Oinam Bembem Devi

বাবার ভয়ে নাম বদলেছিলেন বেমবেম

মণিপুরের ইম্ফলে জন্ম বেমবেমের। ছোটবেলা থেকেই ফুটবলার হওয়ার স্বপ্ন দেখতেন। কিন্তু বেমবেমের বাবা চাইতেন, মেয়ে লেখাপড়া করে প্রতিষ্ঠিত হোক। বাবার ভয়েই নাম বদলে ফেলেছিলেন ভারতীয় ফুটবলের ‘দুর্গা’।

Advertisement

শুভজিৎ মজুমদার

কলকাতা শেষ আপডেট: ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২০ ০৪:৩৯
Share:

শিক্ষক: নতুন প্রজন্মকে ফুটবলের পাঠ দিচ্ছেন বেমবেম। নিজস্ব চিত্র

ভারতের প্রথম মহিলা ফুটবলার হিসেবে পদ্ম সম্মান পেতে চলেছেন তিনি। সেই ওয়িনাম বেমবেম দেবীকেই ফুটবল খেলার জন্য শৈশবে পরিচয় গোপন করতে হয়েছিল!

Advertisement

মণিপুরের ইম্ফলে জন্ম বেমবেমের। ছোটবেলা থেকেই ফুটবলার হওয়ার স্বপ্ন দেখতেন। কিন্তু বেমবেমের বাবা চাইতেন, মেয়ে লেখাপড়া করে প্রতিষ্ঠিত হোক। বাবার ভয়েই নাম বদলে ফেলেছিলেন ভারতীয় ফুটবলের ‘দুর্গা’। পদ্ম সম্মানের জন্য তাঁর নাম ঘোষণার খবর শুনে স্মৃতির সরণি ধরে হাঁটতে শুরু করলেন বেমবেম। ইম্ফল থেকে ফোনে আনন্দবাজারকে বললেন, ‘‘ইম্ফলে যে অঞ্চলে আমাদের বাড়ি, সেখানে মেয়েদের মধ্যে ফুটবল নিয়ে আগ্রহ ছিল না। কিন্তু আমার প্রিয় খেলা ছিল ফুটবলই। তাই ছেলেদের সঙ্গেই শুরু করেছিলাম খেলা। আমার বয়স তখন ছয় অথবা সাত। এক দিন বাবা দেখে ফেললেন খেলতে। বাড়িতে ফেরার পরে আমাকে ডেকে বলেছিলেন, মন দিয়ে লেখাপড়া করো। আর যেন তোমাকে ছেলেদের সঙ্গে ফুটবল খেলতে না দেখি।’’

খেলা বন্ধ করে দিলেন? হাসতে হাসতে বেমবেম বললেন, ‘‘একেবারেই না। বাবা অফিসের জন্য বাড়ি থেকে বেরোনোর সঙ্গে সঙ্গে মাঠে চলে যেতাম। ছেলেদের মতো ছোট ছোট করে চুল কেটে ফেলেছিলাম। যাতে কেউ চিনতে না পারে। শুধু তাই নয়। নিজের নামও বদলে ফেলেছিলাম।’’ মানে? বেমবেম শোনালেন আশ্চর্য কাহিনি, ‘‘ইম্ফলে পাড়ায় পাড়ায় প্রচুর প্রতিযোগিতা হয়। বেমবেম নামে খেললে বাবার কানে খবর পৌঁছবেই। তাই কখনও আমার নাম হত বোবো। কখনও আবার আমকো। আরও নাম ছিল। এখন সবগুলো মনে পড়ছে না।’’

Advertisement

নামকরণ করতেন কে? হাসতে হাসতে বেমবেম বলছিলেন, ‘‘আমি নিজেই নিজের নামকরণ করতাম। তা ছাড়া নাম বদলের আরও একটা কারণ ছিল।’’ ভারতীয় মহিলা ফুটবল দলের প্রাক্তন অধিনায়ক যোগ করলেন, ‘‘ভয় ছিল, মেয়ে বলে হয়তো প্রতিযোগিতায় আমাকে খেলতে দেওয়া হবে না। তাই বেছে বেছে ছেলেদের নামই রাখতাম। এই ভাবেই চার-পাঁচ বছর খেলা চালিয়ে গিয়েছিলাম।’’ আপনার মা-ও কি ফুটবল খেলতে বারণ করতেন? ‘‘একেবারেই না। মা বরং আমাকে উৎসাহ দিতেন। মাঝেমধ্যে বাবা তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে আসতেন। আমি কোথায় জিজ্ঞেস করলে মা বলতেন, বন্ধুর বাড়ি পড়তে গিয়েছি। যদিও বাবা বিশ্বাস করতেন না। আমার জন্য মাকে অনেক বার বকুনি খেতে হয়েছে। মাকে বলতেন, মেয়ের এ রকম সর্বনাশ কেন করছ?’’

বেমবেমের জীবন বদলে যেতে শুরু করে নব্বইয়ের দশকে। বলছিলেন, ‘‘১৯৯১ সালে ইম্ফলের একটি ক্লাব আমাকে খেলার প্রস্তাব দেয়। বাবার আপত্তি সত্ত্বেও ওদের হয়ে খেলতে শুরু করি। সে বছরই মণিপুর জুনিয়র দলের ট্রায়ালে আমি ডাক পাই এবং নির্বাচিত হই। বাবার মনোভাবও বদলাতে শুরু করে। আমাকে বলেছিলেন, খেলার সঙ্গে সঙ্গে লেখাপড়াও চালিয়ে যেতে হবে।’’ তিনি যোগ করলেন, ‘‘বছর তিনেক পরে ওড়িশার ভদ্রকে সর্বভারতীয় ফুটবল ফেডারেশনের একটি প্রতিযোগিতায় নজর কাড়ি। ডাক পাই মণিপুরের সিনিয়র দলে। পরের বছরই ভারতের সিনিয়র দলে অভিষেক হয় আমার। টানা ২১ বছর খেলার পরে অবসর নিই।’’ মেয়ের সাফল্য অবশ্য দেখে যেতে পারেননি বেমবেমের বাবা। প্রাক্তন ভারত অধিনায়ক বলছিলেন, ‘‘বাবা বলেছিলেন, ম্যাট্রিক পাশ করলেই আমার চাকরির ব্যবস্থা করে দেবেন। কিন্তু পরীক্ষা শুরুর আগের দিন প্রয়াত হন। বেঁচে থাকলে বাবাকে বলতাম, তোমার মেয়ে ঠিক সিদ্ধান্তই নিয়েছিল।’’ বেমবেম উচ্ছ্বসিত বালা দেবী স্কটল্যান্ডের রেঞ্জার্সে সুযোগ পাওয়ায়। বলছিলেন, ‘‘আমি মলদ্বীপের ক্লাবে দীর্ঘ দিন খেলেছি। কিন্তু বালা অসাধ্যসাধন করেছে। আশা করছি, রেঞ্জার্সেও সফল হবে।’’

অবসরের পরেও বেমবেমের জীবন জুড়ে শুধুই ফুটবল। আর তাই বিয়ে না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এই মুহূর্তে মণিপুর পুলিশের মহিলা ফুটবল দলে কোচিং করাচ্ছেন তিনি। খুঁজছেন ভবিষ্যতের বেমবেম। বলছিলেন, ‘‘বিয়ে করা মানেই তো ফুটবল থেকে দূরে সরে যাওয়া। আমার পক্ষে তা সম্ভব নয়। ফুটবল ছাড়া আমি বাঁচব না।’’

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement