সমর্থন: খেলা শেষে ভক্তদের সঙ্গে হাত মেলাচ্ছেন মেহতাব। ফাইল চিত্র
চার বছর মোহনবাগানে খেলে শেষ পর্যন্ত অবহেলা পেয়ে যখন ইস্টবেঙ্গলে এলাম তখন একটা লড়াই যেন নিজের সঙ্গেই লড়তে শুরু করেছিলাম। তাহলে, আমাকে বুঝিয়ে দিতে হবে, আমিকে!
লাল-হলুদ ড্রেসিং রুমের পরিবেশের সঙ্গে আমার মনোভাবের একটা অদ্ভুত মিল খুঁজে পেতাম। ‘হার’ শব্দটা আমার কাছে সবসময়ই ‘বিষ’-এর মতো। ছোটবেলা থেকে আমি ইস্টবেঙ্গল সমর্থকদের মতোই কিছুতেই হার মানব না, এই মনোভাব নিয়ে মাঠে নেমেছি। মাঠে নামব, কিন্তু জিতে ফিরব না, এটা ভাবতেই পারতাম না। সম্ভবত এ জন্যই ফুটবল জীবনের বেশিরভাগটাই আমার কেটেছে এই ক্লাবেই।
চোট সারিয়ে ফিরে খেলতে খেলতেই দল বদল করে চলে এসেছি। আস্তে আস্তে নিজেকে ফিরে পাচ্ছি। সেই সময়েই গুয়াহাটিতে ২০০৯-১০ এর ফেডকাপের সেমিফাইনাল ম্যাচ পড়ল মোহনবাগানের সঙ্গে। কেন জানিনা, খেলা শুরুর দু’দিন আগে থেকেই কেমন যেন একটা জেদ চেপে গেল। এমনিতেই ইস্টবেঙ্গল ড্রেসিংরুম থেকে বেরোনোর সময় যা পরিবেশ থাকে তাতে যে কোনও ফুটবলারের শরীর থেকে বাড়তি একটা অ্যাড্রিনালিন ঝরে। আমারও তাই হত। মোহনবাগানে যেটা তুলনায় কম পেয়েছি।সেদিন বুকে মশাল লাগানো জার্সি পরে নামার সময় মনে হল এটাই নিজেকে প্রমাণ করার সেরা জায়গা। করলামও। আমরা জিতলাম দু’গোলে। একটা গোল করল ইউসেফ ইয়াকুবু, অন্য গোলটা ছিল আমার। চ্যাম্পিয়নও হয়েছিলাম।
ইস্টবেঙ্গল জার্সিতে আইলিগ ছাড়া সব ট্রফি জিতেছি। সাত-সাত বার কলকাতা লিগ জিতে ক্লাবকে ইতিহাসে নিয়ে যাওয়ার একজন সৈনিক হিসাবে নিজেকে প্রমাণ করেছি। তিনবার ফেডারেশন কাপ জিতেছি। সুপারকাপ, আইএফএ শিল্ড জিতেছি। এএফসি কাপের সেমিফাইনাল খেলেছি। কিন্তু যে ট্রফিই পাই না কেন, আমার কাছে ওই ম্যাচের জয় আর মোহনবাগানের বিরুদ্ধে গোল, আমার সতেরো বছরের ফুটবলার জীবনের সেরা ঘটনা।
আমি কলকাতার দুই প্রধানের হয়েই খেলেছি প্রায় ১৪ বছর। তাতে যেমন অসংখ্য আনন্দের মুহূর্ত আছে তেমনই আছে দুঃখের ঘটনাও। যেমন, আমার ইচ্ছে ছিল, লাল-হলুদ জার্সিতে শেষদিন ফুটবল খেলে অবসর নেব।আমি কথাও বলে এসেছিলাম ইস্টবেঙ্গলের শীর্ষকর্তার সঙ্গে। কিন্তু একটা রাত আমার জীবনের সেই ইচ্ছাপূর্ণ করতে দেয়নি। জানিনা সেদিন কী হয়েছিল, কী ঘটেছিল— আমি সিদ্ধান্ত বদল করে চলে গিয়েছিলাম মোহনবাগানে। স্বীকার করছি, ওটা আমার জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল সিদ্ধান্ত। অন্ধকারের রাতও বলতে পারেন। ইস্টবেঙ্গলকর্তা, সদস্য, সমর্থকরা যাঁরা আমাকে ‘মিড ফিল্ড জেনারেল’ বানিয়েছিলেন, আমার খেলোয়াড় জীবনের অসংখ্য গৌরবের সঙ্গী থেকেছেন, তাঁদের বিশ্বাসে আঘাত দেওয়া ঠিক হয়নি। শতবর্ষের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে সেটা আমি স্বীকার করে নিচ্ছি। জীবনে ৬২-৬৩টা ডার্বি খেলেছি। দুই প্রধানের হয়েই বড় ম্যাচে গোল আছে আমার। কিন্তু বলতে বাধা নেই, ইস্টবেঙ্গল তাঁবুর মতো পরিবেশ কোথাও পাইনি। ইস্টবেঙ্গলকে জেতানোর জন্য কখনও মাথায় সাতটা সেলাই, কখনও কপালে পাঁচটা সেলাই নিয়েও খেলেছি। ম্যাচ জিতেছি। ফুটবলার জীবন শেষ হয়ে যাবে জেনেও খেলেছি শুধু লাল-হলুদ জার্সি ভালবেসে। আমার দীর্ঘ ফুটবলার জীবনের সেরা মরসুম ২০১০-১১। সেটাও তো লাল-হলুদ জার্সিতেই। সাত-আটটা ম্যান অব দ্য ম্যাচের ট্রফি, সেরা ফুটবলার, সেরা মিডিও-সহ অসংখ্য পুরস্কার পেয়েছিলাম। ক্লাবকে জিতিয়েছিলাম বহু ট্রফি।
খেলোয়াড়দের জীবনে ওঠা-নামা থাকেই। থাকে চোট-আঘাত। সুসময়, দুঃসময়। আমারও জীবনে তেমনই মুহূর্ত এসেছে বারবার।
যে মরসুমটাতে জীবনের সেরা ম্যাচ খেললাম, তার পরের বছরেই ২০১১-১২ ফেডকাপ ফাইনালে সালগাওকরের বিরুদ্ধে খেলতে নেমে তিন মিনিটের মধ্যেই চোট পেয়ে বসে গিয়েছিলাম। তা নিয়ে সমালোচনার ঝড় বয়ে গিয়েছিল তখন। কেন আমাকে চোট সত্ত্বেও নামানো হয়েছিল তা নিয়ে নানা কথা শুনতে হয়েছিল কোচ ট্রেভর মর্গ্যানকে। সবাই আমাকে কাঠগড়ায় তুলেছিল। খুব যন্ত্রণা হয়েছিল সেদিন। প্রতিদিন ভাবতাম কবে আসবে নিজেকে প্রমাণের সুযোগ। এসে গেল পরের বছরই। ধুন্ধুমার ম্যাচে ৩-২ গোলে ডেম্পোকে হারালাম ফেডকাপেই। খেতাব জিতেছিলাম। ম্যাচের সেরা হয়েছিলাম আমি। সর্ব ভারতীয় পর্যায়ে সেটাই লাল-হলুদের শেষ ট্রফি।
ইস্টবেঙ্গলে আমি বহু দেশি-বিদেশি কোচের কোচিংয়ে খেলেছি। ফিলিপ ডি’ রাইডার, ট্রেভর মর্গ্যান, এলকোস তৌরি, আর্মান্দো কোলাসো, মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য—সবার কাছেই আমি উপকৃত হয়েছি। ওরা আমার উপর আস্থা রেখেছেন। সদস্য-সমর্থকরা ভাবতেন মেহতাব মাঝ মাঠে আছে, আর কোনও চিন্তা নেই। এটা আমার কাছে বিরাট পাওনা। লাল-হলুদ পতাকা আর ওই আওয়াজ আমার কানে সব সময় বাজে। এরকম গ্যালারির সমর্থন পাওয়া যে কোনও ফুটবলারের কাছে ভাগ্যের ব্যাপার। আমি পেয়েছিলাম। তা সত্ত্বেও যতদিন বেঁচে থাকব ততদিন দুটো আক্ষেপ থেকে যাবেই। এক) আইলিগটা জিততে পারলাম না। দুই) লাল-হলুদ জার্সিতে অবসর নেওয়ার স্বপ্ন অপূর্ণই থেকে গেল।