(বাঁ দিকে) প্যারিস অলিম্পিক্সে রুপোজয়ী নীরজ চোপড়া। সোনাজয়ী আরশাদ নাদিম (ডান দিকে)। ছবি: পিটিআই।
প্যারিস অলিম্পিক্সে নীরজ চোপড়া সোনা জিততে পারবেন না, এই কথা বললে বৃহস্পতিবার রাতের আগে কেউ বিশ্বাস করতেন কি না সন্দেহ। কারণ ভারতীয় সমর্থকেরা নীরজের গলায় সোনার পদক দেখতে পাচ্ছিলেন। সেটা ভুল ছিল। ভুল বুঝতে না পেরে উৎসবের সব পরিকল্পনা তৈরি ছিল। আমরাও ব্যতিক্রম নই। কিন্তু গোকুলে যে আরশাদ নাদিম বাড়ছেন, সে দিকে নজর ছিল না। ভুল হয়েছে সকলের।
কেন নীরজের সোনা না জেতাই সঙ্গত?
নীরজ ২০২১ সালে টোকিয়ো অলিম্পিক্সে সোনা জিতেছিলেন ৮৭.৫৮ মিটার জ্যাভলিন ছুড়ে। সেই দূরত্ব প্যারিসে ছুড়লে ষষ্ঠ স্থানে শেষ করতে হত ভারতীয় অ্যাথলিটকে। গত তিন বছরে নীরজ উন্নতি করেছেন। প্যারিসে ছুড়েছেন ৮৯.৪৫ মিটার। রুপো এনে দিয়েছেন দেশকে। কিন্তু তিনি যে শ্রেষ্ঠ নন, তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন পাকিস্তানের আরশাদ। উন্নতি যে তিনিও করেছেন, সে দিকে নজর ছিল না কারও।
গত তিন বছরে নীরজ কখনও ৯০ মিটার পার করতে পারেননি। সেখানে আরশাদ ৯০-এর গণ্ডি পার করেছেন। বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় সোনা জিতে নীরজ বলেছেন, “আমার লক্ষ্য ৯০ মিটার।” যেখানে নীরজের লক্ষ্যটাই পাকিস্তানি প্রতিপক্ষ পূরণ করে ফেলেছেন, সেখানে নীরজকে সম্ভাব্য চ্যাম্পিয়ন বাছার মধ্যে ভুল তো ছিলই। লক্ষ্যভেদ হয়ওনি। টোকিয়ো থেকে প্যারিসের মাঝের তিন বছরে বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপ (২০২৩), ডায়মন্ড লিগ (২০২২), এশিয়ান গেমসে (২০২২) নীরজ সোনা জিতলেও কখনও ৯০ পার করতে পারেননি। আরশাদ সেটা পেরেছিলেন।
টোকিয়ো অলিম্পিক্সে পঞ্চম স্থানে শেষ করেছিলেন আরশাদ। ৮৪.৬২ মিটার ছুড়েছিলেন তিনি। তার পরের তিন বছরে অনেকটাই উন্নতি করেন। শেষ পর্যন্ত ২০২২ সালের কমনওয়েলথ গেমসে ৯০.১৮ মিটার ছুড়ে সোনা জিতেছিলেন তিনি। ভারতের নীরজ সেই প্রতিযোগিতায় চোটের কারণে নামেননি। হয়তো সেই কারণেই আরশাদের পারফরম্যান্সের দিকে নজর পড়েনি কারও। বরং শুধু দেখা হয়েছিল ২০২৩ সালের বিশ্বচ্যাম্পিয়নশিপে নীরজের পরে আরশাদের শেষ করার তথ্যটুকু। তা-ও বিশ্বচ্যাম্পিয়নশিপে রুপো পেয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছিল নীরজকে। শেষ পর্যন্ত প্যারিসে সবাইকে ভুল প্রমাণ করে আরশাদ টপকে গেলেন নীরজকে।
মানসিকতার তফাত
নীরজ বার বার বলেছেন, তাঁর লক্ষ্য ৯০ মিটার। কিন্তু শুরু থেকেই আরশাদের লক্ষ্য ছিল আরও দূরে। আগেই ৯০ মিটার পার করা আরশাদ পরের ধাপের জন্য নিজেকে তৈরি করেছিলেন। প্যারিসে সোনা জেতার পরেও আরশাদ বুঝিয়ে দিয়েছেন, মানসিকতায় তিনি কতটা এগিয়ে। ৯২.৯৭ মিটার ছুড়ে তিনি বলেছেন, পরের লক্ষ্য ৯৫ মিটার। সেখানে নীরজ এখনও ৯০-এর নীচে পড়ে রয়েছেন। আরশাদের বক্তব্য, “এখানে সোনা জিতে আমি খুশি। কিন্তু আমি আরও দূরে ছুড়তে চাই। আরও পরিশ্রম করব। ৯৫ মিটার দূরে ছুড়তে চাই। আমার এই সোনা জয়ের নেপথ্যে রয়েছেন কোচ। তাঁর জন্যই আমি অলিম্পিক্সে নিজের সেরাটা দিতে পেরেছি।”
অঙ্কের বিচারেও এগিয়ে ছিলেন আরশাদ
নীরজ যখন নিজের সেরা ফর্মে ছিলেন, তখনও নব্বইয়ের গণ্ডি পার করতে পারেননি। আরশাদ পেরেছিলেন। ‘প্রোব্যাবিলিটি’র তত্ত্বে আরশাদেরই নিজেকে ছাপিয়ে যাওয়ার কথা ছিল। নীরজের কাছে কাজটা অসম্ভব ছিল, আরশাদের জন্য সম্ভব ছিল। সোনা জিততে হলে নীরজকে নিজের সেরা পারফরম্যান্সকে ছাপিয়ে যেতে হত। আরশাদকে হারতে গেলে নিজের সেরা পারফরম্যান্সের থেকে অনেক খারাপ করতে হত। ‘প্রোব্যাবিলিটি’র তত্ত্বে সেটা সম্ভব নয়, সম্ভব হয়ওনি।
কেন নীরজকে সম্ভাব্য চ্যাম্পিয়ন ধরা হয়েছিল?
প্রস্তুতিতে নীরজ এবং আরশাদের তফাত অনেক। ভারতের সোনার ছেলের জন্য প্রায় ৬ কোটি টাকা খরচ করেছিল কেন্দ্র সরকার। ২০২১ সালে টোকিয়োয় নীরজ যা পারফর্ম করেছিলেন তা থেকে বোঝা গিয়েছিল প্যারিসেও তিনি বড় বাজি। তাই পরের তিন বছরের ‘টার্গেট অলিম্পিক্স পোডিয়াম স্কিম’-এর আওতায় ৩,১২,০৪,৯৯ টাকা খরচ করা হয়েছিল নীরজের জন্য। তা ছাড়া ‘অ্যানুয়াল ক্যালেন্ডার ফর ট্রেনিং অ্যান্ড কম্পিটিশন’-এর আওতায় নীরজের জন্য খরচ করা হয়েছিল আরও ২,৬০,১৭,৩৫৮ টাকা। অর্থাৎ, দু’টি প্রকল্প মিলিয়ে মোট ৫,৭২,২১,৪৫৭ টাকা খরচ করেছিল কেন্দ্রীয় সরকার। এই তথ্য দিয়েছে স্পোর্টস অথরিটি অফ ইন্ডিয়া (সাই)।
আরশাদের সেখানে সঠিক জ্যাভলিনই ছিল না। আরশাদ কয়েক মাস আগেও ঠিক মতো অনুশীলন করতে পারছিলেন না। আধুনিক একটিও জ্যাভলিন ছিল না তাঁর কাছে। গত সাত-আট বছর ধরে একটি জ্যাভলিন নিয়েই বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় নামছিলেন। পাঁচ মাস আগে সমস্যার কথা জানিয়েছিলেন পাক অ্যাথলিট। তার পর আরশাদের সমস্যার সমাধান হয়। তাঁর বাবা বলেন, “আরশাদ এই জায়গায় কী ভাবে পৌঁছেছে, সেই সম্পর্কে কারও কোনও আন্দাজ নেই। আমাদের গ্রামের প্রতিবেশী, আত্মীয়েরা টাকা দিয়েছিল ওকে অনুশীলন করার জন্য।” গত কয়েক মাস নিজেকে অনুশীলনে ডুবিয়ে রাখার সাফল্য পেলেন আরশাদ। পাকিস্তানকে প্রথম ব্যক্তিগত সোনা এনে দিলেন অলিম্পিক্স থেকে।
নীরজ এবং আরশাদের তফাত ছিল পরিকাঠামো এবং অনুশীলনে। গত তিন বছরে সরকারি খরচে ছ’বার বিদেশে অনুশীলন করতে গিয়েছিলেন নীরজ। তাঁর জন্য কোচ, ফিজিয়োর ব্যবস্থা করা হয়েছিল। ফিনল্যান্ড, তুরস্কে দু’বার এবং আমেরিকা, ইংল্যান্ড, দক্ষিণ আফ্রিকা, জার্মানি ২০২১ সালের ৫ ডিসেম্বর থেকে ২০২২ সালের ৪ মার্চ পর্যন্ত মোট ৯০ দিন আমেরিকায় অনুশীলন করেছিলেন নীরজ। অন্য দিকে, আরশাদের কোচ সৈয়দ হুসেন বুখারি বলেন, “আরশাদ অধিকাংশ সময় ইসলামাবাদ বা লাহোরে অনুশীলন করে।”
আরশাদের শ্রেষ্ঠত্ব স্বীকার করেছেন নীরজও
আরশাদের থেকে এক ধাপ নীচে শেষ করে নীরজ বলেন, “দেশের জন্য পদক জিতলে সব সময় ভাল লাগে। আমাকে আরও উন্নতি করতে হবে। আমাদের আলোচনা করতে হবে, খুঁজে বার করতে হবে, কী করে আরও উন্নতি করা যায়। প্যারিসে ভারত ভাল খেলেছে। এখানে প্রতিযোগিতা অনেক কঠিন ছিল। আজকের দিনটা আরশাদের ছিল। আমি নিজের সেরাটা দিয়েছি। কিন্তু আমার এখনও উন্নতি করার জায়গা রয়েছে। আমাদের জাতীয় সঙ্গীত বাজেনি প্যারিসে। ভবিষ্যতে বাজবে। অবশ্যই বাজবে। প্যারিস না হলে অন্য কোথাও।”
নীরজ স্বীকার করে নিয়েছেন, তিনি পুরোপুরি সুস্থ নন। ভারতের জ্যাভলিন থ্রোয়ার বলেন, “আমার সেরাটা এখনও দেওয়া বাকি। আমি যখন পুরোপুরি সুস্থ থাকব, মানসিক ভাবে প্রস্তুত থাকব, তখন অবশ্যই সেটা করতে পারব।” নীরজ যে সুস্থ নন, সেটা তাঁর বাবা সতীশ চোপড়াও মনে করিয়ে দিয়েছেন। তিনি বলেন, “আমার মনে হয় চোট একমাত্র কারণ, যে জন্য নীরজ পিছিয়ে পড়ল। ও বলেছিল যে, কুঁচকিতে চোট রয়েছে। অলিম্পিক্সের পর অস্ত্রোপচার হবে। তার পর পুরোপুরি সুস্থ হবে ও।”
বিশ্বমানে নীরজ কোথায়?
আরশাদ তৈরি করছিলেন নিজেকে। কিন্তু ভারতবাসী অন্য কোনও দিকে তাকাতে চায়নি। জ্যাভলিনে ১৯৯৬ সালে বিশ্বরেকর্ড গড়া চেকিয়ার জান জেলেঞ্জির (৯৮.৪৮ মিটার) থেকেও বড় ভাবা হচ্ছিল ৯০ মিটার পার করতে না পারা নীরজকে। কিন্তু ভারতীয় জ্যাভলিন থ্রোয়ারের কেরিয়ারের সেরা পারফরম্যান্সই মাত্র ৮৯.৯৪ মিটার। এমনকি নীরজ-যুগে ২০২০ সালে জার্মানির জোহানেস ভেটারও যে ৯৭.৭৬ মিটার ছুড়ে বসে আছেন, সে দিকেও তাকাননি কেউ। শুধু নীরজকে নিয়েই স্বপ্ন দেখছিল দেশ। ভুল করেছিল। ভুল করেছিলাম আমরাও।