রবিবার জয়দীপ দিল্লি যাচ্ছেন জাতীয় দলে যোগ দিতে। —নিজস্ব চিত্র
খেলোয়াড় হিসেবে শ্যুটিং জীবনের ইতি। কোনও প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার আগেই জানিয়ে দিলেন জয়দীপ কর্মকার। রবিবার দিল্লি যাচ্ছেন জাতীয় দলে যোগ দিতে। অলিম্পিক্সে চতুর্থ হওয়া জয়দীপ এখন থেকে জাতীয় রাইফেল দলের কোচ। নতুন শ্যুটারদের তুলে আনা এবং তাঁদের হাতে পদক দেখার আশা নিয়েই শুরু জয়দীপ ২.০ এর যাত্রা। শনিবার সাংবাদিক সম্মেলনে বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দিলেন তিনি।
প্রশ্ন: ভারতীয় রাইফেল দলের কোচ হওয়ার জন্য অভিনন্দন। নতুন ইনিংস শুরু?
জয়দীপ: হ্যাঁ। খেলোয়াড় জীবন থেকে অবসর নিলাম। অনেক দিন খেলছি না এটা ঠিক, তবে সরকারি ভাবে এটাই প্রথম বার ঘোষণা করছি। খেলোয়াড় জীবনে নিজের ১০০ শতাংশ দিয়েছি। কাল থেকে নতুন জীবন শুরু। এখন অনেকের দায়িত্ব আমাকে নিতে হবে।
প্রশ্ন: টোকিয়ো অলিম্পিক্সে ভারতীয় শ্যুটারদের খারাপ ফলের পর কোচ হিসেবে আনা হচ্ছে আপনাকে। পরের অলিম্পিক্সে আপনার উপর অনেক বেশি আশা থাকবে কিন্তু।
জয়দীপ: ভারতীয় শ্যুটাররা কিন্তু অলিম্পিক্সের আগে অনেক পদক পেয়েছে। টোকিয়োতে গিয়ে খেই হারিয়ে ফেলল তারা। আমরা ভেবেছিলাম অনেক পদক আসবে। কিন্তু সেটা হল না। আমার মনে হয় শ্যুটারদের পদক জয়ের খিদেটা মরে গিয়েছিল। শ্যুটারদের মনে করানো হয়েছিল অলিম্পিক্স আরেকটা খেলা। বিশ্বকাপে যেমন খেলছ, তেমনটাই খেলতে হবে। আমার মনে হয় বেশি পরিমাণে অনুশীলন করেছিল। যার ফলে অলিম্পিক্সে ভাল ফল পাইনি। ও ভাবে হয় না।
২০১২ সালে লন্ডন অলিম্পিক্সে চতুর্থ হয়েছিলেন জয়দীপ। —ফাইল চিত্র
প্রশ্ন: কাল থেকে তো আপনার দায়িত্বে থাকবে ভারতীয় দল। কী পরিবর্তন আনতে চাইবেন?
জয়দীপ: জাতীয় দলে যারা খেলবে সেই শ্যুটারদের দক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে না। তারা শিখেছে, নিজেদের প্রমাণ করতে পেরেছে, পয়েন্ট আছে, তাই জাতীয় দলের হয়ে খেলবে। আমার লক্ষ্য থাকবে ওদের মানসিকতায় বদল আনা। সেই দিকে নজর দেওয়ার চেষ্টা করব আমি।
প্রশ্ন: জাতীয় দলে কি তা হলে মনোবিদ, চিকিৎসকদের গুরুত্ব বাড়বে আপনার সময়ে?
জয়দীপ: তিন সপ্তাহ আগে আমার সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়। সেখানে আমি জাতীয় দলে কিছু ক্ষেত্রে পারদর্শীদের নেওয়ার কথা জানিয়েছি। আমার কাজের সুবিধার জন্যই সেটা আমি বলেছি। কাদের নেওয়া হবে সেটা আমি জানি না। ফেডারেশনই বলতে পারবে। এখনও কোনও মনোবিদকে নেওয়া হয়েছে বলে জানি না। একজন হাই পারফরমান্স কোচ এবং ম্যানেজার আসছে বিদেশ থেকে। সাপোর্ট স্টাফ কারা আছে সেটা আমি এখনও জানি না।
প্রশ্ন: পরের অলিম্পিক্স প্যারিসে ২০২৪ সালে। আর দু’বছর। প্রস্তুতির জন্য সময়টা খুব কম হয়ে গেল না?
জয়দীপ: ২০২৫ সাল পর্যন্ত আমার দায়িত্ব। সব ঠিক থাকলে ২০২৪ সালে প্যারিস অলিম্পিক্সে আমার উপরেই দায়িত্ব থাকবে। দু’বছরের মধ্যে পরের অলিম্পিক্স। হাতে সময়টা খুব কম। এমন অবস্থায় পৃথিবীর কেউই আগে পড়েনি। কোচ হিসেবে আমার প্রথম প্রতিযোগিতা অবশ্য বিশ্বকাপ। আজারবাইজানের বাকুতে হবে সেই প্রতিযোগিতা। ২৫ মে থেকে শুরু সেই প্রতিযোগিতা। সেখানে আমি দলকে নিয়ে যাব। সেপ্টেম্বর মাসে এশিয়ান গেমস আছে। আমার মূল লক্ষ্য থাকবে অক্টোবরের বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে। সেখান থেকেই অলিম্পিক্সের যোগ্যতা অর্জন শুরু।
প্রশ্ন: দলে তো একাধিক নতুন মুখ।
জয়দীপ: হ্যাঁ। শুধু আমি নই, এ বারের জাতীয় দলে অনেক নতুন মুখ। টোকিয়ো অলিম্পিক্সে খেলা অপূর্বি চান্ডেলা নেই, দিব্যাংশ সিংহ পানওয়ার নেই। দীপক কুমার বিশ্বকাপে ৫০ মিটার থ্রি পজিশনে খেলবে। এলাভেনিল ভালারিভান খুব ভাল খেলছে। ও বিশ্বকাপে খেলবে। বাংলা থেকে আয়ুষি পোদ্দার, মেহুলী ঘোষ, অভিনব শ আছে। বিশ্বকাপ খেলবে আয়ুষি। এটাই ওর প্রথম বিশ্বকাপ।
প্রশ্ন: খেলোয়াড় জীবনে প্রচুর অভিজ্ঞতা। ১৯৮৯ সাল থেকে খেলছেন। সব চেয়ে ভাল মুহূর্ত কোনটা?
জয়দীপ: ২০১২ লন্ডন অলিম্পিক্সে আমি চতুর্থ হয়েছিলাম। এমনিতেই এমন একটা খেলার সঙ্গে যুক্ত যেটা ভারতে ক্রিকেট বা ফুটবলের মতো জনপ্রিয় নয়। সেই রকম একটা খেলায় পদক না জিতে ফিরেও কলকাতা বিমানবন্দরে যে বিশাল সংখ্যক মানুষ আমাকে স্বাগত জানাতে উপস্থিত ছিলেন, সেটা ভুলতে পারব না। আমার কাছে ওটা আজও স্মরণীয়।
প্রশ্ন: সব চেয়ে খারাপ মুহূর্ত মনে হয় অলিম্পিক্সে একটুর জন্য পদক হাত ছাড়া হওয়া?
জয়দীপ: হ্যাঁ। মনিটারে যখন দেখলাম আমি চার নম্বরে, সেই মুহূর্তে খুব খারাপ লেগেছিল। ওটা ভোলা যাবে না। তবে তার পরের একটি ঘটনা অনেকে জানেন না। যেখানে পদক দেওয়া হচ্ছিল আমি হেরে যাওয়ার কিছু ক্ষণ পর সেই জায়গাটায় গিয়েছিলাম। সেখানে বিজয় কুমার রুপো জিতল। ওকে যখন পদক নিতে দেখি, আমি ভেঙে পড়েছিলাম। আমার কান্না থামছিল না। অনেকে এসে আমাকে সান্ত্বনা দিচ্ছিলেন। সেই প্রথম আমি বুঝতে পারলাম যে আমি কী বিরাট জিনিস হারালাম।
প্রশ্ন: এ বার তো আর পদক জয়ের লড়াইয়ে আপনি নেই, পদক জেতানোর লড়াইয়ে নামলেন।
জয়দীপ: আমার কাজটা কঠিন হয়ে গেল। এখন ১২ জনের দলে এক জন পদক জিতলে আমার আনন্দ হবে না। আমাকে খুঁজে বার করতে হবে কেন বাকি ১১ জন পেল না। বিশ্লেষণ করতে হবে। শুধু আমি নই, অনেক শ্যুটারও নতুন। অনেকে প্রথম বার আন্তর্জাতিক মঞ্চে খেলবে। কাজটা খুব সহজ হবে না। আমার কোনও জাদু জানা নেই যে কাল যোগ দেব আর পদক এনে দেব। সেই রুপোলী গুলি আমার কাছে নেই।
প্রশ্ন: নিজের খেলোয়াড় জীবনটা মিস করবেন?
জয়দীপ: আমি অনেক সময় বিশ্বাস করতে পারি না যে আর খেলছি না। রাতের বেলা বন্দুক বার করে গুলি ভরেছি। নিজেকে বিশ্বাস করাতে পারি না। তবে সেটা মেনে নিতে হবে। মেনে নিলেই এগিয়ে যাওয়া যায়।