Paris Olympics 2024

জোড়া পদকে নজির মনুর, নায়ক সঙ্গী সরবজ্যোৎ-ও

আর মনু ভাকের? কী ভাবে ব্যাখ্যা করা হবে তাঁর এই সাফল্যকে? বিশেষণের জন্য অভিধান নিয়ে বসতে হবে। অলিম্পিক্সের ইতিহাসে ভারত থেকে আর এক জনই শুধু জোড়া পদক আনতে পেরেছেন। মনে করিয়ে দেওয়া যাক, সেটাও ছিল প্যারিসে।

Advertisement

সুমিত ঘোষ

প্যারিস শেষ আপডেট: ৩১ জুলাই ২০২৪ ০৮:৫২
Share:

মনু ভাকের সঙ্গে সরবজ্যোৎ সিংহ। ছবি: রয়টার্স।

চোখের জলের মধ্যেই কি লুকিয়ে থাকে ভবিষ্যতের স্বপ্নপূরণের হাসি? পিঠ দেখিয়ে কিছু কিছু চলে যাওয়া কি শেষ দৃশ্য নয়? আসলে তা বুক চিতিয়ে ফিরে আসার প্রথম পর্ব হয়ে থাকে?

Advertisement

প্যারিস অলিম্পিক্সে ভারত দ্বিতীয় পদক জেতার দিনে দাঁড়িয়ে তেমনই তো মনে হচ্ছে। এমন দু’জন জুটি বেঁধে দ্বিতীয় ব্রোঞ্জ আনলেন দেশের জন্য, যাঁদের সঙ্গী হয়েছিল কান্না। কিন্তু সেখানেই জীবনকে থেমে যেতে দেননি তাঁরা। লড়াই করে ফিরে এসে হাসি ফোটালেন ১৪০ কোটি ভারতীয়ের মুখে।

টোকিয়োয় মনু ভাকেরের স্বপ্নভঙ্গের কাহিনি সকলেই জেনে গিয়েছেন। ১০ মিটার এয়ার পিস্তলে ব্যক্তিগত ইভেন্টে ব্রোঞ্জ জিতে ভারতকে প্রথম পদক দেওয়া মনু কাঁদতে কাঁদতে টোকিয়োর মঞ্চ থেকে বিদায় নিয়েছিলেন। মঙ্গলবার ব্রোঞ্জ অভিযানে তাঁর সঙ্গী হলেন এমন একজন, যিনি মাত্র তিনদিন আগে এই শাতোরুতেই অল্পের জন্য লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়েছিলেন। মনু যেদিন ১০ মিটার এয়ার পিস্তলে ফাইনালের যোগ্যতা অর্জন করলেন, সেদিনই সরবজ্যোৎ সিংহ চোখ মুছতে মুছতে বেরিয়ে গেলেন। ক্ষুদ্রতমেরও ক্ষুদ্রতম ব্যবধানে তিনি ছিটকে যান ফাইনালের দৌড় থেকে। সেদিন শাতোরুর আকাশের দিকে তাকিয়ে বিষণ্ণ ভাবে তাঁকে বলতে শোনা গিয়েছিল, ‘‘জীবনের প্রথম অলিম্পিক্স। ভালই হল, প্রথম বারেই শিক্ষা পেলাম।’’ কে জানত, মাত্র বাহাত্তর ঘণ্টার মধ্যে পতন থেকে পোডিয়ামে পাল্টে যাবে তাঁর জীবন!

Advertisement

ভারতীয় খেলাধুলোর ইতিহাসে সব চেয়ে সফল জুটি বলতে কারা? সচিন-সৌরভ? বিরাট-রোহিত? লি-হেশ? এ বার থেকে এই তর্ক যখন উঠবে, অলিম্পিক্সকেও তার মধ্যে ধরা হোক। মনু-সরব। জ্বলজ্বল করা উচিত সেরা জুটির তালিকায়। মনে রাখতে হবে দু’জনের বয়স মাত্র ২২। তার মধ্যে কত কিছু দেখা হয়ে গেল! প্যারিসে তরুণ ভারতের উদয় আজ বলা হবে না তো কবে বলা হবে? বিশেষ করে শক্তিশালী কোরিয়াকে ১৬-১০ পয়েন্টে হারানোর পরে। মনুর মা স্কুলের প্রিন্সিপাল। মেয়ের শুটিং রেঞ্জে হাতেখড়ি হয় মায়ের স্কুলেই। সরবজ্যোৎ কৃষক সন্তান। মনু যেমন শুরুতে মার্শাল আর্টসে নাম লিখিয়েছিলেন, সরবজ্যোতের তেমন প্রথম প্রেম ছিল ফুটবল। এক বার শুটিং রেঞ্জে গিয়ে অন্যদের পিস্তল চালাতে গিয়ে শুটার হওয়ার স্বপ্ন তৈরি হয়। গর্বিত ভাবে দু’জনের পাশাপাশি বসে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলার ছবিটা ভারতীয় খেলার জাদুঘরে স্থান পেতে পারে। মনু তখন বলছেন, ‘‘টোকিয়োয় যা ঘটেছিল, তার পর এত কিছু আমার জন্য অপেক্ষা করে আছে, সত্যিই ভাবতে পারিনি। দু’টো পদক পেয়েছি একই অলিম্পিক্স থেকে! মাঝেমধ্যে বিশ্বাসই হচ্ছে না।’’ গলা ধরে এল বোধ হয়। তার মধ্যেই যোগ করলেন, ‘‘ইভেন্টে নামলে একটাই লক্ষ্য থাকে আমার। নিজের সেরাটা দেওয়ার।’’ সরবজ্যোৎকে জিজ্ঞেস করা হল, ব্যক্তিগত ইভেন্টে অল্পের জন্য লক্ষ্যভ্রষ্ট হওয়ার পরে কী ভাবে ফিরে এলেন? জবাব এল, ‘‘কোচের সঙ্গে আলোচনা করেছিলাম কোথায় ভুল হল। নিজের মনে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, স্নায়ু ধরে রাখতেই হবে।’’ কোচের সঙ্গে কী কথা হয়েছিল, ভাঙতে চাইলেন না। ব্যক্তিগত ইভেন্টে শেষের দিকে এসে চাপ সামলাতে পারেননি। এ দিন অন্তিম পর্বে তিনিই ১০.২ স্কোর করে বাজিমাত করলেন। শাহরুখ খানের কী একটা বিখ্যাত সংলাপ ছিল না, ‘‘হার কর জিতনেওয়ালো কো বাজিগর কহতে হ্যায়’’? সরবজ্যোৎ তার জলজ্যান্ত উদাহরণ হয়ে থাকলেন।

আর মনু ভাকের? কী ভাবে ব্যাখ্যা করা হবে তাঁর এই সাফল্যকে? বিশেষণের জন্য অভিধান নিয়ে বসতে হবে। অলিম্পিক্সের ইতিহাসে ভারত থেকে আর এক জনই শুধু জোড়া পদক আনতে পেরেছেন। মনে করিয়ে দেওয়া যাক, সেটাও ছিল প্যারিসে। ১৯০০ সালের গেমসে ২০০ মিটার দৌড় ও ২০০ মিটার হার্ডলসে জোড়া পদক জিতেছিলেন নর্ম্যান প্রিচার্ড। দু’টোই রুপো। তখন ব্রিটিশ আমল এবং অনেক দিন ধরে কেউ জানতই না যে, তিনি কলকাতার বা ভারতের। এখনও কেউ কেউ প্রশ্ন তোলেন, প্রিচার্ডের কলকাতা যোগাযোগ নিয়ে। তাঁদের কে বোঝাবে যে, তিনি সেন্ট জেভিয়ার্সে পড়তেন এবং ১৮৮৯ সালে ট্রেডস কাপে সেন্ট জেভিয়ার্সের হয়ে শোভাবাজারের বিরুদ্ধে প্রথম হ্যাটট্রিকের মালিকও। যদিও প্রিচার্ডের কলকাতা এখন ভারতের অলিম্পিক্স মানচিত্র থেকে মুছে যাওয়ার মুখে। তবু তো ১২৪ বছর পরে প্রিচার্ডের কৃতিত্বকে কেউ স্পর্শ করে দেখালেন। সামান্য তফাত অবশ্য থাকছে। প্রিচার্ডের দু’টো পদকই ছিল ব্যক্তিগত ইভেন্টে। মনুর একটি ব্যক্তিগত ইভেন্টে, অন্যটি দলগত বিভাগে। পাশাপাশি, এটাও বলতে হবে যে, স্বাধীন ভারতে এই কৃতিত্ব আর কারও নেই। ভারতীয়দের মধ্যেও মনুই একমাত্র ক্রীড়াবিদ, যাঁর গলায় জোড়া পদক ঝুলছে। এবং, এখানেই শেষ নয়। এখনও ২৫ মিটার পিস্তলে নামা বাকি। যদি তিনি পদকের হ্যাটট্রিক করে ফেলতে পারেন? সর্বকালের সেরা ভারতীয় ক্রীড়াবিদের তালিকায় স্থান নিশ্চিত।

ইতিহাস সৃষ্টির দিনে মনু জোড়া পদক ভাগ করে নিতে চাইলেন দেশবাসীর সঙ্গে। ‘‘চার বছর ধরে দেশবাসী আমার পাশে থেকেছেন। এই মুহূর্তটা তাঁদের জন্য,’’ যখন বলছেন মনে হচ্ছিল টোকিয়ো থেকে চোখ মুছতে মুছতে বেরিয়ে যাওয়ার ছবিটা কি ইন্টারনেটে এখনও দেখাচ্ছে? ওটাকে যত দ্রুত সম্ভব সরিয়ে দেওয়া হোক। অথবা দু’টো ছবির কোলাজ থাকুক। টোকিয়োর কান্নার পাশে প্যারিসের হাসি। বললেন, সব সময় নীরজ চোপড়া, পি ভি সিন্ধুর মতো ক্রীড়াবিদের থেকে অনুপ্রেরণা নিয়েছেন। যাঁরা অলিম্পিক্সের মতো বিরাট মঞ্চে নিজেদের প্রমাণ করে দেখিয়েছেন।

মঙ্গলবারের পর তিনি নিজেও যে অনুপ্রেরণা হয়ে থাকলেন। অলিম্পিক্সের স্বপ্ন দেখা খুদে প্রতিভারা তাঁর জোড়া পদকের ছবি দেখে টগবগ করে ফুটবে আর বলবে, ‘‘মনু ভাকের করে দেখিয়েছে। আমিও পারব!’’ প্যারিস অলিম্পিক্সে এই মুহূর্তে ভারতের সেরা মুখ অবশ্য মানতে চান না যে, রাতারাতি তিনিও উদাহরণ হয়ে উঠেছেন। ‘‘নীরজ, সিন্ধু ধারাবাহিক ভাবে সফল হয়ে দেখিয়েছে। আমি নিজেকে এখনও সেই তালিকায় যোগ করতে পারব না। আমার এখনও অনেক রাস্তা যাওয়া বাকি। অনেক, অনেক রাস্তা।’’

বলে না, সাফল্য একটানেশার মতো।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement