সোনা হারানোর হতাশা। রুপো জিতেই সন্তুষ্ট থাকতে হল নীরজ চোপড়াকে। ছবি: পিটিআই।
৭ অগস্ট, ২০২১। টোকিয়ো অলিম্পিক্স। জ্যাভলিনের ফাইনাল শুরু হওয়ার আগে কেউ হয়তো ভাবেননি ট্র্যাক অ্যান্ড ফিল্ডে কোনও ভারতীয় সোনা জিততে পারেন। সেটাই করে দেখিয়েছিলেন নীরজ। ৮৭.৫৮ মিটার ছুড়ে সোনা জিতেছিলেন তিনি। অভিনব বিন্দ্রার পরে ভারতের ব্যক্তিগত সোনাজয়ীর তালিকায় নাম লিখিয়েছিলেন।
৯ অগস্ট, ২০২৪। ঠিক তিন বছর পরে সেই একই কীর্তি আবার করার সুযোগ ছিল নীরজের সামনে। যোগ্যতা অর্জন পর্বে সকলের থেকে বেশি ছুড়েছিলেন নীরজ। কিন্তু ফাইনালে পারলেন না। হয়তো প্রত্যাশার চাপ সামলাতে পারলেন না। সোনা না জিতলেও অবশ্য পদক আনলেন নীরজ। রুপো জিতে প্যারিস থেকে ফিরতে হচ্ছে ভারতীয় তারকাকে। নীরজ হেরে গেলেন পাকিস্তানের আরশাদ নাদিমের কাছে। বেশ কয়েক বছর ধরে নীরজ ও আরশাদ বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশ নেন। ভারতীয় তারকা অনেক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন, আরশাদ তাঁর বন্ধু। সেই বন্ধুর কাছেই হারতে হল নীরজকে।
প্যারিসে ফাইনালের শুরুটা ভাল হয়নি নীরজের। প্রথম থ্রো করতে গিয়ে পড়ে যান তিনি। দাগে পা লেগে যাওয়ায় প্রথম থ্রো বাতিল হয়। ফলে চাপ আরও বাড়ে। বাকি দু’টি থ্রোয়ের মধ্যে ভাল করতে হত তাঁকে। পাকিস্তানের আরশাদ নাদিম নিজের দ্বিতীয় থ্রোয়ে ছোড়েন ৯২.৯৭ মিটার। নতুন অলিম্পিক্স রেকর্ড গড়েন তিনি। ফলে চাপ আরও বেড়ে যায় নীরজের উপর। সোনা জিততে হলে নিজের সেরা থ্রো করতে হত তাঁকে। দ্বিতীয় থ্রো ভাল করেন নীরজ। ৮৯.৪৫ মিটার ছোড়েন তিনি। চলতি মরসুমের সেরা থ্রোয়ের পরেও নীরজের থেকে সোনা তখনও দূরে ছিল। নীরজের তৃতীয় থ্রো-ও বাতিল হয়। দ্বিতীয় রাউন্ডেও শুরুটা ভাল হয়নি তাঁর। চতুর্থ থ্রো-ও বাতিল হয় নীরজের। পরের থ্রোয়েও একই ছবি। মেজাজ হারাতে দেখা যায় ভারতীয় খেলোয়াড়কে। শেষ থ্রো-ও ভাল হয়নি। আরশাদ শেষ থ্রো-ও করেন ৯০ মিটারের বেশি। দ্বিতীয় স্থানে শেষ করেন নীরজ। সোনা না জিতলেও তিনিই একমাত্র ভারতীয় খেলোয়াড় যিনি অলিম্পিক্সে একটি সোনা ও একটি রুপো জিতলেন।
রুপো জেতার পরে নীরজকে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন দেশের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ও পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। নিজের নিজের এক্স (সাবেক টুইটার) হ্যান্ডলে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন তাঁরা।
যে নীরজ দেশকে সম্মানিত করলেন, তাঁর অ্যাথলেটিক্সে আসা নিতান্তই কাকতালীয় ভাবে। ছোট থেকে নীরজের এক এবং একমাত্র দুর্বলতা ছিল খাবার। যে কোনও খাবার দেখলেই হামলে পড়তেন তিনি। পছন্দ ছিল তাজা ক্রিম এবং চুরমা (রুটি, ঘি এবং চিনি দিয়ে বানানো এক ধরনের পঞ্জাবি পদ)। খাবারের প্রতি নীরজের এই টানে ইন্ধন দিতেন তাঁর ঠাকুমা। সুযোগ পেলেই নাতিকে চুরমা বানিয়ে খাওয়াতেন। ঠাকুমার প্রশ্রয় পেয়ে অতি অল্প বয়সেই নাদুসনুদুস গোলগাল চেহারার হয়ে পড়েছিলেন নীরজ। ১২ বছরে তাঁর ওজন দাঁড়ায় ৯০ কেজির বেশি।
বাধ্য হয়ে নীরজের ওজন কমানোর জন্য বাবা-মা জোর করে মাঠে পাঠাতেন তাঁকে। হরিয়ানার পানিপথ জেলার খান্দরা গ্রামে জন্ম নীরজের। বাড়ির পাশেই শিবাজি স্টেডিয়ামে রোজ সকালে জগিং করতে যেতেন তিনি। সেখানেই পরিচয় হয় প্রাক্তন জ্যাভলিন থ্রোয়ার জয় চৌধরির সঙ্গে। জয়ের সঙ্গে দেখা হওয়ার আগে পর্যন্ত নীরজ জানতেনই না জ্যাভলিন কী জিনিস। একদিন খেলাচ্ছলেই তাঁকে জ্যাভলিন ছুড়তে বলেছিলেন জয়। প্রথম প্রচেষ্টাতেই প্রায় ৪০ মিটার দূরে ছুড়েছিলেন নীরজ। প্রথম বার দেখেই জয় বুঝেছিলেন নীরজের ওজন বেশি থাকলেও শরীরে নমনীয়তা রয়েছে।
তার পর থেকে ধীরে ধীরে জ্যাভলিন নীরজের জীবনের একটা অঙ্গ হয়ে ওঠে। তাঁর ওজনও ক্রমশ কমতে থাকে। চণ্ডীগড়ের ডিএভি কলেজে পড়াকালীন নীরজ অংশগ্রহণ করতে শুরু করেন বিভিন্ন জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায়। তত দিনে নীরজ হয়ে উঠেছেন সুঠাম। পেটানো চেহারা দেখলে মেলানো যাবে না ছোটবেলার সঙ্গে।
২০১৪ সালে দক্ষিণ এশীয় গেমসে ৮২.২৩ মিটার ছুড়ে জাতীয় রেকর্ড স্পর্শ করেন নীরজ। তখন সেই রেকর্ডকে কেউ পাত্তা দেননি। তবে নীরজ নজর কেড়ে নেন সে বছরই পোলান্ডের বিডগজে অনুষ্ঠিত হওয়া আইএএএফ বিশ্ব অনূর্ধ্ব-২০ প্রতিযোগিতায়। ৮৬.৪৮ মিটার ছুড়ে জিতে নেন সোনা। তৈরি করেন বিশ্ব জুনিয়র রেকর্ড। এর আগে এই প্রতিযোগিতায় কোনও ভারতীয় পদক জেতেননি। পরের বছর এশীয় অ্যাথলেটিক্স চ্যাম্পিয়নশিপে ৮৫.২৩ মিটার ছুড়ে সোনা জেতেন নীরজ। ২০১৮ কমনওয়েলথ গেমসে ৮৬.৪৭ মিটার ছুড়ে সোনা জেতেন। কমনওয়েলথ গেমসের অভিষেকেই পদক পেয়েছিলেন তিনি। সে বছরই দোহা ডায়মন্ড লিগে ৮৭.৪৩ মিটার ছুড়ে নিজেরই জাতীয় রেকর্ড ভেঙে দেন। ৮৮.০৬ মিটার ছুড়ে এশিয়ান গেমসেও সোনা জিতেছিলেন তিনি।
২০১৯ সালটা নীরজের পক্ষে খুব একটা ভাল যায়নি। কনুইয়ে চোট পান। সেই চোট সারাতে গিয়ে সারা বছর প্রায় কোনও প্রতিযোগিতাতেই অংশগ্রহণ করতে পারেননি। ২০২০-তে অতিমারি পর্বে গোটা বিশ্বেই খেলাধুলো বন্ধ হয়ে গিয়েছিল।
নীরজের উত্থানের পিছনে রয়েছেন গ্যারি কালভার্ট। নীরজের ছোটখাটো ভুলত্রুটি, খুঁটিনাটি শুধরে দিয়েছিলেন তিনি। ২০১৮ সালে হৃদ্রোগে আচমকাই তিনি প্রয়াত হওয়ার পরে বিখ্যাত জার্মান কোচ উয়ে হনের কাছে প্রশিক্ষণ নিতে শুরু করেন নীরজ। তার পরে তিনি কোচ হিসাবে পান আর এক জার্মান ক্লাউস বার্তোনিজ়কে। সেই শুরু। তার পর থেকে বার্তোনিজ়ের কাছেই রয়েছেন নীরজ। বার্তোনিজ় বায়োমেকানিক্স বিশেষজ্ঞ। জ্যাভলিন থ্রো এমনই একটা প্রতিযোগিতা যেখানে শরীরের বিভিন্ন পেশিকে কাজে লাগাতে হয়। পাশাপাশি অঙ্ক কষে দেখতে হয়, কতটা উঁচুতে, কী রকম কোণ দিয়ে ছুড়লে সব চেয়ে বেশি দূরে যাবে বর্শা। খেয়াল রাখতে হয়, যাতে শরীর শক্তিশালী হওয়ার পাশে নমনীয়ও থাকে। এক জন বায়োমেকানিক্স বিশেষজ্ঞের পক্ষে এই দিকগুলোয় নজর রাখা সহজ।
বার্তোনিজ়ের সঙ্গে বেশ কিছু দিন ধরে কাজ করলেও নীরজ তাঁর নতুন অস্ত্র হাতে পেয়েছেন এই বছরের গোড়ার দিকেই। নাম— ‘ভালহালা’। এই জ্যাভলিনটার কয়েকটা বিশেষত্ব আছে। যেমন, কার্বন ফাইবারে তৈরি। যা স্টিলের চেয়েও ১৪ শতাংশ বেশি মজবুত। এই জ্যাভলিনের আরও একটা বিশেষত্ব হল, ১০০ শতাংশ কার্বনের তৈরি বলে খুব শক্ত। যে কারণে শূন্যে ছোড়ার পরে হাওয়ার ধাক্কায় খুব একটা দিক পরিবর্তন করে না। বলা হয়, নিখুঁত টেকনিকের অধিকারী থ্রোয়াররাই এই জ্যাভলিনটা ভাল ছুড়তে পারেন। কারণ, এটা নমনীয় নয়। তবে ঠিক মতো ছুড়তে পারলে এই জ্যাভলিন অনেক বেশি দূরত্ব যাওয়ার ক্ষমতা রাখে। আগে নীরজ ব্যবহার করতেন ‘নেমেথ’ বলে অন্য এক ধরনের জ্যাভলিন। সেই জ্যাভলিন কিছুটা নমনীয়, ফলে হাওয়ার ধাক্কায় দিক পরিবর্তনের একটা আশঙ্কা থাকত। এই বছরের মার্চে নতুন জ্যাভলিনে ছুড়ে জাতীয় রেকর্ডও ভেঙেছিলেন নীরজ।
নতুন অস্ত্র হাতে তুলে নেওয়ার পাশাপাশি গুরুর পরামর্শে নিজের টেকনিকে দু’-একটা ছোটখাটো পরিবর্তন করেছিলেন নীরজ। আগে নীরজের ‘থ্রো’ একটু বেশি বাঁ দিক ঘেঁষে চলে যাচ্ছিল। যে কারণে জ্যাভলিন ছোড়ার মুহূর্তে কব্জি এবং সামনের পায়ের অবস্থানে সামান্য বদল এনেছিলেন তিনি। পাশাপাশি আরও একটা সমস্যায় পড়েছিলেন নীরজ। জ্যাভলিন ছোড়ার মুহূর্তে তাঁর সামনের হাঁটু একটু বেঁকে যাচ্ছিল, যে কারণে জোরটা সে ভাবে পাচ্ছিলেন না। তাই নজর দিয়েছিলেন হাঁটু ‘ব্লক’ করার দিকে। অর্থাৎ, ছোড়ার মুহূর্তে সামনের পা সোজা থাকবে।
২০২২ সালে এশিয়ান গেমসেও সোনা জিতেছিলেন নীরজ। কিন্তু ফাইনালে বিতর্ক হয়েছিল। নীরজ প্রথম থ্রোয়ে কত দূরে জ্যাভলিন ছুড়েছেন তা মাপা হয়নি। ফলে তাঁকে দ্বিতীয় বার আবার ছুড়তে হয়। ছ’বারের বদলে সাত বার জ্যাভলিন ছোড়েন নীরজ। এই নিয়ে আয়োজকদের সঙ্গে তর্কেও জড়ান তিনি। নীরজের মনে হয়েছিল, ইচ্ছাকৃত ভাবে এই ঘটনা ঘটেছে। কারণ, প্রথম থ্রোয়ে সবচেয়ে বেশি জোর দেন ক্রীড়াবিদেরা। নীরজও ভাল দূরেই ছুড়েছিলেন। কিন্তু তা মাপা হয়নি। তাতে অবশ্য তাঁর সোনা জেতা আটকায়নি।
চলতি বছরের গোড়ার দিকে জ়ুরিখে রজার ফেডেরারের সঙ্গে দেখা হয়েছিল নীরজের। ২০ গ্র্যান্ড স্ল্যামের মালিকের সঙ্গে বেশ কিছু ক্ষণ কথা বলেন তিনি। কী ভাবে দীর্ঘ দিন ফেডেরার সর্বোচ্চ পর্যায়ে টেনিস খেলেছেন তার রহস্য জানতে চেয়েছিলেন তিনি। ফেডেরারের সঙ্গে কথা বলার পরে আত্মবিশ্বাস আরও বেড়ে যায় নীরজের।
প্যারিস অলিম্পিক্সের আগে নীরজের লক্ষ্য ছিল ৯০ মিটারের বেশি ছোড়া। কিছুতেই তা হচ্ছিল না। তিনি প্যারিসে পদক জেতার দিকে এতটাই গুরুত্ব দিয়েছিলেন যে এই বছর খুব কম প্রতিযোগিতায় নেমেছেন। চোটের দিকে নজর দিয়েছেন। প্রয়োজনীয় বিশ্রাম নিয়েছেন। কঠোর অনুশীলন করেছেন। গত বার সোনা জেতায় এ বারের অলিম্পিক্সের উদ্বোধনে পতাকাবাহক হওয়ার কথা ছিল নীরজের। কিন্তু প্যারিসে অলিম্পিক্সের উদ্বোধনে তিনি ছিলেন না। সেই সময় প্যারিস থেকে ৩৪৫৩ কিলোমিটার দূরে আন্টালিয়ায় প্রশিক্ষণ নিচ্ছিলেন। পেশির শক্তিবৃদ্ধির দিকে নজর দিয়েছিলেন। নিজের ইভেন্টের আগে প্যারিসে যান নীরজ।
এ বার নীরজকে সাহায্য করেছে প্যারিস স্তাদ দ্য ফ্রাঁসের বিশেষ বেগনি রঙের ‘মোন্ডো’ ট্র্যাক। এই ট্র্যাকে দু’টি স্তর রয়েছে। প্রথমে রবার রয়েছে। এর ফলে পায়ের গ্রিপ শক্ত হবে, অর্থাৎ পা পিছলে যাবে না। নমনীয়তাও রয়েছে। রবারের স্তরের নীচে বায়ুভর্তি গহ্বর রয়েছে। সেগুলি লাফানোর অভিঘাত সামলাতে সাহায্য করবে এবং ভারসাম্য ধরে রাখার কাজ করবে। সেরা ট্র্যাক অ্যান্ড ফিল্ড ক্রীড়াবিদদের পরামর্শ নিয়ে এই ট্র্যাক তৈরি হয়েছে। নীরজ ইউরোপীয় সার্কিটে অনুশীলন করে অভিজ্ঞ। তিনি ‘পাওয়ার থ্রোয়ার’ নন। অর্থাৎ, বর্শা ছোড়ার জন্য শরীরের উপরিভাগের বড় পেশির উপর পুরোপুরি নির্ভর করেন না। তিনি ট্র্যাকে দৌড়নোর সময়েও শক্তি সংগ্রহ করেন। এমন ভাবে শরীর নিয়ন্ত্রণ করেন, যাতে সব শক্তি কাজে লাগিয়ে বেশি দূরে ছুড়তে পারেন। মোন্ডো ট্র্যাকের গ্রিপ সাহায্য করে নীরজকে।
প্যারিসেও নীরজের কাছে সোনার আশা ছিল দেশবাসীর। কিন্তু সোনা জিততে পারলেন না তিনি। তবে তিনিই ভারতের প্রথম খেলোয়াড় যিনি অলিম্পিক্সে একটি সোনা ও একটি রুপো জিতেছেন।