কুস্তিকে বিদায় জানালেন বিনেশ ফোগাট। ছবি: রয়টার্স।
বুধবার রাতে জানা গিয়েছিল, রুপোর দাবি নিয়ে আন্তর্জাতিক ক্রীড়া আদালতের দ্বারস্থ হয়েছেন কুস্তিগির বিনেশ ফোগাট। প্যারিস অলিম্পিক্স থেকে তাঁকে বাতিল করার সিদ্ধান্ত মেনে নিতে পারেননি তিনি। আন্তর্জাতিক আদালতের রায় ঘোষণার আগেই বৃহস্পতিবার ভোরে অবসর ঘোষণা করলেন বিনেশ। জানিয়ে দিলেন, তিনি হেরে গিয়েছেন কুস্তির কাছে।
নিজের এক্স (সাবেক টুইটার) হ্যান্ডলে বিনেশ লেখেন, “মা, কুস্তির কাছে আমি হেরে গেলাম। আমাকে ক্ষমা কোরো। তোমার স্বপ্ন, আমার সাহস সব শেষ হয়ে গিয়েছে। আর শক্তি বাকি নেই। কুস্তি, তোমাকে বিদায়। ২০০১-২০২৪। সবসময় তোমার ঋণী হয়ে থাকব। ক্ষমা করে দিও।”
মঙ্গলবার অলিম্পিক্সে মহিলাদের ৫০ কেজি বিভাগে ফাইনালে ওঠেন বিনেশ। আশা ছিল, সোনা জিতবেন তিনি। প্যারিস থেকে ভিডিয়ো কলে মাকে জানিয়েছিলেন, সোনা জিতেই ফিরবেন। কিন্তু বুধবার সকালে ছবিটা পুরো বদলে যায়। ভারতীয় অলিম্পিক্স সংস্থা জানিয়ে দেয়, ১০০ গ্রাম ওজন বেশি হওয়ায় বাতিল করা হয়েছে বিনেশকে। পরে জানা যায়, ২ কেজি ওজন বেড়ে গিয়েছিল তাঁর। ওজন কমাতে সারা রাত পরিশ্রম করেছিলেন। চুল কেটে ফেলেন। শরীর থেকে রক্ত বার করেন। তার পরেও ১০০ গ্রাম ওজন বেশি হয়ে যায়। শরীরে জলের ঘাটতি হওয়ায় অসুস্থ হয়ে পড়েন বিনেশ। হাসপাতালে ভর্তি করাতে হয় তাঁকে।
ভারতীয় কুস্তি সংস্থা বিনেশের বিষয়ে আন্তর্জাতিক অলিম্পিক্স সংস্থার কাছে আবেদন করে। কিন্তু আন্তর্জাতিক সংস্থা জানিয়ে দেয়, নিয়ম সকলের জন্য সমান। তার পরেও হাল ছাড়েননি বিনেশ। আন্তর্জাতিক ক্রীড়া আদালতে রুপোর দাবিতে মামলা করেন তিনি। বৃহস্পতিবার সেই মামলার রায় ঘোষণা হওয়ার কথা। তার আগেই অবশ্য কুস্তি থেকে অবসর ঘোষণা করলেন বিনেশ।
বুধবার ঘটনার পর প্রথমে বোঝা যায়নি এতটা ভেঙে পড়েছেন বিনেশ। ভারতীয় অলিম্পিক্স সংস্থার প্রধান পিটি ঊষা যখন হাসপাতালে তাঁর সঙ্গে দেখা করেছিলেন, তখনও মনে হয়েছিল তিনি নিজেকে সামলে নিয়েছেন।
বিনেশের কোচ বীরেন্দ্র দাহিয়া ও মনজিৎ রানিও হাসপাতালে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন। তাঁদের সঙ্গে কথা বলেন বিনেশ। ছাত্রী কী বলেছেন তা পরে সংবাদ সংস্থা পিটিআইকে জানান বীরেন্দ্র। তিনি বলেন, “গোটা কুস্তি দলের কাছে এটা বড় ধাক্কা। খবরটা শোনার পরে সব মেয়েই হতাশ হয়ে পড়েছিল। আমরা বিনেশের সঙ্গে দেখা করেছি। ও খুব সাহসী। ও আমাদের বলেছে, ‘ভাগ্যটাই খারাপ যে পদক হাতছাড়া হল। তবে এই সব খেলারই অঙ্গ।’ ভারতীয় অলিম্পিক্স সংস্থার অনেক আধিকারিকও বিনেশের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন।”
তার পরেই সিদ্ধান্ত হয়েছিল, আন্তর্জাতিক আদালতে আবেদন করা হবে। বিনেশের দাবি ছিল, মঙ্গলবার ফাইনাল পর্যন্ত পৌঁছেছিলেন তিনি। তখন ওজন নিয়ে কোনও সমস্যা ছিল না। তা হলে ফাইনালে না খেলতে পারায় তাঁকে অন্তত রুপো দেওয়া উচিত। বৃহস্পতিবার এই আবেদনের সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা আন্তর্জাতিক ক্রীড়া আদালতের।
কুস্তিতে ৫০ কেজি বিভাগ বিনেশের ইভেন্টই নয়। তাঁর আসল ইভেন্ট ৫৩ কেজি বিভাগ। কিন্তু দিল্লির রাস্তায় আন্দোলনে শামিল হওয়া বিনেশ ৫৩ কেজির ট্রায়ালে যেতেই পারেননি। তাঁর বদলে অলিম্পিক্সের ৫৩ কেজি বিভাগে যোগ্যতা অর্জন করেন অন্তিম পঙ্ঘাল। বিনেশকে তার পর বলা হয়েছিল, তিনি যদি ট্রায়ালে পঙ্ঘালকে হারাতে পারেন, তা হলে তাঁকে পছন্দের ৫৩ কেজিতে নামতে দেওয়া হবে। কিন্তু কুস্তি থেকে দূরে থাকার জন্য স্বাভাবিক ভাবেই বিনেশ সেই ট্রায়ালে হেরে যান। শেষ পর্যন্ত তাঁকে বেছে নিতে হয়েছিল ৫০ কেজি বিভাগ।
বুধবার সকালে জানা যায়, ৫০ কেজি বিভাগের ফাইনালে নামতে পারবেন না বিনেশ। ১০০ গ্রাম ওজন বেশি হয়েছে তাঁর। ভারতীয় অলিম্পিক্স সংস্থা একটি বিবৃতিতে বলে, “অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে ভারতীয় দলের পক্ষ থেকে জানানো হচ্ছে যে, কুস্তিতে মহিলাদের ৫০ কেজির ফাইনাল থেকে বিনেশ ফোগাট বাতিল হয়ে গিয়েছে। ভারতীয় দলের পক্ষ থেকে সারা রাত ধরে চেষ্টা করা হয়েছিল বাড়তি ওজন কমানোর। কিন্তু আজ সকালে ৫০ কেজির থেকে কিছু গ্রাম বেশি ওজন হয়েছে ওর। এখনই ভারতীয় দলের পক্ষ থেকে এর বেশি কিছু জানানো হবে না।”
মঙ্গলবার সেমিফাইনালে জিতে ফাইনালে উঠেছিলেন বিনেশ। ৫০ কেজি বিভাগে খেলতে নামা বিনেশের ওজন প্রায় ২ কেজি বেড়ে গিয়েছিল। সারা রাত ধরে ওজন কমানোর চেষ্টা করেছিলেন বিনেশ। জগিং, স্কিপিং এবং সাইক্লিং করেছিলেন সারা রাত। ওজন কমানোর জন্য ঘাম ঝরাচ্ছিলেন। চুলও কেটে ফেলেছিলেন তিনি। রক্ত বার করেছিলেন। তাতে অনেকটাই ওজন কমিয়ে ফেলেছিলেন বিনেশ। কিন্তু বুধবার সকালে যখন ওজন মাপা হয়, দেখা যায় ৫০ কেজির থেকে কয়েক গ্রাম বেশি ওজন তাঁর। সেই কারণেই প্রতিযোগিতা থেকে বাতিল করে দেওয়া হয় বিনেশকে।
বিনেশের ওজন কেন কমানো গেল না তা নিয়ে মুখ খোলেন ভারতের চিফ মেডিক্যাল অফিসার দীনশ পারদিওয়ালা। তিনি বলেন, “কুস্তিগিরদের একটা সুবিধা থাকে। খুব দ্রুত ওজন কমাতে-বাড়াতে পারে তারা। বিনেশের ক্ষেত্রেও ওজন কমানো হয়েছিল। ৫৩ কেজির বদলে ৫০ কেজি বিভাগে নেমেছিল ও। কিন্তু খুব বেশি ওজন কমাতে গেলে অনেক সময় শরীর দুর্বল হয়ে যায়। তাতে হিতে বিপরীত হতে পারে। তাই কুস্তিগিরেরা কিছু এনার্জি বাঁচিয়ে রাখে। খুব অল্প পরিমাণ জল ও হাই এনার্জি খাবার খেতে হয় তাদের। ওজন মাপার পরে এই খাবার কুস্তিগিরেরা খায়।” বিনেশের পুষ্টিবিদের সঙ্গে কথা বলেই সব কিছু করা হয়েছিল বলে জানিয়েছেন দীনশ। তিনি বলেন, “বিনেশকে এক দিনে তিনটে ম্যাচ খেলতে হয়েছিল। তাই ওকে পর্যাপ্ত খাবার খেতে হয়েছিল। তাতে বিনেশের ওজন একটু বেশিই বেড়ে গিয়েছিল। ওর পুষ্টিবিদ জানিয়েছিলেন, দেড় কেজি পুষ্টি থাকলেই বিনেশ খেলতে পারবে। সেটা মাথায় রেখেই আমরা ওর ওজন কমানোর চেষ্টা করেছিলাম।”
রুপোর আবেদন করা হলেও ইউনাইটেড ওয়ার্ল্ড রেস্টলিংয়ের (ইউডব্লিউডব্লিউ) সভাপতি নেনাদ লালোভিচ মোটামুটি বলেই দেন, তাতে খুব একটা লাভ হবে না। তিনি বলেন, ‘‘আমাদের সকলের উচিত নিয়মকে মান্য করা। যা ঘটেছে, তা অত্যন্ত দুঃখজনক। বিনেশের জন্য আমারও খারাপ লাগছে। ওর ওজন সামান্য বেশি ছিল। কিন্তু নিয়ম তো নিয়মই। সব কিছুই পরিষ্কার। সবার সামনে সব কিছু হয়েছে। সেখানে অন্য খেলোয়াড়েরাও ছিল। অনুমোদিত ওজন বজায় রাখতে ব্যর্থ এক জনকে কী করে অনুমতি দেওয়া যায়? প্রতিযোগিতা নিয়ম অনুযায়ী চলবে।’’ বিনেশ ফাইনালে উঠেছিলেন সব নিয়ম মেনেই। তা হলে কি তাঁকে অন্তত রুপোর পদক দেওয়া যায় না? লালোভিচ বলেছেন, ‘‘অসম্ভব। এ ভাবে পদক দেওয়ার কোনও সুযোগ নেই। ওজনের জন্য ও অন্য ক্যাটেগরিতে চলে যাচ্ছে। আমরা কেউ নিয়মের বাইরে যেতে পারি না। সবাইকে এক নিয়ম মেনে চলতে হয়। এ রকম ক্ষেত্রে সকলেই একটা শেষ চেষ্টা করে। ভারতও আবেদন করেছে। কিন্তু তাতে কিছু বদল হওয়া সম্ভব নয়।’’