পারিশ্রমিক বলতে ছিল কয়েকশো টাকা। স্থানীয় ম্যাচে ক্রিকেট খেলার সুবাদে সেই সামান্য কিছু অর্থ আসত ঘরে। এ দিকে ছেলের ক্রিকেট খেলার ‘বিলাসিতা’ বজায় রাখতে গিয়ে নাভিশ্বাস অটোচালকের পরিবারে।
ছেলেকে ক্রিকেট ছাড়ানোর জন্য একসময় প্রাণপণ চেষ্টা করে গিয়েছেন মহম্মদ সিরাজের বাবা-মা। কিন্তু যত তিরস্কৃত হয়েছেন, তত যেন ক্রিকেটকে আঁকড়ে ধরেছেন ভারতের এই নতুন ডানহাতি পেসার। অভাবের সংসারে অবলম্বন করেছেন ক্রিকেটকেই। পরে অবশ্য ছেলের স্বপ্নপূরণে প্রাণপাত পরিশ্রম করেন সিরাজের বাবা।
ক্রিকেটও অবশ্য ফিরিয়ে দিয়েছে তাঁকে। ক্রিকেটের হাত ধরেই এসেছে যশ, খ্যাতি ও অর্থ। ৩ বছর আগে আইপিএল নিলামের শিরোনামে ছিলেন সিরাজ। ২০ লক্ষ টাকা বেসপ্রাইস থাকা সিরাজকে ২ কোটি ৬০ লক্ষ টাকায় কিনে নেয় সানরাইজার্স হায়দরাবাদ। অটোচালকের সন্তানের আইপিএল নিলামের হাত ধরে ক্রিকেটের গলি থেকে রাজপথে উঠে আসার কাহিনি ছড়িয়ে পড়ে দ্রুত।
১৯৯৪ সালের ১৩ মার্চ হায়দরাবাদে জন্ম সিরাজের। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে আত্মপ্রকাশ ২০১৫ সালে। সে বছর হায়দরাবাদের হয়ে রঞ্জি ট্রফিতে খেলেন তিনি। পরের বছর রঞ্জিতে তিনিই ছিলেন হাদরাবাদের হয়ে সর্বোচ্চ উইকেটশিকারি।
রঞ্জি ট্রফি, বিজয় হজারে টুর্নামেন্ট, ইন্ডিয়া এ, ইন্ডিয়া বি দল পেরিয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেক ২০১৭ সালে। নিউজিল্যান্ডের বিরুদ্ধে খেলেন টি-২০ ক্রিকেটে। কিন্তু সেই অভিষেক মধুর ছিল না। রাজকোটে নিউজিল্যান্ডের বিরুদ্ধে টি-টোয়েন্টিতে অভিষেকে চার ওভারে ৫৭ রান দিয়েছিলেন তিনি।
২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে প্রথম সুযোগ টেস্ট দলে। কিন্তু সে বার একটি টেস্টেও খেলেননি। ওয়ানডে ম্যাচে অভিষেক ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে। অ্যাডিলেডে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে প্রথম একদিনের ম্যাচে খেলেন তিনি। কিন্তু সেই অভিজ্ঞতাও ছিল টি-২০ অভিষেকের মতোই তিক্ত।
জীবনের প্রথম ওয়ান ডে ম্যাচে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে সিরাজের ইকনমি রেট ছিল ৭.৬০। বাউন্ডারি খান এক ডজন। তিনটি ওয়াইড বলও করেন। সব মিলিয়ে একেবারেই ভরসা করার মতো পারফরম্যান্স ছিল না।
কিন্তু তার উপর থেকে আস্থা হারাননি বিরাট কোহালি। আইপিএল-এ রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স বেঙ্গালুরুর অধিনায়ক হিসেবে সিরাজের হাতে তুলে দিয়েছেন নতুন বল। আইপিএলে ২১ অক্টোবর কলকাতা নাইট রাইডার্সের বিরুদ্ধে রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স-এর হয়ে দুরন্ত বোলিংয়ে ৮ রানে ৩ উইকেট নেন সিরাজ।
তার আগের দিনই হায়দরাবাদের এক হাসপাতালে ভর্তি হন সিরাজের বাবা। সেই মানসিক প্রতিকূলতার কোনও ছাপ সিরাজের পারফরম্যান্সে ছিল না। তিনি পেশাদারিত্বের সঙ্গে পারফর্ম করেছেন মাঠে।
আরও এক বার সেই পেশাদারিত্বের পরীক্ষা দিতে হল সিডনিতে বসে। ২০২০ সালের অক্টোবরে তিনি সুযোগ পান অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে টেস্ট সিরিজে। গত ২০ নভেম্বর সিডনিতে অনুশীলনের পর প্রধান কোচ রবি শাস্ত্রী ও অধিনায়ক বিরাট কোহালির কাছে বাবার মৃত্যুর খবর শোনেন সিরাজ। করোনা অতিমারির ফলে কোয়রান্টিন নিয়মের কারণে বাবার শেষকৃত্যে যোগ দিতে পারেননি এই ডানহাতি পেসার।
পরে সংবাদ মাধ্যমকে জানান, মনের দিক দিয়ে শক্ত থাকার জন্য তাঁর পাশে ছিলেন প্রধান কোচ এবং অধিনায়ক। তাঁদের বিশ্বাসের মর্যাদা রাখার জন্য মরিয়া ছিলেন সিরাজও। একইসঙ্গে মনের মধ্যে ছিল পরিবারের স্বার্থত্যাগের কথাও।
ক্রিকেটের নেশার জন্য মা বকাবকি করলেও হাল ছাড়তে নারাজ ছিলেন সিরাজের বাবা মহম্মদ ঘউস। ছেলের স্বপ্নপূরণের জন্য দিনভর কঠোর পরিশ্রম করতেন। অতিরিক্ত ভাড়া খাটতেন যাতে ছেলের ক্রিকেট প্রশিক্ষণ বন্ধ না হয়ে যায়।
টেনিস বলের ক্রিকেটে একাধিক ম্যাচ জেতানোর পরে স্থানীয় কোচিং ক্যাম্পের সেই প্রশিক্ষণে সিরাজকে ভর্তি করে দেন তাঁর বাবা-ই। অর্থাভাবে সেই কোচিং সেন্টারের খরচ চালানোও সম্ভব হত না। কিন্তু ছোটবেলার কোচ কে সাইবাবা খুদে পেসারের প্রতিভা দেখে বিনামূল্যে প্রশিক্ষণ দিতে রাজি হয়ে যান।
তাঁদের সকলের অবদান স্মৃতিতে ঘুরপাক খাচ্ছিল বক্সিং ডে-তে জীবনের প্রথম টেস্টে নামার আগে। মনে পড়েছিল, অনূর্ধ্ব-১৯ প্রতিযোগিতায় নামার আগে জুতো ছিল না সিরাজের কাছে। অটোচালক বাবা সারা রাত ধরে অটো চালিয়ে প্রথম জুতো কিনে দেন। সেই জুতো পরে পাঁচ উইকেট তুলে নিয়ে বাবার পরিশ্রমকে যথার্থ সম্মান জানান তিনি।
বাবার স্বপ্নপূরণের পথেই জানতে পেরেছেন তাঁর চলে যাওয়ার খবর। অস্ট্রেলিয়ার মাটিতেই অজিদের হারিয়ে ভারতের জয়ের অংশীদার হয়েছেন তিনি। কুর্নিশ জানিয়েছেন কাছের মানুষের আত্মত্যাগকে।
একইসঙ্গে নিজেও অংশীদার হয়ে থাকলেন কুর্নিশযোগ্য পারফরম্যান্সের। প্রথম ভারতীয় বোলার হিসেবে অভিষেক ম্যাচে অস্ট্রেলিয়ার মাঠে ৫ উইকেট নেওয়ার এলিট তালিকায় ঢুকে পড়লেন তিনি। শ্রীলঙ্কার পেসার লাসিথ মালিঙ্গা ২০০৪ সালে অভিষেক ম্যাচ খেলেছিলেন অস্ট্রেলিয়ায়। সেই ম্যাচে ২ ইনিংস মিলিয়ে তিনি নেন ৬ উইকেট। সিরাজ নিলেন ৫টি।
প্রথম ইনিংসে সিরাজের শিকার ছিলেন মার্নাস লাবুশানে এবং ক্যামরন গ্রিন। দ্বিতীয় ইনিংসে সিরাজ তুলে নেন ট্রাভিস হেড, গ্রিন এবং নাথান লায়নের উইকেট। মেলবোর্নে দ্বিতীয় ইনিংসে উমেশ যাদব মাত্র ৩.৩ ওভার বোলিং করে মাঠ ছাড়তে বাধ্য হন। ভারতের পেস অ্যাটাকের দায়িত্ব এসে পড়ে বুমরা এবং সিরাজের ওপর। তাঁদের গতি ও নৈপুণ্যই ভারতের জয়ের অন্যতম কারিগর। সিরাজ জানিয়েছেন, আইপিএল-এর সাফল্যই জাতীয় দলে খেলার আত্মবিশ্বাস দিয়েছে তাঁকে।
ছোটবেলায় ভাল জুতো কেনার সামর্থ্য ছিল না। সেই অতীতটা সঙ্গে নিয়েই এখন আরও শক্ত করে বাঁধছেন দামি জুতোর ফিতে। ভবিষ্যতে আরও অনেক দূর যেতে চান নিজামের দেশের এই তরুণ তুর্কি।