তোমরা। তাই কে জিতল, সেটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। কী ভাবে জিতল, সেটাই আসল। সে-দিন অবিশ্বাস্য খেলেছিল ছেলেরা। ম্যাচের পরে ইস্টবেঙ্গল সমর্থকেরা আনন্দে কী করবেন বুঝতে পারছিলেন না। কয়েক জন তো আমাকে পাঁজাকোলা করে মাঠ প্রদক্ষিণ করতে শুরু করে দিলেন। কয়েক জন আবার ইলিশ মাছ নিয়ে এসেছিলেন। সে-দিন মোহনবাগান মাঠ থেকে ইস্টবেঙ্গল তাঁবু পৌঁছতে ঘণ্টাখানেক লেগে গিয়েছিল।
২২ বছর পরে একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি দেখেছিলাম যুবভারতীতে। ১৯৯৭ সালের ১৩ জুলাই। ফেডারেশন কাপ সেমিফাইনাল। ইস্টবেঙ্গলের দায়িত্বে আমি। মোহনবাগানের কোচ প্রয়াত অমল দত্ত। ওদের দল সে-বার যেন অশ্বমেধের ঘোড়া। দুর্ধর্ষ দল। ইংল্যান্ড থেকে আরও শক্তিশালী ও ভয়ঙ্কর হয়ে ফিরেছে চিমা ওকোরি। মোহনবাগানের ডায়মন্ড সিস্টেমের সামনে কোনও দলই দাঁড়াতে পারছে না। খুব চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলাম। মোহনবাগানকে আটকানোর অঙ্ক করতে গিয়ে রাতের ঘুম প্রায় উধাও হয়ে গিয়েছিল। ম্যাচের কয়েক দিন আগে আমার চাপটা কমিয়ে দিয়েছিলেন স্বয়ং মোহনবাগান কোচই। ভাইচুং, ওমোলো, সোসোকে খুব বাজে ভাষায় আক্রমণ করলেন। ব্যঙ্গ করে ওদের নানা রকম নাম দিলেন। ফুটবলার উত্তেজিত করতে হাতিয়ার করলাম বিপক্ষ কোচের তাচ্ছিল্যকেই। তাতেই কাজ হল। সে-দিন যুবভারতীতে দুর্ধর্ষ মোহনবাগানকে ৪-১ হারিয়ে মাঠ ছেড়েছিলাম।
যুবভারতীর খুব কাছেই আমার বাড়ি। গাড়িতে করে গেলে মিনিট সাত-আটকের মধ্যেই পৌঁছে যাওয়া যায়। সে-দিন পৌঁছতে ঘণ্টাখানেক লেগে গিয়েছিল। একেবারেই পঁচাত্তরের শিল্ড ফাইনালের পুনারবৃত্তি। সেই আবেগ। সেই উন্মাদনা। কোনও কিছুই বদলায়নি। ইস্টবেঙ্গলে আমি ছ’দফায় কোচিং করিয়েছি। প্রথম বার বাহাত্তর থেকে ৭৫। এর পরে ১৯৮০ সালে ফের ফিরে আসি। ৮৩-তে আবার দায়িত্ব নিই। ১৯৮৫ সালেও ইস্টবেঙ্গলের কোচ ছিলাম। তার পরে ১৯৮৮-’৮৯। শেষ বার ১৯৯৭ সালে। প্রত্যেকবারই একই রকম অনুভূতি হয়েছে।
আমার কোচিং কিন্তু শুধু মাঠের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকত না। প্রত্যেকের মানসিকতা আলাদা। আমাকে তাদের মতো করে ভাবতে হত। কেউ কেউ হয়তো খুব অল্পেই মাথা গরম করে ফেলে। তাদের নিয়ন্ত্রণ করার জন্য এক রকম ফর্মুলা। আবার অনেকে নিঃশব্দে নানা ধরনের কাণ্ড করতে ওস্তাদ। এদের সামলানোর জন্য অন্য স্ট্র্যাটেজি তৈরি করতাম। কে কী করছে সব খবর রাখতাম। কোচ মানে শুধুই বিপক্ষকে হারানোর রণনীতি তৈরি করা নয়। সব দিক সামলাতাম। বিদেশি ও ভিন্ রাজ্যের ফুটবলারদের উপরে নজরটা একটু বেশি রাখতাম। বাড়ির জন্য ওদের মন খারাপ করাটা খুব স্বাভাবিক। আমার লক্ষ্য থাকত, ওরা যেন কলকাতায় নিজেদের একা না-ভাবে। এর জন্য মাঝেমধ্যেই বাড়িতে নিমন্ত্রণ করতাম।
চিমা তখন ইস্টবেঙ্গলে। কেন জানি না মনে হচ্ছিল, আমি যা চাইছি, ওর কাছ থেকে তা পাচ্ছি না। অথচ চিমার কী সমস্যা হচ্ছে বুঝতে পারছি না। ও নিজেও কিছু বলছে না। সামনেই ডার্বি। যে ভাবে হোক চিমার সমস্যা দূর করতেই হবে। ওর উপরেই নির্ভর করছে ইস্টবেঙ্গলের ভাগ্য। এই ধরনের পরিস্থিতিতে আমার একমাত্র ভরসা ছিল স্ত্রী আরতি। ওকে বললাম, চিমাকে নিমন্ত্রণ করছি। তোমাকে কিন্তু নাইজিরীয় খাবার রান্না করতে হবে। আরতি বলল, ‘‘আমি তো নাইজিরীয় রান্না জানি না। তুমি বরং চিমাকে কোনও রেস্তরাঁয় নিয়ে যাও।’’ আমার উদ্দেশ্য ছিল, নাইজিরিয়ার খাবার খাইয়ে চিমাকে বোঝানো যে, তুমি আমাদের পরিবারেরই সদস্য। আরতিকে বোঝালাম আমার সমস্যাটা। হঠাৎ মনে পড়ল, চিমা-ই এক দিন বলেছিল, ওদের রান্নায় চিজ-মাখন খুব ব্যবহার করা হয়। আরতিকে বললাম, খুব করে চিজ-মাখন দিয়ে মাংস রান্না করতে। মনের মতে খাবার খেয়ে চিমা অভিভূত হয়ে গিয়েছিল।
ইস্টবেঙ্গলে কোচিং করানোর সময়ে এই আরতির সঙ্গে প্রায়ই ঝগড়া হত। ও মোহনবাগানের সমর্থক ছিল। বেশ কয়েক বার ডার্বির আগে তো কথা বলাও বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। তবে জিতে বাড়ি ফেরার পরে খুব আনন্দ করত। ইস্টবেঙ্গলের শতবর্ষে আরতির অভাব খুব অনুভব করছি। ভুলতে পারছি না সন্তানসম কৃশানু দে, সুদীপ চট্টোপাধ্যায়ের অকালে চলে যাওয়া। আর এক জন স্বপন বল। ইস্টবেঙ্গলের জন্য জীবন বাজি রাখতেও তৈরি ছিল। শতবর্ষের আনন্দের মধ্যেও কাঁটার মতো বিঁধে থাকছে এই যন্ত্রণা।